#খেলাঘর_৩
সাহেব ভার্সিটির সামনে গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট টা ধরালো,ওর একটা ফোন করা বাকি।তারেক ওর পাশে এসে দাড়াতেই বললো
—কিরে এখনো দাঁড়িয়ে আছিস ভেতরে যাবি না
—যাবো পরীক্ষা শেষে ভাইয়াকে আনতে যাবো
—সাহেব,বাদশা ভাইয়ার কেস টা অনেক জটিল, তুই কি বুঝতে পারছিস না?
সাহেব একটু মিষ্টি করে হাসলো তারেক অপলক চোখে তাকিয়ে ভাবলো এই ছেলেটা কে হাসলে এত নিষ্পাপ দেখায় কেন! ফর্সা মুখে খোচা খোচা দাড়ি সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা, গলায় কালো শাল, চোখে কালো সানগ্লাস, হাতে সিলভার কালারের ঘড়ি ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢোকার আগে প্রতিটি মেয়ের নজর একবার হলেও যার উপর আটকে যাচ্ছে,
—তারেক তুই এইভাবে আমার দিক তাকায় থাকা বন্ধ করবি,প্লিজ?
তারেক ফিক করে হেসে ফেললো, সাহেব মোবাইলে কারো নম্বর ডায়াল করলো ওপাশ থেকে রিয়াইভ হতে সালাম দিয়ে বলল,
—শরীফ চাচা আমি সাহেব,
তারেক বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো এবার মেয়র পদে সাহেবের বাবা আহসান চৌধুরীর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এই শরিফুল ইসলাম, এনার ইন্ধনেই বাদশা ভাইয়ের নামে অপহরণের মামলা করেছেন এলাকার একজন, বেশ কিছু সাক্ষী প্রমাণে মামলা যথেষ্ট স্ট্রং! তাকেই কিনা সাহেব ফোন করেছে
—চাচা বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেন নি চেনার কথাও না আমি বরাবর রাজনীতি থেকে একটু দূরেই ছিলাম আমার ভাইয়া বাদশা আর বাবা আহসান চৌধুরী আমাকে এসবের মধ্যে আসতেই দিতো না, চাচা কি এবার আমায় কিছুটা চিনতে পারছেন?
ওপাশের কথা তারেক ভালো শুনতে পায় নি,কেবল শুনলো সাহেব বলল,
—চাচা আপনার ছোট মেয়েটা ক্লাস ফোরে পড়ে না? ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ড্রাইভার নিয়ে যায় আসে?যাইহোক আমি চাচা আজ পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি ভাবছিলাম বের হয়ে ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় যাবো, সেটা কি সম্ভব চাচা?
তারেকের বিস্ময়ের সীমা রইলো না ও জানে সাহেব বরারবরের বুদ্ধিমান কিন্তু ও এভাবে রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়াবে তা ভাবতে পারেনি,
—চাচা আপনি হয়তো ভালো কথা বুঝতে পারছেন না, আপনি মামলা টা মিথ্যে সাজিয়েছেন আমি সত্যি সত্যি আপনার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়েছি,আপনি তো দেশের আইনের অবস্থা জানেনই ভাইয়া কে ঠিক ছাড়িয়ে ফেলা যাবে কিন্তু আমি চাই আমার ভাইয়া আজ ই বাসায় যাবে ব্যাবস্থা করবেন আপনি, আজকাল হর হামেশায়ই খবরের কাগজে গলা কেটে খুনের খবর ছাপা হয় এসব কিছুই না আপনি তো জানেনই
সাহেব এবার মুচকি হাসলো
—ভয় পাবেন না চাচা, আমি পরীক্ষা দেই আপনি ততক্ষণে একটু দৌড়াদৌড়ি করুন আমার ভাইয়াকে ছাড়াতে কেমন? দোয়া করবেন চাচা পড়ালেখা তো কিছুই করি না যেন পাশ করে যাই।আসসালামু আলাইকুম।
সাহেব ফোন কেটে তারেকের দিকে তাকিয়ে বলল,
—তোর কি আমাকে খুব খারাপ ছেলে মনে হচ্ছে তারেক?
তারেক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বললো
—এসব আজাইরা প্যাচাল আমার সাথে পারতে আসবি না আমি তোকে চিনি পনের বছর যাবত ভুলিস না
—বাচ্চাটা কোথায় জানতে চাইবি না?
