বিবর্ণ-৬ষ্ঠ পর্ব

0
770

বিবর্ণ-৬ষ্ঠ পর্ব
#লেখনীত_শাহরিয়ার

বাচ্চা গুলোর সাথে যে কিভাবে সময় কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না। সন্ধ্যার দিকে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসবো তখন জাহাঙ্গীর ফুলের তোড়া থেকে একটা একটা করে ফুল বের করে ওদের হাতে দিলো। আর সর্বশেষ বেলী ফুলের মালাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এটা আপনার জন্য। এতো ভালো লাগা কাজ করছিলো ফুলের মালাটা হাতে নিয়ে। তা বলে বুঝাতে পারবো না। দু’জন হেঁটে বড় বিল্ডিংটার সামনে এসে আবার রিক্সা নিলাম। জাহাঙ্গীরকে ধন্যবাদ জানালাম।

জাহাঙ্গীর: ধন্যবাদ কেন?

এই যে এতো সুন্দর একটা বিকেল আমাকে উপহার দিয়েছেন বলে।

জাহাঙ্গীর: হেসে প্রতিটা বিকেলই সুন্দর যদি আমরা তা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখি। শুনুন বাসায় এভাবে বসে থাকলে মন খারাপ হবে আপনি বরং কোথাও জবের জন্য ট্রাই করুণ। কোন কিছুতে ব্যস্ত থাকলে মন ও ভালো থাকবে।

ঠিক জানি না কতটা সফল হবো তবে আমি চেষ্টা করবো।

জাহাঙ্গীর: হুম আগে চেষ্টা করুণ তারপরেরটা তার পর হবে।

দু’জন টুকটাক কথা বলতে বলতে রিক্সা চলে আসলো আমাদের বাড়ির কাছে সেই মোড়ে। দু’জন রিক্সা থেকে নেমে রিক্সা বিদায় করে দেয়া হলো। এরপর দু’জন হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে হুট করেই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তার নাম্বারটা চেয়ে বসলাম। জাহাঙ্গীর হাসি মুখেই নিজের নাম্বারটা দিয়ে দিলো।

দু’জন দু’জনের বাড়িতে চলে আসলাম। আমাকে ভালো ভাবে বাসায় ফিরতে দেখে মা যেন হাঁপপ ছেড়ে বাঁচলো।

মা: ভালো হয়েছে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিস তোর বাবা এসে না দেখলে চিল্লাচিল্লি করা শুরু করে দিতো। ছেলেটা দেখতে কেমন রে?

মা কি সব প্রশ্ন করছো আমি কি বিবাহের জন্য পাত্র দেখতে গিয়েছিলাম নাকি? আর তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। তবে যদি প্রশ্ন করো ছেলেটার মন মানুষিকতা কেমন তবে এক কথায় অসাধারণ একজন মানুষ।

মা: একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডিভোর্স হয়েছে বলে কি আর কখনো বিয়ে হবে না। তাছাড়া তোর বাবা বলেছে ভালো ছেলে পেলেই তোকে বিয়ে দিয়ে দিবে।

মা মাত্রইতো কয়েকদিন হলো ডিভোর্সের। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। বিয়ে সংসার সব কিছুইতো করে দেখেছি। এখন আর এসবে টানে না আমাকে। তোমাদের কি একটা মেয়েকে বসিয়ে খাওয়াতে খুব অসুবিধা হচ্ছে?

মা: তা কেন হবে? কিন্তু লোকজন নানান রকম কথাবার্তা বলছে। আর ডিভোর্স হলেই কি মেয়েরা আর বিয়ে করে না? জীবনটা ঠিক যতটা ছোট মনে করিছ ঠিক ততটা ছোটও না। প্রতিটা দিন মানুষেে কথা শুনে কাটানো অনেক কষ্টকর। সমাজের মানুষ প্রতিটা মুহুর্তে তোর উপর আমাদের উপর আঙ্গুল তুলে কথা বলবে।

বলতে দাও মা। এক সময় দেখবে তারা আর কথা বলছে না। যত আগ্রহ দেখাবে মানু্ষের কথায়। তারা সে বিষয় নিয়ে ততই আলোচনা করবে। তাই মানুষের কথা আগ্রহ নিয়ে শোনা থেকে বিরত থাকো। তাহলে দেখবা এক সময় আর তারা সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।

