তোমাতে করিবো বাস💗
#পর্ব_১৫
লেখনীতে-আফনান লারা
.
বাপ্পি আর তটিনি মিলে চুপচাপ গাড়ীতে করে বাড়ি ফিরছে।বাপ্পি ভেবেছিল তটিনি আগামী কয়েকদিনেও কোনো কথা বলবেনা,বোবা হয়ে থাকবে।কিন্তু তার ধারণা ভুল করে দিয়ে তটিনি বলে উঠলো,’আমি বিসকুট চুবিয়ে চা খাবো,দুধ চা।টাটকা গরম দুধ চা,ধোয়াঁ ওঠা একেবারে।আর বিসকুটটা হতে হবে মেরি বেসকুট’
বাপ্পি গাড়ী থামিয়ে ফেলে ড্রাইভারকে বলে। মা বলেছিল কিছু মানুষ নাকি রাগ হলে খাবার বেশি করে খায়।তটিনিও হয়ত সেই লেভেলের।
তাই ওর কথামতন বাপ্পি কাছের একটা দোকানে গিয়ে চায়ের খোঁজ করলো।মুশকিল হলো দুধ চা নেই,আছে রঙ চা।
‘শোনো!রঙ চা খাবে?দুধ চা নেই তো’
‘আমার সর্দি লাগছে?কেন খাব রঙ চা?’
‘সর্দি লাগলেই খায় নাকি রঙ চা?আমি তো মন চাইলেই খাই’
‘আমি আর আপনি কি এক হলাম?আর কোনোদিন আমাকে রঙ চা সাধবেন না।বিরক্তিকর! ”
বাপ্পি ফের এসে গাড়ীতে বসে ড্রাইভারকে বললো সামনে কোনো দোকান দেখলে আবার থামাতে।
————
আসিফ রান্নাঘরের তাকে উঠে বসে বসে পা দুলাচ্ছে আর কমলা খাচ্ছে,রিনির কথামতন।
রিনি বাপ্পি আর তটিনির জন্য বানানো নাস্তা সাবাড় করছে বসে বসে।
কমলার খোসা ফেলে আসিফ বললো,’তোকে কাল সকালে বাড়িতে দিয়ে আসবো।কোনো কথা বলবিনা’
‘আঁই হরেরদিন চলি আইয়াম আবার😎'[আমি পরেরদিন চলে আসবো আবার’
‘থাপ্রাবো!বেয়াদবের মতন কথা বলবিনা।আমি তোর স্বামী হই।আমার আদেশ মানা তোর কর্তব্য ‘
‘স্বামী?কিচ্চেন?আঁর জামাই হই আন্নে আঁর লাই কিচ্চেন যে আন্নে জামাইর অধিকার চান অন??’
[স্বামী?কি করছেন?আমার জামাই হয়ে আপনি আমার জন্য কি করছেন যে আপনি জামাইর অধিকার চান এখন? ‘
‘ওমা গো!আবার কিছু করাও লাগবে?আমি কি চাকরি করি যে তোর জন্য কিছু করবো?শর্ত তো এটাই ছিল যে চাকরি পেলেই তোকে নিয়ে আসবো, তবে তুই আগে ভাগে এসে ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন?’
