প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৯)

0
326

#প্রেমোদ্দীপক। (পর্ব-৯)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

সাদা এপ্রণের পকেটে হাত গুজে অফিস রুমের ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তাহিয়া। উদ্দেশ্য, অভীক কলেজে এসেছে কি না যাচাই করা। আজ প্রথম ক্লাসটা অভীকের। আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি আছে ক্লাসের। মীরা, শৈলী কেউ এখনো আসেনি। তাহিয়ার ভাবনা, অভীক অফিস রুমে না থাকলে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বান্ধবীদের অপেক্ষা করবে, মীরা শৈলী এলে তাদের নিয়ে বেরিয়ে যাবে। প্রথম ক্লাস শেষ হলে ফিরবে। অভীকের ক্লাস করবে না। যদি অফিস রুমে থাকে তবে কাল বিলম্ব না করে এখনই বেরিয়ে যাবে, গ্যালারিতে বসে ভেলপুরি খেতে খেতে দুই বান্ধবীর আগমনের প্রহর গুনবে। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করেও অফিস রুমের ভেতর অভীককে দেখল না। ফারদিন স্যার সহ আরও কয়েকজন স্যার বসে আছেন। অভীকের ডেস্ক খালি। বোধহয় আসেনি এখনো। তাহিয়া হাফ ছাড়ল। এবার নিশ্চিন্ত মনে কিছুক্ষণ থাকা যাবে। প্রসন্ন হেসে ঘুরে দাঁড়াল। পা বাড়াতে গিয়েও সম্মুক্ষে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে থেমে যেতে হলো। তার থেকে এক হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে অভীক। চোখমুখে পেশাগত গম্ভীর্য। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তাহিয়ার দিকে। অভীককে দেখে ভীত ঢোক গিলে সটান দাঁড়িয়ে গেল তাহিয়া। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়, এ প্রবাদের বাস্তবরূপ দেখছে যেন।

চারদিক চোখ বুলিয়ে অভীক বলল,
‘আমাকে খুঁজতেছো?’

তাহিয়া বিব্রতবোধ করল। তীর্যক চাহনিতে তাকাল এদিক ওদিক। তারপর নেতিবাচক মাথা নাড়াল। অভীক ওঁর মনোভাব ধরতে পারল ঠিকই। রাশভারি গলায় বলল,
‘অভীক এখনো কলেজে আসেনি। এটা সম্ভবত ওঁর আত্মা টাত্মা হবে। এটেন্ডেন্স দিয়েই চলে যাবে, ক্লাস করবে না। ক্লাস ব্যাঙ্কের চিন্তা বাদ দিয়ে এবার নিশ্চিন্ত মনে ক্লাসে যাও।’

ধরা পড়ে কাচুমাচু করল তাহিয়া। লোকটা এত চতুর! ক বলতে কলকাতা বুঝে ফেলে। একটু সহজ সরল হলে কী হতো! কী সুন্দর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারতো। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভীক ধমকে উঠল,
‘যাও! আমার ক্লাসে তোমার উপস্থিতি চাই। না পেলে ভালো হবে না। ফাজিল!’

তাহিয়া ক্লাসের দিকে পা বাড়াল। এক কদম বাড়াতেই মীরা দৌড়ে এলো। মাত্র এসেছে সে। বান্ধবীকে দেখে তাহিয়া রাগে ফোঁসফোঁস করে বলল,
‘ গ্রাজুয়েশন শেষ করে আমি টিচার হবো। তারপর এই স্যারের ছেলেমেয়েকে পিটিয়ে সব ধমকের প্রতিশোধ নিব, দেখে নিস! ‘

বিয়ের আগে প্রায়শ এই কথা বলতো তাহিয়া। অভীকের উপর ক্ষোভ থেকে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অভীকের সন্তানদের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিবে। অভীক যখন ক্লাসে ধমক দিত তখনই বলতো কথাটা। এখনও অভ্যাসবশত বলে ফেলেছে, আগে পরে ভাবেনি।

অফিস রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকায় তাহিয়া ক্ষোভজনিত কথাটা কানে গিয়ে পৌঁছল অভীকের। সে ভ্রু কুঁচকাল। ফাজিল মেয়েটা আদৌ জানে, সে কী বলছে? এই কথার বর্তমান ব্যাখ্যা কী? হাসি ও পেল তাহিয়ার অবুঝপনা শপথে শুনে। কী অদ্ভুত শপথ মেয়েটার! ডেস্কে বসে আনমনেই হাসল সে।

