#খেলাঘর_৮
লিলি রিক্সা থেকে ভার্সিটির গেটের সামনে নামলো, সে খেয়াল করলো কিছু ছেলে মেয়ে তার দিকে আড়চোখে চাইছে এবং ভেতরে যেতেই কিছুক্ষণের মধ্যে একটা জটলা তৈরি হয়ে গেলো।
সাহেব গেটের বাইরেই সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,তারেক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
—লিলিকে তুই রিক্সায় আসতে দিলি কেন?
—দেখ আমার জানামতে ওর নিজের বাবারই ৫ টা গাড়ি কিন্তু ও বরাবরই রিক্সায় আসা যাওয়া করেছে এখন আমি দরদ দেখাতে গেলে ও ব্যাপারটা ভালো ভাবে নেবে না
—আঙ্কেল কিছু বলে নি ও একা এলো?
—বাবা ভাইয়া দুজনেই বলেছিলো,ইনফ্যাক্ট ভাইয়া নিজে ওকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু যুক্তি তর্কে ওর সাথে পারে কে? দুজনকেই ও সুন্দর মতো বুঝিয়ে এসেছে।
তারেক আড়চোখে চেয়ে বলল,
—তুই আজ ভার্সিটি তে কেন এলি?
সিগারেট টা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে সাহেব বলল,
—আমার জীবন সম্পর্কে তুই আমার চেয়েও বেশি জানিস তারপরও এরকম খোচা মার্কা কথা আমি তোর থেকে আশা করি না তুই নিজেও জানিস বিয়েটা আমি শখ করে করি নি।
বলে সাহেব গেটের ভেতরে ঢুকে গেলো,তারেক একটা নিঃশ্বাস ফেলে সাহেবের পিছু পিছু ঢুকলো।
এদিকে লিলিকে ঘিরে ধরে ছেলে মেয়েদের চোখে মুখে উপচে পড়া কৌতুহল, সাহেব কে চেনে না ভার্সিটি তে এমন মানুষ কম ই আছে, তাছাড়া অনেক মেয়ের জান তার জন্যে কবজ, সবাই জানতো সাহেব কোনো মেয়েকে পাত্তা দেয় না সেই সাহেব যে হুট করে বিয়ে করে ফেলবে তা কেউ ভাবে নি।ভার্সিটি তে লিলিও মোটামুটি পরিচিত, না তার বাবার পরিচয়ের জন্যেই শুধু না সে ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট, নম্র, ভদ্র। তার মায়াবী চেহারা, লম্বা ঘন চুলের একপাশিয়া বেণী, ডাগর চোখ যেকোনো সাহিত্য প্রেমী ছেলেদের বাধ্য করে একবার ছেড়ে আরেকবার তাকিয়ে দেখতে।তার গায়ের চাপা রঙ টা যেন একমাত্র তাকেই মানায়।তাছাড়া সবার কৌতূহলের আরেকটা কারণ হচ্ছে যাদের বাবাদের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক তারা কি করে পালিয়ে বিয়ে করতে পারে।লিলি মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো এরকম কিছু ঘটবে।কিন্তু তাও সে নার্ভাস হয়ে পড়েছে, কিছু মেয়ে তাকে খুবই বিধিয়ে কথা বলছে যাদের ভাষা খুবই কুরুচিপূর্ণ। যার মধ্যে দু একটা এমন
—কি দিয়ে ভুলিয়েছো, লিলি? তোমাকে দেখে তো মনে হতো ভাজা মাছ টা উলটে খেতে পারো না!তলে তলে এত?
