❝মোহ মেঘের আলাপন ❞ লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো” [১৯]

0
317

❝মোহ মেঘের আলাপন ❞
লেখিকা: “নূরজাহান আক্তার আলো”
[১৯]

আমান! আমান! এ্যাই আমান, দরজা খুল!

হঠাৎ রুমের দরজায় কড়াঘাত পড়াতে আমানের ঘুম ভেঙে যায়।বার দু’য়েক অস্পষ্টভাবে হু হু করে পুনরায় ঘুমে তলিয়ে যায় সে। কিন্তু আবারও শক্ত হাতের বারি পড়ে ওর দরজায়।
এবার সে প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে। মুখে ‘ চ ‘ শব্দ করে চোখজোড়া খুলতে চেষ্টা করে। ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে। দরজাটা খুলে দেখাটা তার জন্য দায় হয়ে পড়েছে। অসহ্য ব্যথায় শান্তি পাচ্ছিল না একদন্ডও। শরীর যেনো অবশ হয়ে
যাচ্ছিলো। নড়েচড়ে বসতে পারছিলো না ঠিকমতো। এজন্য ব্যথার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলো। আর ওষুধের প্রভাবে এখন ঘুমে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। মাথাটাও ধরেছে।
মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না কে ডাকছে, কেন ডাকছে, উঠে গিয়ে তা দেখতে। তখন উক্ত ডাক পুনরায় তার কানে পৌঁছালো।
দুমদুম কড়াঘাতও চলছে তখনো। না আর বসে থাকাটা ঠিক হবে না। একথা ভেবে উঠে দরজা খুলতেই মায়ের মুখ দেখে হাসলো। অতঃপর কিছু বলার আগেই সীমা বেগম বললেন,

-”আদিত্য এক্ষুণি তোমাকে ডাকছে ওর রুমে যাও।”

-”কেন?”

-”জানি না। শুধু বললো কথা আছে তোমাকে ডেকে দিতে।”

-”একটু পরে যাই আম্মু? শরীরটা ভীষণ খারাপ আমার। ”

-”জরুরি না হলে আদিত্য নিশ্চিয়ই তোমাকে ডাকতো না। কী বলে শুনে এসো। এমনিতেই ওর মন মেজাজ ভালো নেই।”

-”মেধার কোনো খোঁজ দিয়েছে পুলিশ?”

-“না, তবে শীঘ্রই দিবে ইনশাআল্লাহ।”

-”ভাইয়া কিছু খেয়েছে? জ্বর এসেছিলে তা কমেছে?”

-”জ্বর কমেছে তবে কফি ছাড়া কিচ্ছু টি মুখে তুলে নি। ”

-”ওহ আচ্ছা তুমি যাও, আমি গিয়ে দেখি কী বলে।”