.
ক্লাসে বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে তাহিয়া। মীরা ও সঙ্গ দিচ্ছে। ক্ষুব্ধ গলায় অভীকের বিরুদ্ধে অভিশাপের পসরা সাজিয়ে বসেছে। অভীকের উপর ভীষণ অসন্তুষ্ট সে।
‘এই স্যারটা জীবনে ও ঠিক হলো না। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বউয়ের শাসানি খেয়ে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ঠিক হলো না। বউটা ও কেমন, স্বামীকে শাসন করতে পারে না? সারাক্ষণ ধমকের উপর রাখলে ঠিক হয়ে যাবে। ‘

রাগের মাঝে তাহিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। বিড়বিড় করে বলল, ‘বউ দিবে ধমক! বউ নিজেই তো ভয়ে আড়ষ্ট। ‘
মনের কথা মনে চেপে বলল, ‘স্যারের বউ রাগ দেখানোর মতো নাও হতে পারে।’

মীরা কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘হিটলার স্বভাবি মানুষের কপালে হিটলারী বউই মিলে। স্যারের বউ স্যারের মতো জাঁদরেল হবে, হতে হবে। নয়তো স্যারকে ধমক দিয়ে সোজা করবে কে? নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরাবে কে? আমি তো দোয়া করি, স্যারের বউ যেন দুনিয়ার সবচেয়ে রাগে, জেদী, অবাধ্য, কঠিন মানুষ হোক। আমাদের সব ধমকের বদলা নিবে সে। বউ ভালো হলেও খারাপ হয়ে যাক। এই বদলোক নবীন বরণের দিন সকালে ক্যাম্পাসে আসতে না আসতেই আমাকে ধমক দিয়েছে। আল্লাহ বিচার করবে, এই লোকের ভালো হবে না দেখিস। ‘ সব ক্ষোভ ঢেলে দিল মীরা।

তাহিয়া প্রতিবাদ করে উঠল,
‘ স্যারের বউয়ের সম্পর্কে বলবি না। বেচারি নিরীহ ভোলাবালা মানুষ। তার দোষ নেই।’

মীরা ভ্রু কুঁচকাল, ‘তুই আজ উলটো গান গাইছিস! আর তুই কিভাবে চিনিস স্যারের বউকে?’

‘আমি আমাকে চিনব না!’ বিড়বিড় করে কথাটা বলে উচ্চৈঃস্বরে বলল,
‘চিনি কোন একভাবে। বাদ দে।’

কথা ঘুরাল তাহিয়া। ফোন হাতে নিয়ে দেখল অভীকের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। ওপেন করে চোখ বুলাল,
‘তুমি যদি টিচার হতে পারো তবে আমি আমাদের সন্তানকে তোমার কলেজে ভর্তি করাব। এরপর তুমি যদি তোমার সন্তানকে পিটিয়ে শোধ তুলতে পারো, তবে আমি কোন আপত্তি করব না। কথা দিচ্ছি। ‘

বারকয়েক ম্যাসেজটা পড়ে সারমর্ম বোধগম্য হলো তাহিয়ার। তখন কথাটা শুনে ফেলেছে লোকটা! এবার কী হবে! কী ভাববেন উনি! সন্তানের কথা আসায় লজ্জাটা বেড়ে গেল দিগুন। নিজের মাথায় চাটা মারল, কথা বুঝে শুনে বলবি তো!
এই ম্যাসেজের পর অভীকের সামনে বসে ক্লাস করা যায় না। তড়িৎ উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। মীরাকে নিয়ে অভীকের অগোচরে বেরিয়ে এলো।

চোখে মুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে বসে আছে তাহিয়া। দৃষ্টি, হাতে ধরা হালকা গোলাপী রঙা কাতান শাড়ির উপর। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সোনার গহনা। এই ভারি শাড়ি, গহনা পরে তাকে এখন যেতে হবে অবনীর বাসায়। অবনীর ছেলে অয়নের জন্মদিন উপলক্ষে ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অভীকের স্ত্রী হিসেবে অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত তাহিয়া এবং তার পরিবার। অসুস্থ শরীর নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় মাহমুদার, তুহিন ও যাবে না। বাকি রইল তাহিয়া। অবনী, তানভীর দুজনেই বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে যেতে বলেছেন। ছোট্টো অয়ন ও ফোন করে মামীকে দাওয়াত দিয়েছে। সবার অনুরোধ ফেরাতে না পেরে রাজি হলো তাহিয়া।

