খেলাঘর_১০

0
238

#খেলাঘর_১০

ইদানীং সাহেব তার কিছু অভ্যেসে পরিবর্তন এনেছে,এই প্রথম তার কাছে কোনো কাজ খুব কঠিন মনে হচ্ছে।পড়ালেখা যে এত কঠিন এটা তার জানা ছিলো না।যে ছেলে রাতের পর রাত এমনি এমনিই জেগে থাকতো এখন এগারোটার দিকে বই নিয়ে বসলেই তার চোখ ভেঙে ঘুম পায় কিন্তু সে ঘুমুতে পারে না কারণ তার সামনেই লিলি সারা রাত পড়া লেখা করে খুব স্বাভাবিক ভাবে টেবিলে বসে।মাঝে মাঝে সাহেবের খুব ইচ্ছে হয় লিলির খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতে।সাহেব এখন রেগুলার ভার্সিটি যায় আসে, পড়া তৈরি করার চেষ্টা করে নোট তৈরি করে। লিলিকে পড়তে বসতে দেখলেই তার হিংসে হয় রাগে গা জ্বালা করে।এই মেয়েটা বহুরূপী,তার বাইরেই শতেক রঙ ভার্সিটিতে গেলে সে যেন সাহেবকে চিনতেই পারে না ওর সামনে পড়লেও পাশ কাটিয়ে চলে যায়, তার এক অন্যরকম দাপট!ক্যান্টিনের চায়ের দোকানের মামাটা যতটা সাহেবকে চেনে ততটাই লিলির নাম জপে,লাইব্রেরী দেখাশোনা করা মামা,লিলির ডিপার্টমেন্ট এর স্যার ম্যাম,ক্লাসমেট লিলি মানেই তাদের কাছে এক অন্যরকম পরিচয়। এই মেয়েটাই আবার বাড়িতে গিন্নীগিরি করছে সমান তালে সাহেবের মায়ের সাথে মিষ্টি ঝগড়া করছে,বাদশার সাথে দুষ্টুমি করছে,খাওয়া ওষুধ নিয়ে আহসান চৌধুরীকে শাসাচ্ছে, বাগানে মালি কাকার সাথে বসে ঘাস পরিষ্কার করাচ্ছে, কাজের মেয়েদের সাথে একসাথে তেতুল বাটা, পেয়ারা মাখানো খাচ্ছে আবার ঘরে এসে সেই লিলি একদম শান্ত চুপচাপ, ঠান্ডা করে সাহেবকে পড়ালেখা নিয়ে কথা শোনাচ্ছে,নিজে ধুমধাম পড়ালেখা করছে। এই লিলিই মাঝ রাতে একা একা ছাদে,বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের সাথে নিজে কথা বলছে।