লিলির চোখে পানি চলে এলো, বাসায় বরাবর অশান্তির মধ্যে বড় হওয়ায় সে তার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজের গুণে সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে, স্যার,ম্যাম,সিনিয়র, জুনিয়র ক্লাস মেট সবাই তাকে ভালোবাসে,এইটা তার শান্তির জায়গা,প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা, আজ কি সে এই মন ভালো করার জায়গা টা হারাবে?এমন সময় কোথা থেকে সাহেব এসে লিলির হাতের কবজি ধরে দাড়ালো,সবাই চকিত হয়ে গেলো,ভার্সিটি তে সাহেবের আলাদা দাপট আছে কিন্তু সে কথার চেয়ে কাজ বেশি করে, সে এক হাতে চোখের কালো চশমা টা বুকের কাছে শার্টে গুজে দিয়ে একবার লিলির দিকে তাকালো, লিলি মুহুর্তেই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো,সাহেব এবার সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—এবার একটু শুনি কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
দু একজন কোথা থেকে চেয়ার জোগাড় করে বলল,
—ভাই বসেন, ভাই আপনি বসে কথা বলেন
সাহেব বসলো না, তাদের একজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
—তোমার ভাবির জন্যে চেয়ার নিয়ে আসো এখন থেকে আমার জন্যে একটা চেয়ার আনলে তার জন্যেও আনবে।
মুহুর্তেই আরেকটা চেয়ারের জোগাড় করা হয়ে গেলো, সাহেব লিলিকে বললো,
—বসবে?
লিলি দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো,
—ঠিকাছে আমিও বসবো না
সবাই একটু আতঙ্কিত বোধ করতে লাগলো এমনিতেই সাহেবকে তারা চেনে সে ঠান্ডা মাথার লোক যাকে তার অপছন্দ খুব শান্ত ভাবে তাকে সে শাস্তি দেয় তার উপর তার বাবা আবার নতুন মেয়র। সেই নাকি লিলি না বসলে বসতে মানা করে দিচ্ছে,
—কি সমস্যা এতক্ষণ যারা প্রশ্ন করছিলে তারা কই? আমি তো আছি সব প্রশ্নের জবাব পাবে।
পশে থেকে কয়েকজন বলল,
—ভাই কারো কোনো প্রশ্ন নাই,ওরা বুঝে ওঠে নাই,ভাবিকে চেনে নাই ভাই, আপনি কি আজকে ভার্সিটি তে থাকবেন ভাই কি খাবেন বলেন, বিয়ের পর প্রথম আপনারা ভার্সিটি তে আসছেন আপনাদের আমরা খাওয়াবো ভাই।
—দাঁড়াও তাও বলি সবাইকে, একটু কনফিউশন দূর করে দেই,এই যে মেয়েটা আমার পাশে দাঁড়ানো একে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি সে আমার স্ত্রী।এর বাইরে তো আর কারো কোনো কৌতুহল থাকা উচিত নয়, আছে কি?
পাশ থেকে কয়েকজন ওদের সরিয়ে দিয়ে বললো
—কারো কোনো প্রশ্ন নাই সবাই যাও।
সাহেব লিলিকে জিজ্ঞেস করলো
—ক্লাস আছে?