—আমি জানি মেয়েটার কোনো ক্ষতি তুই করবি না,
সাহেব তারেকের গলার উপর এক হাত উঠিয়ে বলল,
—তোর মত যদি একটা বউ পাইতাম
—হইছে ভাব মারাইস না, তুই বললে একশোটা মেয়ের লাইন লেগে যাবে তোরই কাউরে মনে ধরে না,এখন বল পড়ছিস কিছু
—নারে,
—এইখানে তো হিরোগিরি দেখাইলে খাতায় কি করবি
সাহেব মাথা চুলকে বলল,
—খালি সামনে পেছনে কোনো মেয়ে পড়লেই হলো তাইলেই বাজিমাত করে দিব।
দূর থেকে তারেক আর সাহেব কায়নাতকে আসতে দেখে বলল,
—খালি এই মেয়ে না পড়লেই হইলো,
কায়নাত সাহেবের সামনে এসে বললো,
—এই যে ডুমুরের ফুল থাকিস কই তুই?
সাহেব কায়নাতের চুল টান মেরে দৌড় দিয়ে বলল,
—তোরে বলতে হবে? তুই কি আমার বউ?
—সাহেবের বাচ্চা তুই আমার চুল এলোমেলো করে দিছিস, দাড়া বান্দর
তারেকও ওদের পিছু পিছু গেটের ভেতরে চলে গেলো
পরীক্ষা শেষে কায়নাত, তারেক, সাহেব সবাই গেটের সামনে আসতেই তারেক বলল,
—কায়নাত তুই তো আজকে ফাটাইয়া লেখছস এত পড়স ক্যা ক তো
—বাজে কথা বলিস না আমি দুই মার্কের এন্সার করতে পারি নাই
সাহেব বিরক্ত মুখে সিগারেট জ্বালিয়ে বলল,
—দেখছোস মাইয়া মানুষ কত খারাপ?আমরা ভাবি আর দুইটা মার্কসের এন্সার করলে নিশ্চিত পাশ করব আর এরা!?
তারেক হেসে বলল,
—চাবি দে সাহেব আমি গাড়ি নিয়ে আসি
কায়নাত কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
—ওই তুই কি বাসায় যাবি নাকি টোটো করে ঘুরবি?
—আমি কোর্টে যাবো ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় যাবো,
—আজ ভাইয়া ছাড়া পাবে
সাহেব আনমনে ধোয়া ছেড়ে বলল,
—তুই যে আয়না আপাকে না বলে ছেলেদের সাথে রেস্টুরেন্ট এ কফি খাইস এইটা আমি জানি এখন টাকা দে নাইলে আপাকে বলে দেবো
কায়নাত অবাক হয়ে বলল,
—তুই কি করে জানলি!
—ওই রেস্টুরেন্ট এ আমার একটা মিটিং ছিলো
কায়নাত মিনমিন করে বলল,
—ওর নাম প্রহর, বাবা ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে
—সেইটা কথা না কথা হইলো ওইদিন রাতে আমি আপার কাছে তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু আমার মনে হলো আপা কিছু জানে না এখন তুই বল টাকা দিবি কি না
কায়নাত মুখ কাচুমাচু করে বলল,
—তোর কি টাকার অভাব যে আমার থেকে নিবি?
—আমারো অভাব না তোরও অভাব না কিন্তু এইটাই ইনকাম করার টেকনিক টাকা ইনকাম করার কোনো সুযোগ ছাড়া উচিত না,পাচশ টাকা বের কর জলদি
রাগে গটগট করে টাকা টা দিয়ে কায়নাত বিড়বিড় করতে করতে বলল,
—তোর সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো
—এখন তো দেখা হয়েই গেছে আর বলে কি লাভ।
কায়নাত বিষন্ন হয়ে সাহেবের হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে ফেলে পা দিয়ে পিষে বলল,
—ইদানীং তুই বেশি বেশি সিগারেট খাস
সাহেব রেগে গিয়ে কায়নাতের চুল দুহাতে এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
—ইদানীং তুই খুব ঢঙ করে চুল বাধিস আর এই কটকটা নীল রঙে তোকে সঙ এর মতো লাগে, দেখছিস কি কবিতা বানাইলাম!
বলেই দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো,
রাগে কায়নাতের কান্না চলে এলো, কিন্তু হঠাৎ ই রাস্তার ওপারে একজন কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর গা শিরশির করে উঠলো প্রহর না ওইটা।
প্রহর রাস্তা পার হয়ে কায়নাতের সামনে এসে দাড়ালো,কায়নাত অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
—আপনি!