যাওয়া অবধি ঠিক ছিল। ঘটনার রং বদলাল মাহমুদার কথায়,
‘নীলিমার দেয়া কাতান শাড়ি পরে যা। সাথে সোনার গহনা পরবি। প্রথমবার অভীকের স্ত্রী হিসেবে অবনীর বাসায় যাচ্ছিস, শাড়ি না পরলে বেমানান লাগবে। তা ছাড়া তুই নতুন বউ। নতুন বউদের শাড়ি পরতে হয়।’

শুনেই বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এলো তাহিয়ার। শাড়িটা ধরে দেখেছে, ভীষণ ভারী । এত ভারী শাড়ি, গহনা পরে কিভাবে থাকবে! নবীন বরণের শাড়ি দুটো পাতলা ছিল বিধায় অনায়েসে সামলাতে পেরেছে, এটা কিভাবে সামলাবে! মাকে কত করে বলল, জর্জেট শাড়িটা পরে যাবে। মায়ের তাতেও আপত্তি। মেয়েকে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে নিজ উদ্যোগে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। অতঃপর একে একে সোনার সিতা হার, ছোকার, কানের দুল, চুড়ি পরিয়ে দিলেন। এসব নীলিমার দেয়া। খোঁপা করে ভারী প্রসাধনীতে মুখ ঢাকল। সাজগোজ পর্বের সমাপ্তি টানার পর উঠে দাঁড়াল তাহিয়া। অস্বস্তিভরা গলায় বলল,
‘এভাবে কিছুক্ষণ থাকলেই দম বন্ধ হয়ে আসবে আমার। অনুষ্ঠানের শেষ অবধি কিভাবে থাকব, মা?’

একটা ব্যাগে ভারি কাজের থ্রি-পিস ঢুকিয়ে দিয়ে মাহমুদা বললেন,
‘ থ্রি-পিস দিয়ে দিয়েছি। বেশি অস্বস্তি হলে চেঞ্জ করে নিস। এভাবে ও বাসায় গেলেই হবে।’
থেমে বললেন,
‘এই ভারি সাজের সাথে চশমা বেমানান লাগবে। চশমা ও ব্যাগে দিয়ে দিচ্ছি। অনুষ্ঠান শেষ হলে পরে নিস।’

তাহিয়া বাধ্য মেয়ের মতো সায় জানাল। অভীক এলো বেশ কিছুক্ষণ পর। ঘড়ির কাটায় তখন চারটা ছুঁইছুঁই। অভীক গেইটে দাঁড়িয়ে তাহিয়াকে কল দিল। রিসিভ হতেই ভণিতা ছাড়া বলল,
‘আমি গেটে দাঁড়িয়ে আছি। নিচে নেমে আসো।’

অভীকের ফোন পেয়ে নিচে নেমে এলো তাহিয়া। অভীকের দৃষ্টি এদিকেই ছিল। এতক্ষণে দৃষ্টিতে তীক্ষ্মভাব না থাকলেও এ পর্যায়ে এসে তীক্ষ্ণতা এলো। মেয়েটাকে আজ অন্যরকম লাগছে, কেমন যেন বউ বউ ভাব ফুটে উঠেছে তার মাঝে। অভীকের তাকিয়ে থাকার মাঝে ধীর পায়ে তাহিয়া এসে দাঁড়াল পাশে। ওঁর দৃষ্টি ধুলোমাখা রাস্তার বুকে। তাহিয়ার এক হাতে পার্স, অন্য হাতে কাপড়ে ব্যাগ। রিক্সা দাঁড় করানো অভীকের পাশে। তাহিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে অভীক বলল,
‘ব্যাগ আমায় দিয়ে রিক্সায় উঠো তুমি।’