একথা বলে আমান আদিত্যের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আর সীমা বেগম চলে গেলেন নিজের কাজে। মনটা ভীষণ খারাপ উনার। বাসাটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। মেধার হাসি কানে বিঁধছে না। চঞ্চল পায়ে এসে হাত ধরে টেনে বাগানের সদ্য ফোটা ফুল দেখাচ্ছে না। না খাওয়ার বাহানা দিচ্ছে না।
চুলে বিলি কেটে দেওয়ার জন্য পেছন পেছন ঘুরছে না। হুট করে এসে হাও করে চমকে দিয়ে খিলখিল করে হাসছে না।
আদিত্যের বাবার পাকা চুল তুলে দিয়ে টাকার হিসাব নিয়েও ঝগড়া করছে না। প্রয়োজনীয় জিনিস না পেয়ে বাড়ি মাথায় তুলছে না। এত নিশ্চুপ বাসা উনি চান নি। উনি সবসময় চান উনার বাসা হাসি, খুশি, সুখে, ভরে থাকুক। কিন্তু বাসার হাসি যেনো হঠাৎ হারিয়ে গেছে, মলিন করে দিয়েছে চারিপাশ।
একথা ভেবে উনি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন।মেধার বাবাকে
কথা দিয়েছিলেন মেধাকে যত্নে রাখবে। ছোট বোনের শেষ স্মৃতিটুকু আজীবন নিজের কাছেই রাখবে। কিন্তু হলো কই?
দমকা এক ঝড়ে সব যে উলট পালট গেল। সুখপূর্ণ সংসারে
এখন সুখের অভাব। ওদিকে আদিত্যের দিকে তাকানো যায় না। ছেলেটার মুখ দেখলেই বুক ফেটে যায়। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে।তাছাড়া উনি অবগত আদিত্য মেধাকে ভীষণ ভালোবাসে।মুখচোরা স্বভাবের আদিত্য নিগূঢ় ভালোবাসার প্রকাশ করতেও পারে না ঠিকমতো। তবে তার ভালোবাসায় খাত নেই আর না আছে স্বার্থের নির্মোক। ছেলেটা শুধু অতি গোপনে ভালোবাসতে জানে, আগলে রাখতে জানে। মেধার কষ্টের নিজেকে পুড়াতে জানে। উনি আর ভাবতে পারছেন না। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠেছে উনার। চোখের পানিতে
রাস্তা দেখতে না পেয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। মুখে আঁচল গুঁড়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। সেই সঙ্গে একটা কথায় বার বার বলে যাচ্ছেন,
”মেধা মা আমার ফিরে আয়, মা। তোকে ছাড়া আমরা ভালো নেই। তোর আদিত্যও ভালো নেই রে,, একটুও ভালো নেই।”
একথা ভেবে সেখানে বসেই অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকলেন।
সহধর্মিণীর মনের কথা বুঝে আদিত্যের বাবার নেত্রেও অশ্রু
জমা হলো। মেধাকে উনি নিজের মেয়ের মতো দেখেন, খুব ভালোওবাসেন। এখন অবধি উনি সীমা বেগমকে বলেন নি, একটা রাজকন্যার ভীষণ শখ উনার। যে রাজকন্যা নেচে গেয়ে পুরো বাসা দাপিয়ে বেড়াবে। কত কী আবদার করবে উনার কাছে। মনমতো জিনিস না পেলে নাক ফুলাবে, ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিবে। আরো কত কী!আদিত্য আমান হয়ে সীমা বেগমের জটিল সমস্যার কারণে উনাকে জরায়ু অপসারণ করতে হয়েছিলো। ফলে চিরতরে মাতৃত্ব হারান সীমা বেগম।
একথা শুনে যদি সীমা বেগম ভেঙ্গে পড়েন, কষ্ট পান, তাই কখনো রাজকন্যার কথা বলাও হয় নি। তবে উনার এই শখ পূরণ হয়েছে মেধার মাধ্যমে। মেধা এমন একটা মেয়ে সবাই দেখে বলবে ভীষণ ভদ্র। তবে সে ভীষন চঞ্চল, দুষ্টু প্রকৃতির। আর ওর চঞ্চলতায় সবাইকে বাধ্য করে ভালোবাসতে। মেধা নিঁখোজ হওয়ার পর থেকে উনি নিজেও একদন্ড বসে নেই।
যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন খোঁজ নেওয়ার। বড় ছেলের মুখের হাসি ফিরিয়ে না দেওয়া অবধি উনি শান্তি পাচ্ছেন না।
বাবা হয়ে উনি সহ্য করতে পারছেন না ছেলের মলিন মুখ, অশ্রু ভেজা টইটম্বুর চোখ। হঠাৎ ফোনে কল আসাতে উনার এসব ভাবনার ছেদ ঘটলো। চোখ মুছে, গলা পরিষ্কার করে,
উনি কথা বলতে বলতে দ্রুত প্রস্থান করলো।

আদিত্য সদ্য গোসল সেরে রুমে এসেছে। হাতে থাকা ভেজা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছছে।ওর মুখভঙ্গি অত্যান্ত স্বাভাবিক।
তখন দরজায় নক পড়াতে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো।
সে অবগত আমান এসেছে। তখন আমান খুঁড়িয়ে হেঁটে রুমে প্রবেশ করলো। আদিত্য তাকে বসতে বলে নিজে গিয়ে কফি করে আনলো। ততক্ষণ আমান বসে গেম খেলায় মনোযোগী হলো। একটুপরে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে আদিত্য ফিরে এলো।একটা মগ আদিত্য নিজে নিয়ে অন্যটা এগিয়ে দিলো আমানের হাতে। তারপর আমানের মুখোমুখি বসে কফিতে চুমুক দিলো। ব্ল্যাক কফি! ওর দেখে আমানও সিপ নিয়ে মুখ কুঁচকে চুপ করে বসে রইলো। কারণ ব্ল্যাক কফি তার ভীষণ অপছন্দ।
কিন্তু আদিত্য স্বাভাবিক ভাবে পান করতে থাকল। কারণ সে সর্বদা ব্ল্যাক কফিই পান করে। আমান মগটা সেন্টার টেবিলে রেখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে আদিত্যের মতিগতি। কিন্তু কিছুই বুঝলো না। এছাড়া
কেন জানি সাহসও পাচ্ছে না কিছু জিজ্ঞাসা করতে। এভাবে
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর আমান কিছু বলার আগে আদিত্য বললো,

-”এখন একটা কাজ করতে বলবো, করবি?