কায়নাত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলো, সে ঘুম থেকে উঠে মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে শুয়ে রইলো, তার চোখের সামনে যে মানুষ টা ঘুমিয়ে আছে নিয়ম মতো তার হওয়ার কথা ছিলো কায়নাতের সবচেয়ে কাছের মানুষ অথচ,এই মানুষটার নাগাল সে কোনোদিন পেলোই না, ও যতই মন কে বুঝিয়ে রাখুক ও জানে এই মানুষটা তার মনে আলোড়ন করা প্রথম মানুষ। এই বাড়ির আনাচে কানাচে সে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু কোনো ঠাই খুজে পায় না খুব কাছে থেকে সে যখন প্রহরের ঘ্রাণ নেয় তখন তার সাথে অন্যকারো ঘ্রাণ সে পায়।কায়নাত হাসলো।সে জানে প্রহরেরও কষ্ট হয় নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে সে বলতে পারে না প্লিজ কায়নাত চলে যাও।কায়নাত বিছানা ছেড়ে উঠে গোসল সাড়লো সে আজ সেই সাদা থ্রিপিচ টা পড়লো এইটা পড়েই সে প্রথম প্রহরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো।আয়নায় নিজেকে দেখলো কায়নাত নিজের রূপে সে নিজেই মুগ্ধ হতো বিয়ের আগে, এখন কেমন চোখের নিচে কালি জমে গেছে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।মাথা মাথা মুছে সে ভেজা চুল ছেড়ে সেই বড় জানালাটার দিকে তাকালো,প্রহর ঘুম ভেঙে দেখলো কায়নাত বিছানায় নেই,তারপরই জানালার পাশে দেখতে পেলো কায়নাত পেছনে ঘুরে সুন্দর করে হেসে বলল,
—প্রথম প্রহরের শুভেচ্ছা।
প্রহর একটু অবাক হলো, কিছুটা মুগ্ধ হলো,কিছুটা অপরাধবোধ তাকে নাড়া দিলো।
প্রহর অনেকটা দ্বিধা নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখলো কায়নাত সোফায় বসে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শুনছে, প্রহর ওয়াশরুম থেকে বের হতেই কায়নাত ইয়ার ফোন খুলে বললো,
—এসো তো একটু বসো কথা বলি,অনেকদিন আমি কারো সাথে বলি না
প্রহর কিছু বুঝলো না, কায়নাত উঠে গিয়ে প্রহরের হাত ধরে এনে তাকে সোফায় বসালো তারা দুজন বসেছে একদম মুখোমুখি, কায়নাতের চোখে মুখে হাসি,ও প্রহর কে বললো,
—আজ আমার জন্মদিন,আপা,দুলাভাই,বাবা, আমাদের প্রতিবেশী সাহেব সবাই আমাকে উইশ করেছে, এমন কিন্তু না তুমি জানতে না আজ আমার জন্মদিন আমাদের বিয়ের আগে যখন আমরা অনেক রাত জেগে কথা বলতাম তখন তুমি সবটা জেনে নিয়েছো আমিও জেনেছি তোমার ছোট মাছ চচ্চড়ি পছন্দ, তুমি সফট মিউজিক পছন্দ করো, তোমার প্রিয় রঙ গাঢ় সবুজ।একটু খেয়াল করলে দেখতে আমি সপ্তাহে প্রায় দুদিন ছোট মাছ চচ্চড়ি রান্না করি, এই দেখো আমার প্লে লিস্টে ভর্তি সব তোমার পছন্দের গান, একটু খেয়াল করলেই জানতে সাদা রঙ পছন্দ ছিলো এমন একটা মেয়ের আলমারি ভর্তি গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি, জামায় ঠাসা প্রায় সন্ধ্যায় সে গাঢ় সবুজ রঙের ড্রেস পড়ে।আমাদের রুমের ডেকোরেশান খেয়াল করেছো বিছানার চাদর, জানালার পর্দা আর এই যে সোফার কুশন।
প্রহর নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে আজ কায়নাতের চেহারায়, চোখে, শরীরের ভঙ্গিতে এক অন্যরকম কায়নাত সে দেখছে।
—আচ্ছা বাদ দেই আজ এসব কথা, আমার প্রতি জন্মদিনে আমি নিজেকে একটা উপহার দেই, তোমার সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে আমি রাত জাগি আগে একসাথে জাগতাম তোমার কথায় ভাসতাম এখন একা জাগি বিষন্নতায় ডুবে জাগি।তোমাকে সেদিন আমি গিয়েছিলাম বিয়ের জন্যে না করতে কিন্তু এক অদ্ভুত মোহে আমি না করতে পারি নি,আমি বরাবরের চঞ্চল মেয়ে খুব প্রাণোচ্ছল,মুখের উপর কথা বলা কায়নাত সেদিন থেকে আমি অন্যরকম হয়ে গেছি,এতটাই অন্যরকম যে আমি কিন্তু এখনো মুখ ফুটে তোমাকে একটা কথা বলি নি,কি জানো?আমি তোমাকে ভালোবাসি।আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছি,আমার আমিত্ব,ব্যাক্তিত্ব,সর্বস্ব দিয়ে। আমি জানি আমি ভুল করি নি,যে ভালোবাসে সে ভুল করে না। তুমিও ভুল নও।তোমার ভালোবাসার জায়গায় তুমি ঠিক।
কায়নাত হাসলো।প্রহরের ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া চেহারা দেখে তার খুব হাসি পাচ্ছে আজ কি তার খুব আনন্দের দিন নাকি?সব কিছু এত সুন্দর লাগছে কেন!কায়নাত উঠে দাড়ালো,
—প্রহর,একটা জিনিস চাইবো?
—কি?
—একবার আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে?
প্রহর তাকিয়ে রইলো,তার গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।
—প্লিজ?
করুণ চোখে চেয়ে প্রহর বললো,
—শুভ জন্মদিন কায়নাত
—ধন্যবাদ, আমি আসি?
—কোথায় যাচ্ছো!
কায়নাত হাসলো,
—নিজেকে উপহার দিতে,দ্বিতীয় প্রহরের শেষ শুভেচ্ছা প্রহর আহমেদ।
কায়নাত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো,প্রহর বসে রইলো অসাড় হয়ে।

কায়নাত সারাদিন বাইরে ঘুরে বিকেলে বাড়ি ফিরলো,বাড়ির গেটে তার সাহেবের সাথে দেখা হলো,সাহেব কায়নাতের চুল টেনে দিয়ে বললো,
—কই ঘুরোস ঢ্যাংঢ্যাং করে?
কায়নাত হাসলো, সাহেবের মনে হলো অনেকদিন সে কায়নাতের এরকম প্রাণখোলা হাসি দেখে না,
—আজকে আমার জন্মদিন
—কাল কে তো উইশ করলাম!
—গিফট কই?
—কিসের গিফট,
কায়নাত হাসলো, সে জানে সাহেব তাকে গিফট দেবে, কায়নাত ভেতরে ঢুকে গেলো,কিছুক্ষণ পর সাহেব গেলো কায়নাতদের বাসায় ওর হাতে চব্বিশটা সাদা গোলাপ।

কায়নাত বিকেলে এলো সন্ধ্যার পর থেকে তুমুল বৃষ্টি,আয়না কায়নাতের পছন্দমতো ইলিশভাপা রান্না করলো ওরা সবাই একসাথে রাতের খাবার খেলো, আসগর সাহেবের মন খুশিতে ভরে উঠলো সে খুব তৃপ্তি করে খাবার খেলেন মেয়েদের সাথে। আবরার ফিরলো একটু দেরিতে বৃষ্টিতে সে আটকে গেছিলো প্রতিদিনের মতো আজও সে বাড়ি ফিরে আসগর সাহেবের ঘরে ঢুকলো।বাইরে তুমুল ঝড়। আসগর সাহেব মারা গেলেন রাত ১১ টার দিকে।

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here