তাহিয়া বিনা বাক্যে রিক্সায় উঠে বসল। অভীক বসল তার পাশে। মাঝে কিছুটা দূরত্ব। সিএনজি স্টেশন গিয়ে রিক্সা থামল। অভীক আগে নেমে গেল। তাহিয়ার শাড়ি সামলিয়ে নামতে কষ্ট হচ্ছিল দেখে হাত বাড়াল,
‘আমার হাত ধরো। ‘

বাড়ানো হাতের দিকে এক পলক তাকাল তাহিয়া। দ্বিধাময় মনেই হাতে হাত রাখল। অভীকের সাহায্য এখন সত্যি প্রয়োজন। প্রথম স্পর্শে হৃদপিণ্ডটা কেমন যেন লাফিয়ে উঠল তাহিয়ার। আজ ভয় নয়, লাজুক অনুভূতি হলো। লজ্জার মাত্রাটাও গাঢ়তর। গাল লাল হলো। তার লজ্জার মাঝে দুটো শক্তপোক্ত হাত তাকে ধরে নামাল।

অভীক ভাড়া মিটিয়ে তাহিয়ার হাত ধরেই সিএনজিতে উঠল। পাশাপাশি বসার পর তাকাল তাহিয়ার পানে। লজ্জারাঙা বউকে বেশ লাগছে, স্মিত হাসল সে।

ঠিক গোধূলি লগ্নে অবনীর বাসায় গিয়ে পৌঁছল। দরজা খুলে নবদম্পতিকে দেখে প্রসন্ন হাসল অবনী। তাহিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ ওমা! তোকে তো একেবারে বউ বউ লাগছে।

তাহিয়া লাজুক হাসল শুধু। নীলিমা এসে আগলে নিলেন,
‘ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোকে, আয় ভেতরে বসবি। ‘ পুত্রবধূর গায়ে তার দেয়া শাড়ি গহনা দেখে মনে শান্তি বিরাজ করল।

তাহিয়া নিজ থেকেই বলল, ‘আঙ্কেল কোথায়? উনার সাথে দেখা করে যাই?’
‘বসার ঘরে, আয়।’ নীলিমা পুত্রবধূকে নিয়ে গেলে সেখানে।

রেজাউল আহমেদকে দেখেই প্রসন্ন হেসে সালাম দিল তাহিয়া। বাবার মৃত্যুর পর নীলিমার সাথে প্রায় যেতেন বাসায়। তাহিয়াকে ঘুরতে নিয়ে যেতেন, হরেক খেলনা কিনে দিতেন, নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। এই মানুষটাকে প্রিয়দের তালিকায় তুলেছে ছোটোবেলাতেই। তার কয়েক বছর পর থেকে কাজের ব্যাস্ততায় আসা হয় না। কালেভদ্রে দেখা হয়। দেখা হলেই ‘মা’ ডেকে কথা বলেন। শুনে তাহিয়ার মনটা স্নিগ্ধ হয়ে আসে।

রেজাউল আহমেদ, তাহিয়াকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আনন্দিত গলায় বললেন,
‘কেমন আছিস, মা?’
‘ভালো। আপনি ভালো আছেন?’ সুমিষ্ট হেসে বলল তাহিয়া।
রেজাউল আহমেদ হাসলেন,
‘আছি ভালো। তা তুই তো এখন আমার ছেলে বউ হয়ে গিয়েছিস। তোকে এখন ‘তুই’ করে সম্বোধন করলে তোর আপত্তি টাপত্তি থাকবে না তো!’

শব্দযোগে হাসল তাহিয়া, ‘না, আপনি ‘তুই’ তেই থাকুন। আমার কোন আপত্তি টাপত্তি থাকবে না।’

শ্বশুরের সাথে আলাপ শেষে নীলিমা পুত্রবধূকে অবনীর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই যখন ওকে ‘অভীকের বউ’ সম্বোধন করছিল, তখন তাহিয়ার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। তাহিয়াকে অবনীর শোবার ঘরে বসিয়ে নীলিমা চলে গেলেন। অভীক এলো খানিক বাদে। তখনো রুমে কেউ ছিল না। এসে আলতো স্বরে বলল,
‘আমি বসার ঘরে আছি। কোন সমস্যা হলে বা কিছু লাগলে বলবে। সরাসরি বলতে না পারলে ম্যাসেজ দিবে। ঠিক আছে?’

