#খেলাঘর_১৭
আয়না মুখ গোমড়া করে অনেক্ষণ হলো বসে আছে, আবরার কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না, তবুও বিছানায় বসে হাত ধরে বলল,
—কি হয়েছে আয়না?
—কিছু না
—কিছুই না?
—না
আবরার হেসে বলল,
—ঘুরতে যাবে?
—না
—দেখো তো এই শাড়িটা, পছন্দ হয় নাকি? চলো ঘুরে আসি
আয়না শাড়িটার উপর হাত বুলালো বাচ্চাদের মতো হেসে বলল,
—তুমি বসো আমি রেডি হয়ে আসি!
আয়না উঠে যেতেই আবরার একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেললো, পৃথিবী এত বিচিত্র! সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা এত জটিল! আবরারের চোখের সামনে স্পষ্ট সেই দিনটা ফুটে উঠলো,আয়নার থেকে পালিয়ে শহর থেকে দূরে এক উপজেলা হাসপাতালে জয়েন করে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছিলো, এক বৃষ্টির বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এরকমই এক বৃষ্টির রাতে করা ভুলের জন্যে অনুশোচনায় পুড়ছিলো, নিজেই নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছিলো,আফসোস করছিলো ওই ভুলটা না করলে অন্তত আয়নার সামনে দাড়াতে পারতো,দূর থেকে হলেও ওর খোজ রাখতে পারতো অন্তত কেমন আছে জিজ্ঞেস তো করতে পারতো!এমন সময় আবরারের মনে হলো তার বাড়ির সামনে কটকটে হলুদ শাড়ি পড়ে কেউ দাড়িয়ে আছে, সে কি ভুল দেখছে প্রচুর বৃষ্টির বেগে এক হাত সামনে স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না এর মধ্যে তার মস্তিষ্ক কি জোর করে আয়নার মতো কোনো মেয়ের অবয়ব দাড় করাতে চাইছে? আবরারের ভুল ভাঙলো, বারান্দার সিড়ি ভেঙে সে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে গেলো বৃষ্টির দাপটে ভিজে ঠকঠক করে কাপতে থাকা মেয়েটি তার খুব পরিচিত, আয়না। এরকম বৃষ্টিতে এর আগে অনেকবার ভিজেলেও এভাবে দাত কাপুনি আয়নার আগে কখনো হয় নি, আবরার খেয়াল করলো কিছুদূরে একটা কালো গাড়ির জানালার কাচ তুলে কেউ গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলো লোকটার চোখে কি পানি ছিল? নাকি আবরার ভুল দেখেছে বৃষ্টির পানিতে তার সবই ভেজা ভেজা লাগছে!বরাবরের মতো শান্ত গলায় আয়না আবরার কে কিছু বলছিলো পার্থক্য শুধু এই যে তার সাথে মিলিয়ে কথার সাথে আয়নার দাতের কটকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল,
আয়না প্রবল বেগে আবরারের কলার চেপে বলেছিলো,
—কোন সাহসে আপনি আমাকে না বলে চলে এলেন! এত স্পর্ধা আপনার হয় কি করে! আমার বাবা যেখানে পানি খাওয়ার আগে আমায় জিজ্ঞেস করতো! সেখানে আপনি বাড়ি থেকে চলে আসার আগে আমাকে বলে আসার প্রয়োজন মনে করলেন না! চিরকুট লিখে এলেন! বলি আপনার হাতের লেখা এত অস্পষ্ট কেন? আমি তো কিছুই বুঝি নি, কি লেখা ছিলো তাতে,হ্যা?