—সকালে অফিসে যাওয়ার সময় মনে হলোএই গোলাপি রেইন লিলি গুলো দেখে মনে হলো এগুলো কাউকে দেওয়া দরকার তাই চলে এলাম, ভুল করেছি?
—আর অফিস?
—সেটা জানা জরুরি নাকি এই লিলি গুলোকে ছুয়ে দেওয়া?
কায়নাতকে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাবু করে ফেললো।
কোর্টে গিয়ে সাহেব দেখলো শরিফুল ইসলাম আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন একি সাথে ভাইয়াও আছে,তারেক একটু হেসে বললো
—তুই তো শরিফুল ইসলাম কে ভড়কে দিয়েছিসরে ভাই!
সাহেব হেসে বলল,
—তাইতো দেখছি চল দেখি কি বলে,
সাহেব গিয়ে বাদশা কে জড়িয়ে ধরলো, তারপর হ্যান্ডশেকের জন্যে শরীফুল ইসলামের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—আমি সাহেব চৌধুরী চাচা,
—আমার মেয়ে কোথায়? আমার মেয়েকে কেন এসবের মধ্যে জড়াচ্ছো ও একটা বাচ্চা
—চাচা প্রথম চাল টা তো আপনিই বেইমানী করেছেন আপনি একটা মিথ্যা মামলা সাজিয়েছেন আমি শুধু সেটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি
বাদশা কপাল কুচকে বলল,
—কি করেছিস তুই সাহেব!?
সাহেব একটু চুপ থেকে বললো,
—ভাইয়া একটু পরে বলি,চাচা আপনি বিকেলে আমাদের বাসায় আসেন একটা সংবাদ সম্মেলন করি আমরা আপনি ভাইয়া সম্পর্কে কিছু ভালো কথা বলুন তারপর আপনার ছোট মেয়েকে নিয়ে যান
—এটা কিন্তু কথা ছিলো না সাহেব
—রাজনীতি তে কোনো কথাই কথা না চাচা এইটা কি আপনাকে নতুন করে শেখাতে হবে নাকি?!চাচা আসি আসসালামু আলাইকুম।
বলেই সাহেব বাদশা কে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলো,
শরীফুল সাহেবের পাশ থেকে তার এক কর্মী বলল,
—বাদশা আর আহসান চৌধুরীর মতো এইজন সোজা লোক নয় এর সাথে খেলতে বেশ বেগ পেতে হবে ভাইজান
শরীফ সাহেব রাগে কাপতে লাগলেন।
গাড়ির কাছে আসতেই বাদশা দাঁড়িয়ে গেলো আয়নাকে দেখে, আয়না অনেক্ষণ অপেক্ষা করছিলো সাহেব এগিয়ে গিয়ে বললো
—আপা তুমি?
—কেন আসতে কি মানা?
সাহেব মেকি ভয় পেয়ে বলল,
—আমি কি সে কথা বলেছি?
—এত কথা বলিস কেন?
বাদশা এগিয়ে এসে বললো,
—এখানে এসেছো কেন তুমি?
—সে কৈফিয়ত কি তোমাকে দেবো?
—আমার সাথে এই কড়া কথার ফাদ পাততে আসবে না আয়না এক থাপ্পড়ে গাল লাল করে দেবো
আয়না ঠাস করে বাদশার গালে চড় মেরে বললো,
—সাহেব তুই গাড়ি করে বাড়ি চলে যা আমি আর তোর ভাইয়া রিক্সায় আসছি
তারেক আর সাহেব আর কোনো কথা বললো না চুপচাপ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাদশা কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মিনমিন করে বললো
—আয়না তোমার এখানে আসা একদম উচিত হয় নি।
ততক্ষণে আয়না রিক্সা ঠিক করে উঠে বসেছে,
—তাড়াতাড়ি এসো তোমার জন্যে জনম জনম অপেক্ষা করার দিন আমার শেষ হয়েছে এখন আর সেই দিন নেই।
বাদশা চুপচাপ উঠে বসলো এই মেয়ের সাথে তর্ক করে ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই।রিক্সা আপন গতিতে চলছে, একদিন দুজনে এক রিক্সায় কত সারা শহর চড়ে বেড়িয়েছে তার হিসেব কি আছে?
চলবে…
সামিয়া খান মায়া