মা: তোর যা কথা। মানুষের মুখ কি কখনো বন্ধ করা যায় এভাবে? তারা নতুন নতুন ইসু তৈরি করবে। সরাসরি আমাকে না বললেও দেখবি এর ওর কাছে বলে বেলাবে।

যারা বলার তারা বলবেই আর যারা শোনার তারাই শুনবে। তাই বলি তাদের হিসেব বাদ দাও। তুমি যদি নিজের জায়গায় অটুট থাকো তাহলে দেখবে তাদের কথা এক সময় ঠিকই বন্ধ হয়ে যাবে।

কথাটা বলে হাঁটা শুরু করলাম। আমি জানি যত কথাই বলি না কেন। মা একের পর এক যুক্তি দিতেই থাকবে। মা বলে কথা তারা সব সময় সন্তানের ভালো চাইবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন শাকিলের পরিবার। শাকিল এতো এতো অপরাধ করে বা করেছে তবুও পরিবারের পুরো সাপোর্ট তার সাথে রয়েছে। সব চেয়ে বড় কথা শাকিল পুরুষ মানুষ তাই একটু বেশীই সাপোর্ট পেয়েছে হয়তো। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হতেই জাহাঙ্গীরের দেয়া ফুলের মালাটা হাতে নিয়ে তারপর তা খোঁপায় পরে নিলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করতে করতে একটা সময় জাহাঙ্গীরের নাম্বারে ফোন দিয়েই দিলাম। রিং বাজতেই ফোন রিসিভ হলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। নিরব বসে আছি ফোন কানের সাথে লাগিয়ে।

জাহাঙ্গীর: কি ব্যাপার ফোন দিয়ে চুপ করে আছেন কেন? কিছু কি বলবেন? আচ্ছা না বললেও সমস্যা নাই আপনি রাতে ছাদে চলে আসুন সেখানেই কথা হবে।

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আপনি আমাকে কি করে চিনলেন?

জাহাঙ্গীর: হাসতে হাসতে আপনার নিরবতা থেকে।

আচ্ছা ঠিক আছে রাতে তবে ছাদে আসছি। আচ্ছা কয়টা বাজে আসবো?

জাহাঙ্গীর: আপনার যখন মন চায় আসবেন। আমি থাকবো,

কথা বলে ফোন রেখে দিয়ে রুমের বাহিরে আসতেই দেখি বাবা এসেছে। বাবা রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আসার পর কিছু সময় সকলে মিলে গল্প করে রাতের খাবার খেয়ে যার যার রুমে চলে আসলাম। রাত এগারোটার দিকে যখন সকলে নিজেদের রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছে তখন আমি আস্তে করে নিজের রুমের দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম। আস্তে করে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আসলাম। পাশের ছাদেই জাহাঙ্গীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি যেতেই জাহাঙ্গীর বলে উঠলো কেমন আছেন?

এইতো ভালো আপনি কেমন আছেন?

জাহাঙ্গীর: হুম ভালো। এতো রাতে ছাদে আসলেন কেউ দেখলে কিছু মনে করবে না?

করলে করবে তাতে আমার কি আমি এখন কাউকে পরোয়া করি না। বলেই হেসে দিলাম। জাহাঙ্গীর ও আমার সাথে হাসতে শুরু করলো।

জাহাঙ্গীর: আপনার দেখি অনেক সাহস হয়ে গিয়েছে।

কেন আমাকে আপনার ভিতু মনে হয়? আপনি কি জানেন যারা আত্মহত্যা করতে যায় তারা অনেক সাহসী। ভিতুরা আত্মহত্যা করার সাহস পায় না।

জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছেন। ভিতুরা কখনোই আত্মহত্যা করার মত সাহসী নয়। কিন্তু আপনিতো লোকলজ্জার ভয় পান খুব আমি সেটাই বুঝাতে চেয়েছি।

হুম কিছু দিন আগেও পেতাম কিন্তু এখন আর পাইনা। আসলে আপনি আমাকে সাহসী করে তুলেছেন এই বিষয়টাতে।

জাহাঙ্গীর: এটা ভুল আমি শুধু আপনাকে বুঝাতে চেয়েছি আপনি চাইলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। আসলে কি জানেন মানুষকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয়। তবেই জীবন সুন্দর হয়ে উঠে।

জ্বি একদম ঠিক কথা। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি রাগ করবেন নাতো?