আবরার বুঝলো না সে জানতো ডাক্তার হলেও তার হাতের লেখা যথেষ্ট স্পষ্ট! আয়না কি সত্যি তার লেখা বুঝতে পারে নি!আবরার কে চুপ থাকতে দেখে আয়না আবার বলল,
—আপনি কি ঘাস খেয়ে ডাক্তার হয়েছেন মাথায় কি কিছু নেই! আপনার মনে হয় আমার সম্মতি না থাকলে আপনি আমায় ছুয়েও দেখতে পারতেন পেরেছেন কখনো? খুব তো বড় বড় কথা বলেছিলেন আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করব তোমার কখনো আমার দরজায় দাড়িয়ে থাকতে হবে না! আমি যে এতদিন আপনার বাড়ির দরজায়, হাসপাতালে,আপনার আশ্রমের সামনে দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে সময় নষ্ট করলাম আপনি এলেন না! আমার চাকরিটা তো গেলো কি ভেবেছেন? সারাজীবন আমি খালি রান্নাবান্না করেই জীবন পার করব আর আপনাকে খাওয়াবো? কখনোই না। আয়না যথেষ্ট সাবলম্বী।
আবরারের মনে হচ্ছিলো এত সুন্দর কথা সে আগে কখনো শোনে নি এতগুলো কথা কেউ কখনোই একান্ত তাকে বলেনি! অদ্ভুত ভাবে সেদিনের বৃষ্টিতে আবরারের আর জ্বর এলো না! শুধু আয়না অজ্ঞান হয়ে গেলো।আবরার হাসলো আয়নার সেবা করতে হবে বলেই হয়তো ওর জ্বর আসেনি। আয়নার জ্ঞান ফেরার পর খুব স্বাভাবিক ভাবে সে বিছানা থেকে উঠে বসলো দরজার সাথে হ্যালান দিয়ে এতক্ষণ আবরার ঘুমন্ত আয়নাকে দেখছিলো,আয়না উঠতেই আবরার সুন্দর করে হেসে জিজ্ঞেস করলো
—ঠিক আছো?
আয়না কপাল কুচকে বলল,
—তা আমি কিভাবে বলব আমি তো ডাক্তার নই।
আবরার হাসলো,আয়নার সে হাসি দেখে গা জ্বলে উঠলো প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল,
—বৃষ্টি কি কমেছে?আমি বাসায় চলে যাবো।
—সত্যি চলে যাবে?
—তা নয়তো কি আমি মিথ্যে কথা বলছি?আপনার কি মনে হয় আমি কি আপনার মতো কথায় কথায় মিথ্যে কথা বলি?
আবরার হাসলো, যেন আয়না কোনো মজার কথা বলেছে,
—হাসছেন কেন?এই আপনি হাসছেন কেন?
—থেকে যাও আয়না। আমি একটু ঘুমাই।
বলেই আবরার এসে আয়নার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো, আবরারের বলা “থেকে যাও” কথাটাই কানে বাজতে থাকলো।এরপর সাবলম্বী আয়না আর চাকরি করতে যায় নি, আবরার আবার ঢাকায় শিফট করেছে, আয়না মুখ গোমড়া করে রান্না করে আবরারকে পাশে বসিয়ে খাবার পরিবেশন করেছে তার মুখের ভাব এমন যে এই কাজটা সে করছে অনেক কষ্টে।
আবরার জানে আসলে তা না, সে হাসি মুখে খেতে বসলে আয়না সারাক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে আবরারের ধারণা খাবার শেষ করে যদি সে আয়নাকে জিজ্ঞেস করে বলোতো কয় লোকমা খেলাম আয়না ঠিক বলে দিতে পারবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
কিন্তু সময় খুব নিষ্ঠুর সে নিজে স্থির থাকে না কাউকে থাকতেও দেয় না, এই চারবছরে আয়নার মিসক্যারেজ হয়েছে তিনবার, মাঝে মাঝেই সে অস্বাভাবিক আচারণ করে কিছুতেই তাকে শান্ত করা যায় না, বোঝানো যায় না। আবরার বোঝে, একটা মানুষ আর কত সহ্য করবে? আয়নার সহ্য শক্তি শক্ত বলেই ওকেই পরীক্ষা দিতে হয় সবচেয়ে বেশী।যখন আয়নার কষ্ট হয় বাড়িঘর এলোমেলো করে, হাত পা ছুড়ে কান্নাকাটি করে, ডুকরে কেদে ওঠে আবরারের খুব মায়া হয়।আবার এই মেয়েটা এতই অদ্ভুত কিছুক্ষণ যেতেই একেবারে শান্ত হয়ে যায় যেন কিছুই হয় নি সব স্বাভাবিক নিজের অগোছালো ঘরবাড়ি আবার সুন্দর করে সাজায় আবরার অবাক হয় বারবার অনেকবার।
আয়না রেডি হয়ে এসে আবরার কে বলে,
—তুমি কি যাবে না?
—হ্যা যাবী তো
—তাহলে রেডি হচ্ছো না কেন?আমরা কিন্তু আজ রিক্সায় ঘুরবো।
—আচ্ছা আমরা রিক্সায় ই ঘুরব।আমি রেডি হয়ে আসি।
চলবে….
সামিয়া খান মায়া