—হু
—ক্লাসে যাও আমি, ভার্সিটিতেই আছি।
—আপনাকে থাকতে…
—ক্লাসে যাও লিলি
লিলি আর কিছু বললো না ও ক্লাসেএ দিকে হাটা ধরলো,পেছন থেকে শুনতে পেলো সাহেব সবাইকে বলছে,
—কে কি খেতে চায় ক্যান্টিনে চলে আয় আজ আমি সবাইকে খাওয়াবো।
আবরার চাবি ঘুরিয়ে দেখলো দরজা খোলা, সে প্রথমে ভাবলো আয়না কি এসেছে! পরক্ষনেই নিজের ভাবনায়ই নিজে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ভাবলো হয়তো দরজা লক করতে ভুলে গেছিলো আয়না এখানে কখনোই আসবে না। আবরারের ফ্লাটের ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে কিচেন দেখা যায় সে ড্রয়িং রুমের পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে হয়তো দেখতে পেলো তার জীবনের অন্যতম সুন্দর একটা দৃশ্য, আয়না শাড়ির আচল কোমড়ে গুজে রান্না করছে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! তাকে দেখা যাচ্ছে অপ্সরীর মত সুন্দর! আবরারের দিকে না তাকিয়ে আয়না বলল,
—ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি সবটা বলছি ভুল বুঝে বসে থাকবেন না,
আবরার তাও গেলো না সে দাঁড়িয়ে রইলো,সে এক মুহুর্ত সময়ও অন্য কোথাও যেতে চায় না, আয়না টেবিলে খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,
—ময়লা অপরিষ্কার,ঘামের দুর্গন্ধ আমি একটুও সহ্য করতে পারি না, প্লিজ ডাক্তার সাহেব আপনার সাথে এখন জীবাণু আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আছি।
আবরার এমনি দিনে খুব সময় নিয়ে গোসল করে,বিষন্ন হয়ে বাথরুমে ঢোকে, আজ সে দশ মিনিটে গোসল করে বের হয়ে এলো।আয়না কিছুক্ষণ স্নিগ্ধ আবরারের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো,তারপর বলল,
—আসুন খাবেন
আবরার খাবার টেবিলে বসলো,সে এতক্ষণ কোনো কথা বলে নি, কোনো কথা সে বলতেও চায় না, সে কিছু জানতে চায় না শুনতে চায় না শুধু এই সময়টাকে চায় আয়না কে সে এভাবেই চায়।আয়না খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,
—আমি এসেছিলাম আপনার সাথে কথা বলতে কিন্তু এসে আপনার বাড়িঘরের যে চেহারা দেখলাম তাতে আমার নিজেরই তিনদিন অসুস্থ থাকার কথা,
—তুমি খাবে না?
আয়না নিজের জন্যে প্লেট নিতে নিতে বললো,
—এত কষ্ট করে আমি আপনাফ জন্যে রান্না করেছি তাই মনে হয়?
আবরার একটু হাসলো,
—শুধু শুধু অপেক্ষা করার চেয়ে ভাবলাম ঘর গুছাই,বাড়িঘর গুছিয়ে দেখলাম খিদে পেয়েছে কিন্তু খাবার নেই কোনো তাই রান্না করলাম।
—হু বুঝেছি
—আমি আপনাকে কিছু বলতে এসেছি,
—খাবার শেষ করি? তারপর শুনি?
—ঠিকাছে।
আয়নার কাছে কোনো ভালো কথা আবরার আশা করে না তাই সে চায় এই সময়টুকু ভালো কাটুক।
ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে কায়নাত দাড়িয়ে আছে,প্রহর গিয়ে পাশে দাড়ালো,
—ঘুমাবে না কায়নাত?
কায়নাত নড়লো না,প্রহর কায়নাতের হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
—তোমার সাথে আমি অন্যায় করেছি কায়নাত
কায়নাত এবার আহ্লাদী চোখে তাকালো সে ভাবলো এবার বুঝি প্রহর তাকে কাছে টানবে,
—আমি তোমাকে ভালোবাসি না কায়নাত,কখনও বাসিও নি,আমি যা করেছি একটা ঘোরের মধ্যে করেছি,তোমার কথা যখন মা আমাকে বলল,আমি না ই করে দিতাম বিশ্বাস করো কিন্তু যখন শুনলাম তুমি আমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছো আমার একটু কৌতুহল হলো আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার সাথে দেখা করব, আমার তখন তিতলীর সাথে ঝামেলা চলছিলো পুরো দমে,আমিও রাগ করে তোমার দিকে ঝুকে পড়লাম জেদ করে বিয়েটা করে ফেললাম কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তিতলীকএ ছাড়া কাউকে ভাবতে পারছি না,বিয়ের দিন থেকে এক অদ্ভুত অপরাধবোধে আমি ভুগছি।আমি ভালো নেই।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া