জাহাঙ্গীর: না রাগ করবো কেন আপনি জানতে চাইতেই পারেন।

না আসলে আপনি কি কাউকে ভালোবাসেন। না মানে কারো সাথে রিলেশন আছে কিনা এই টুকুই।

জাহাঙ্গীর: উদাস হয়ে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে। হুম একটা সময় ছিলো যখন আমি কাউকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসতাম। কিন্তু আল্লাহ হয়তো চায়নি সে আমার হোক। তাই সে ঐ দূর আকাশের তারা হয়ে গিয়েছে।

সরি আসলে না জেনে না বুঝে আমি আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম।

জাহাঙ্গীর: না না ঠিক আছে। আসলে বাস্তবতা খুব নির্মম। পৃথিবী ছেড়ে আমাদেে সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে দু’দিন আগে আর দু’দিন পরে। আর আমি আমার আল্লাহকে বিশ্বাস করি। আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য সব সময় উত্তম চিন্তাই করে রেখেছেন।

দীর্ঘ সময় দু’জন কথা বলে একটা সময় জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নিজের রুমে চলে আসলাম। একটা মানুষ বুকের ভিতর পাথর চাপা দিয়ে কত সুন্দর হেসে কথা বলে। কাউকে বুঝতেই দেয়না তার বুকের মাঝেও লুকিয়ে রয়েছে না বলা কত কষ্ট দুঃখ, তা জাহাঙ্গীরের সাথে পরিচয় না হলে আমি জানতেই পারতাম না।

পরদিন সকাল থেকেই শুরু করলাম পুরনো বন্ধু বান্ধবীদের ফোন দেয়া। যদি কোথাও একটা চাকরি পাওয়া যায়, তাহলে সত্যি সত্যিই হয়তো জীবনটা ঘুরে দাঁড়াবে। কেউ কেউ আমাকে বিভিন্ন অফিসের ঠিকানা দিলো। কেউ কেউ বললো ভালো জবের অফার আসলেই জানাবে। আবার কেউ কেউ আমার ডিভোর্সের বিষয়টা নিয়ে খোঁচা মেরেও কথা বলতে ছাড়লো না। আমি সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বললাম। আর নিজের কষ্টটা নিজের মাঝেও লুকিয়ে রাখলাম। আসলে বিপদে না পরলে আসল বন্ধু কারা তাদের তো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কথায় বলে বিপদেই আসল বন্ধুর পরিচিয়।

দুই তিন জায়গায় ইন্টার ভিউ দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরে তখন আমি ছাদে চলে আসি বেশ লম্বা একটা সময় নিয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করি। সারা দিন কি করলাম দিনটা কেমন গেলো সব কিছুই দু’জন দু’জনের সাথে শেয়ার করি। আসলে অল্প পরিচয়েও কেমন করে জানি জাহাঙ্গীর আমার খুব ভালো বন্ধ হয়ে গেলো। এখন জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা না করলে কথা না বলতে পারলে কেমন জানি ছটফট লাগে। যে কোন সময় খুব খারাপ লাগলেই জাহাঙ্গীরকে ফোন করি। অল্প সময়ের ভিতর জাহাঙ্গীর আমার মন ভালো করে দেয়। সত্যিই অসাধারণ একটা মানুষ সে।

দেখতে দেখতেই একটা মাস কেটে গেলো, কোথাও থেকে চাকরির কোন খোঁজ আসলো না। আমি আবারও কিছুটা ভেঙ্গে পরছিলাম। কারণ চাকরির ইন্টারভিউয়ের বদলে যখন জানতে পারে আমি ডিভোর্সি অনেকেই আমার শরীরের দিকে লোভার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। মাঝে মাঝে আমার শরীরেও হাত দিতে চায়। চেয়ে আমি কথা গুলো জাহাঙ্গীরকে বলতে পারি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাদের গালে কষে কিছু থাপ্পর লাগিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে। কিন্তু নারী বলে চাইলেও সব কিছু পেরে উঠি না।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here