তাহিয়া সায় জানাল। অভীক চলে গেল বসার ঘরে। খানিক বাদে নীলিমা এসে নাস্তা দিয়ে গেলেন। তার দেখা মিলল না আর। সময় বাড়ার সাথে সাথে অতিথি আসতে শুরু করল। অবনীদের চারবেডের ফ্ল্যাটটায় কম হলেও পঞ্চাশজন মানুষের উপস্থিতি দেখা গেল । সবাই অবনীর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়। অবনীর রুমেও মানুষভর্তি হলো। সবাই অপরিচিত। অচেনা লোকের ভীড়ে পড়ে রইল এক কোণে।

ছোটো বাচ্চাদের চেঁচামেচি, মহিলাদের উচ্চৈঃস্বরে বলা কথা, হলরুমের সাউন্ড বক্সে বাজানো গানের আওয়াজ, সব একসাথে হয়ে ধাক্কা খেল তাহিয়ার মাথায়। চশমাটা ও পরেনি, যার ফলে মাইগ্রেন এসে হানা দিতে সময় লাগল না। ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে গেল। অবনী আর নীলিমা ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে, অভীক বসার ঘরে বসা। অসুস্থতার পাশাপাশি একাকিত্ব এসে হানা দিল তাহিয়ার মাঝে। অথচ রুমটায় বিশ ত্রিশজন মানুষ উপস্থিত। তবুও সে একা, এই অচেনা সমাজে আপন কেউ নেই তার।

আসার সময় মাহমুদা বারবার সতর্ক করেছে, ‘ বেশি এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবি না। এক জায়গায় বসে থাকবি। আর ঘোমটা টেনে রাখবি মাথায়। ‘ মায়ের কথামাফিক লম্বা ঘোমটা টেনে সঙ্কোচিত হয়ে বসে আছে তাহিয়া। উঠতেও পারছে না। শাড়ি গহনায় দমবন্ধ হয়ে আসছে। তাহিয়ার কান্না পাচ্ছে। একরাশ অসহায়ত্ব ঘিরে ধরল ওকে। অভীকের ম্যাসেজ এলো খানিক বাদে।
‘সব ঠিকঠাক? কোন সমস্যা হচ্ছে না তো!’

প্রাণ ফিরে এলো যেন তাহিয়ার। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো অভীক তার আপন মানুষ। এই মানুষটাকে বলা যায়। সে দূর্বল হাতে লিখল,
‘আমার ব্যাগটা এনে দিবেন?’

অভীকের বার্তা এলো তৎক্ষনাৎ,
‘তা না হয় দিব। কিন্তু কোন সমস্যা হয়েছে?’
‘মাথা ব্যাথা করছে। চশমাটা লাগতো।’

অভীকের বার্তা এলো না আর। মিনিট খানেক পর স্বয়ং হাজির হলো ও। চারদিক চোখ বুলিয়ে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা তাহিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল। মেয়েটা এতক্ষণ এভাবে বসে আছে!

কাছে গিয়ে ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এভাবে বসে না থেকে আমাকে বলতে পারতে। মহিলা মন্ডলে পুরুষদের আসা যাওয়া বেমানান, তাই আসতে পারিনি। তোমার ম্যাসেজের অপেক্ষায় ছিলাম।’

তাহিয়া তড়িঘড়ি করে চশমা পরে নিল চোখে। চশমা ভেদ করে চোখ তুলে তাকাল সে। চোখজোড়া জলে টইটম্বুর। মাশকারা ছোঁয়ানো পল্লব পানিতে মাখা। অভীক সচেতন চোখে পুরো ব্যাপারটা পরখ করল। তারপর উদ্ধিগ্ন স্বরে বলল,
‘ বেশি ব্যাথা করছে?’

তাহিয়া ইতিবাচক মাথা নাড়াল। অভীক চারদিকের কোলাহল পরখ করে বলল,
‘এই কোলাহলে থাকলে মাথা ব্যাথা বাড়বে বৈ কমবে না। উঠে এসো।’

‘কোথায়? বাসাভর্তি মানুষ। এত মানুষের ভীড়ে কোথায় যাব?’ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল তাহিয়া।
অভীক বলল,
‘নিরিবিলি জায়গার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি শুধু রুম থেকে বের হও। ‘