-”হুম বলো।”

-”একটা কারণে তোকে আমি দু’টো অপশন দিবো। আর এই দুটোর মধ্যে তুই একটা অপশন বেছে নিবি।”

-”কি কারণ ভাইয়া?”

-”অপশন গুলো বলি তাহলেই বুঝে যাবি।”

-”আচ্ছা বলো।”

-” প্রথম অপশন, এখন তোর সামনে আমি বিষ খাবো সেটা তুই বসে বসে দেখবি। না কাউকে ডাকতে পারবি আর না আমাকে বাঁধা দিতে পারবি। আর দ্বিতীয় অপশন, মেধার খোঁজ দিবি। ”

একথা শুনে আমান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। মানে কি?
এটা কোনো কথা? এর একটাও সে এখন করতে পারবে না।
তার হতভম্ব মুখ দেখে আদিত্য হাসলো। তারপর বললো,

-”বল কোন অপশনটা নিবি?”

-”একটাও না।”

-”কেন, আরো অপশন লাগবে?”

-”হুম।”

-”ওকে, তাহলে গুনে গুনে দশ মিঃ সময় দিলাম তোকে। এই
দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে যা মিথ্যে বলেছিস সবটা সুন্দর করে সত্য দিয়ে উপস্থাপন করবি। নয়তো কি হবে দশ মিনিট পরে বুঝবি।”

-”ক কি বলছো ভাইয়া? কোন মিথ্যের কথা বলছো? আর আমি তোমাকে মিথ্যে কেন বলবো? আমার অবস্থা দেখেও তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? তাছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কেউ মজা করে? সত্যি বলছি, আমি তোমাকে মিথ্যে বলি নি।”

আদিত্য আর একটু শব্দও করলো না। ইশারায় ঘড়ি দেখিয়ে কফিকে চুমুক দিলো। মাথার উপর দ্রুত গতিতে চলা সিলিং ফ্যানের বাতাসেও আমান ঘামছে। সে মিথ্যা বলে নি একথা বলে যেতে উদ্যত হতেই হাতে টান পড়লো। আদিত্য চট করে উঠে দরজা আঁটকে হকিস্টিক হাতে তুলে নিলো। আমানের এবার চোখ দু’টো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে দু’পা পিছিয়ে বার বার বলতে লাগল, ”সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না, সত্যিই জানি না আমি। ”

-”সত্যিই জানিস না?”

-”না।”

-”তাহলে তোর মুখ বাদে শরীরের আর কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই কেন? মেরে সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলো না তোকে?
আচ্ছা যে মেরেছে তার শরীরে শক্তি নেই নাকি তুই বিখ্যাত জাদুকর? যে জাদুর বলেই আঘাতের চিহ্ন রাতারাতি মুছে ফেলেছিস এমন কিছু?যা এটাও নাহয় বাদই দিলাম, তোরা নিঁখোজ থাকাকালীন তোর ফোনটা আমাদের পূর্বের বাসার লোকেশনে কেন? তাও আট ঘন্টা! মেধাকে আঁটকে তোকে নিশ্চয়ই বাসায় বিশ্রাম করতে পাঠিয়েছিলো না। নাকি তুই
অদৃশ্য হয়ে সেখান থেকে ঘুরে এসেছিলি? ফোন হারায় নি এটাও সিওর। কারণ ফোন বর্তমানে তোর কাছেই রয়েছে।
একটু আগে ফোনে গেমও খেলেছিস। আর কিডনাপারের নামটা কী যেনো বলেছিলি? ওহ হ্যাঁ, উদয়। তাকে কীভাবে চিনিস তুই?ও বাবা মায়ের থেকে উদয় নাম শুনেছিলি না?
আর সেখান থেকেই….! যা এসব কিছুবাদ দিলাম, এবার বল, বেধড়ক মার খেয়ে আধমরা হয়ে বাইক চালিয়ে বাসায় আসলি কীভাবে?”

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here