‘কারণ আঁর আর হত্তে হত্তে ভাল্লাগেনা আন্নেরে ছাড়া,
আঁই থাইকলে আন্নের লগেই থাইক্কাম ‘
[কারণ আমার আর একা একা ভাল লাগেনা আপনাকে ছাড়া। আমি থাকলে আপনার সাথেই থাকবো’]
———
সামনে কোথাও চায়ের দোকান পায়নি বাপ্পি।তটিনি মাথা ধরে এক পাশে মাথা হেলান দিয়ে চুপ করে আছে,কোনো কথা বলছেনা।বাপ্পি আর ওকে বিরক্ত করতে চায়নি,চুপ করে ছিল।দু ঘন্টার পথটা তাই খুব দপরি করে শেষ হয়েছে।তাও তারা কোনো কথা না বলেই বাড়ি পৌঁছে গেছে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ।বাড়ির গেইট অবধি আসতেই মানুষের গমগম শোনা গেলো।তটিনি ভয় পেয়ে থমকে গেছে।বকুল আপু বাগানেই ছিলেন ওদের অপেক্ষায়।তটিনিকে দেখে ছুটে এসে ওর মাথার ঘোমটার কথা জানতে চাইলেন।তটিনি বললো সে ওটা রুমেই ফেলে গেছে।তাই জলদি গিয়ে রুম থেকে ঘোমটা নিয়ে আসলেন উনি।ওটা তটিনিকে পরিয়ে এরপর বাড়িতে ঢোকালেন।ড্রয়িং রুমের এমন কোনো জায়গা বাকি নেই যেখানে মানুষ বসা নেই।সোফার হাতলেও কতজন বসে আছে।সবার চোখ তটিনির দিকে।তটিনি আসিফকে নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিল যার কারণে সে রোবটের মতন তাই তাই করছিল যা যা বকুল আপু করতে বলছিল।সবার মাঝে দাঁড়িয়ে সে সালাম দেয় আগে।এরপর বাপ্পির একটা কাজিন উঠে গিয়ে তটিনিকে সোফায় বসতে জায়গা করে দিলো।তটিনিকে ওখানে বসানো হলো।বাপ্পি তটিনিকে একা রেখে যেতে চায়নি বলে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেখছিল ওকে।
খালা,ফুফু,মামি,সবাই ঘিরে ধরে তটিনির ঘোমটা সরিয়ে কথা শুরু করেছে।তটিনি মাথার ব্যাথায় গালটা ফুলিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।সেইসময় বাপ্পির ফুফু ওর মামিকে বলছিল মেয়ে ওমন গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন।তখন বাপ্পির মামি বলে মেয়ে নাকি বিয়েতে রাজি ছিল না।এটা নিয়ে ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো।তখন বাপ্পি ওদের বুয়াকে ডেকে চা নিয়ে আসতে বলে,কারণ সে জানে তটিনির এই মূহুর্তে কি প্রয়োজন।তটিনি ওনাদের ফিসফিস সব শুনে আবার জোর করে হাসির চেষ্টা করছে।সবাই যে যার উপহার ওর হাতে ধরিয়ে আবার অন্য টপিক নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠেছে।বকুল তখন আপু তটিনির কাছে গিয়ে বললেন সে এখন রুমে যেতে পারে।ওমনি তটিনি উঠে চলে গেলো রুমে।
রুমে এসেই ঘোমটা টা খুলে আবারও ছুঁড়ে মারলো সে।এবারও সেটা বাপ্পির মুখেই পড়েছে।
‘আমি জানি তোমার মন খারাপ।কি করতে পারি বলো?’
‘চুপ করে বসে থাকেন’
এটা বলে তটিনি বিছানায় উঠে বললো,’লাইট বন্ধ করেন তো!আলো দেখলেই মেজাজ খারাপ লাগে’
বাপ্পি লাইট বন্ধ করে ধীরে ধীরে ডিভানে গিয়ে বসে।তারপরেই বকুল আপু বাপ্পির আর তটিনির জন্য বিকালের নাস্তার ট্রেটা নিয়ে এসে রুম অন্ধকার দেখে
ভাবলেন রুমে কেউ নেই,কিন্ত তার বেশ মনে আছে ওদের দুজনকে তিনি একসাথে রুমে ঢুকতে দেখেছিলেন।তবে গেলো কই?ট্রেটা এক হাতে রেখে অন্য হাতে অনেক কষ্টে রুমের আলো জ্বালালেন আপু।ওমা!!আলো জ্বালাতেই বাপ্পি তটিনি দুজনকেই রুমে দেখে আপু অবাক হয়ে বললেন,’একি রে!!তোরা দুজন এখানে আর আলো নেভানো কেন?এটা কোন ধরনের কারবার?’