তাহিয়ার হাত ধরে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে যেতে নিল অভীক। দরজায় দেখা হলো অবনীর মামী শ্বাশুড়ির সাথে। অভীকের সাথে তাহিয়াকে দেখে বললেন,
‘কে?’
‘আমার ওয়াইফ।’ সরল স্বীকারোক্তি অভীকের। তাহিয়ার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল আকস্মিক। মনের কোথাও ভালো লাগার জন্ম নিল।

তাহিয়াকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো অভীক। বাসার সামনে দাঁড় করিয়ে গেল নিচে। ফার্মেসি থেকে ওষুধ আর মুদি দোকান থেকে পানির বোতল নিয়ে এলো। বোতলের ক্যাপ খুলে তাহিয়ার হাতে দিল, ওষুধটা অবধি খোসা ছাড়িয়ে দিল। তাহিয়া চোখে দুহাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে, আঙুলের ফাঁকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে অভীকের দিকে, অভীকের উদ্ধিগ্নতা দেখছে অবাক চোখে। লেকচারার হিসেবে গম্ভীর হলেও স্বামী হিসেবে মানুষটা প্রাণবন্ত, যত্নবান।

ওষুধ খাওয়ার পর তাহিয়া বাসায় ফিরতে নিল। অভীক বলল,
‘ ছাদে যাব, আসো।’

দ্বিরুক্তি না করে অভীককে অনুসরণ করল তাহিয়া। ছাদে পা রাখতেই এক ফালি নির্মল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিল তাহিয়াকে। আঁধারি নিস্তব্ধতা চেয়ে আছে ছাদটায়। আশপাশের বিল্ডিংয়ের জানালা ভেদ করে ক্ষীণ আলো এসে পড়ছে এক কোণে। তাহিয়া রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এখন আর আওয়াজ কানে বাড়ি খাচ্ছে না।

অভীক ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করে নিঃশব্দে পুরো ছাদে হাটছে। তাহিয়া ভ্রু কুঁচকাল। কী খুঁজছে লোকটা!

হাটা থামিয়ে এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল অভীক। তাহিয়ার দিকে আলো ফেলে বলল,
‘এদিকটায় এসো।’

তাহিয়া নিঃসঙ্কোচে গেল সেদিকে। গুছিয়ে রাখা গোটা বিশেক ইট রাখা। উচ্চতা হাটু অবধি হবে, প্রসস্থতায় একজন মানুষ বসা যাবে। অভীক ইটের উপর আলো ফেলে বলল,
‘এখানে বসতে পারবে?’

তাহিয়া ভালো করে দেখে বলল,
‘ময়লা না?’

অভীক পকেট হাতড়ে একটা টিস্যু বের করল। ইটের উপর বিছিয়ে দিয়ে বলল,
‘এখন ছাদে কেউ আসবে না। ঘোমটা ফেলে নিঃসঙ্কোচে চোখ বন্ধ করে বসে থাকো। ব্যাটার ফিল করবে।’

‘আপনি?’

‘তুমি বসো। আমার দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে।’

আলতো স্বরে বলল অভীক। অথচ তাহিয়া স্পষ্ট খেয়াল করেছে, লোকটা ক্লান্ত। পাঁচ তলা বেয়ে উঠানামা করেছে দু’বার। শুধুমাত্র বসার জায়গা না থাকায় বসছে না লোকটা।

বাবা ছিল না, মা’ই একা মানুষ করেছে তাকে। মায়ের মতো কেউ তার সুবিধা অসুবিধার সুক্ষ্ম খেয়াল রাখেনি। তার অসুস্থতায় মায়ের মতো কাউকে উদ্ধিগ্ন হতে দেখেনি সে। এই সন্ধ্যায় প্রথম খেয়াল করল মা ছাড়া কারো চোখে তার জন্য উদ্ধিগ্নতা, ভাবুকতা, যত্নাভাব। যা তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি মায়ের মতো আগলে রাখার কেউ আছে তোমার। যে কি না নিজের মানুষ, একান্ত আপন মানুষ। ফোনের মৃদু আলোয় অভীকের মুখপানে চেয়ে কত কী না ভাবল তাহিয়া! চোখে নেই ভয়, জড়তা।
অভীক হয়তো ঘূর্ণাক্ষরে ও টের পাবে না তার এই উদ্ধিগ্নতা তাহিয়ার মনে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলেছে, কতটা স্থান দখল করেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here