‘আপু আমার না অন্ধকারে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল’
‘তোর এমন উদ্ভট ইচ্ছা হয়না সেটা জানা আছে আমার।বাড়িতে যে নতুন এসেছে তার মাথা থেকেই এমন উদ্ভত ইচ্ছা বের হতে পারে।যাই হোক!নতুন বউয়ের মুড সুয়িং হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।আমার ও বিয়ের পরেরদিন মেজাজ গরম ছিল।তার কারণ ছিল তোদের দুলাভাই আমায় চায়ের সাথে বিসকিট দেয়নি।আমি তো ভাই বিসকিট ছাড়া চা খেতেই পারিনা,সেই নিয়ে মেজাজ গরম ছিল।নতুন বরের উপর জোর খাটাতে কিছু মেয়ের আরাম লাগে তার মধ্যে আমি একজন ছিলাম।তটিনিও তাদের একজন।কিন্তু তটিনি তোমায় আবারও বলছি! আমার ভাইকে সিধা পেয়ে এত জোর খাটাইওনা।বাপ্পির একটা বাজে অভ্যাসের কথা জেনে রাখো।সে অতি সহজে রাগ করেনা এটা যেমন চরম সত্য তেমনই সে অতিরিক্ত কিছু হয়ে গেলে প্রচণ্ড রকমের রাগ করে।তার সেই রাগ গায়ের চামড়া উঠে হাতে চলে আসলেও যায়না।তাই বাপ্পিকে সীমার অধিক বিরক্ত করবেনা,হেনস্তা করবেনা।’
এই বলে বকুল আপু ট্রে রেখে চলে গেছে।তটিনি বাপ্পির দিকে তাকিয়ে বললো,’আমি ভয় পাই আপনাকে?আপনি যদি রেগেও যান তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।’
‘জানি আমি’
‘হুম।আর সবাই আমায় এত জ্ঞান কেন দিচ্ছে?আমার ইচ্ছা আমি কিভাবে বাকি জীবন চলবো।আমাকে কেন নিয়মের মধ্যে আটকে থাকতে হবে?’
‘থাকতে হবেনা।আমি তোমায় সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিব’
‘তা তো দেখছিই কেমন স্বাধীনতা দিবেন’
———-
আসিফ রিনির ব্যাগ গুছিয়ে ওকেও রেডি হতে বললো।কাল না গিয়ে আজই সে যাবে বলে ঠিক করেছে।রিনি শুরুতে না না করছে বলে আসিফ নিজেই সব করে নিয়েছে।বাসের টিকেট কেটে তটিনির মাকে ফোন করে বলে সে রিনিকে নিয়ে জোর করে বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।
রিনি বেশ অনেকক্ষণ যাবার জন্য জেদ করে যখন দেখে আসিফ মানছেনা তখন সে চুপ হয়ে যায়।একেবারে চুপ।
চঞ্চল,বাচাল মেয়েটি একেবারে চুপ হয়ে গেলো।কোনো কথা নেই তার মুখে।আসিফ তাকে নিরব দেখেও কোনো রিয়েকশান দেখায়নি,সে তার সিদ্ধান্তে অটল।
—–
‘আপা ঝালমুড়ি খাইবেন?’
বাসে ওঠা ঝালমুড়িওয়ালার কথা শুনে রিনি গাল ফুলিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে বললো,’এগিন আঁর লগের বেডা ইগার গাত ঢালি দেন উত করি🙂’
[এগুলা আমার সাথের লোকটার গায়ে উপুড় করে ঢেলে দেন’]
লোকটা হা করে তাকিয়ে আছে।আগাগোড়া কিছুই বুঝলোনা সে কিন্তু আসিফ ঠিকই বুঝেছে।সে দশ টাকার ঝালমুড়ি নিয়ে একা একা খাওয়া শুরু করলো রিনিকে দেখিয়ে দেখিয়ে।
আসিফ মরিচ বেছে বেছে ফেলছিল নিচে কারণ সে ঝাল খেতে পারেনা।হাত দিয়ে মরিচ ধরে সে হাত দিয়েই আবার ভুলে নিজের চোখ কচলে ফেললো।ওমনি জ্বালা পোড়া শুরু।
চোখে হাত দিয়ে আসিফ ছটফট করছিল।
রিনি ওর দিকে চেয়ে অবস্থা দেখেই বুঝে গেছে কি হয়েছে তাই সে নিজের ওড়নায় ফু দিয়ে আসিফের চোখে চেপে ধরলো চুপ করে।
এমন কয়েকবার করার পর আসিফের চোখের জ্বালা কমলো।দম ফেলে সে আবারও আগের মতন গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো
রিনিও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।লোকটার কাছে কৃতজ্ঞতা বলে কিছুই নেই।
———
তটিনি বাপ্পির রুমের জানালা খুলে মাথা ঠেকিয়ে নিচে বাগান দেখছিল।সেই বারান্দা দিয়ে আহামরি কিছু দেখা যায়না,দেখা যায় শুধু সবুজ ঘাস।তটিনি মনযোগ দিয়ে সেটাই দেখছিল।বাপ্পি কয়েবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গেছিল আসলে সে এতক্ষণ ধরে কি দেখছে।কিন্তু সে নিজেও সবুজ ঘাস ছাড়া আর কিছু দেখতে না পেয়ে চলে গেছে।ঘাসকে কেউ এমন মনযোগ দিয়ে দেখতে পারে তা ওর এই প্রথম জানা।অনেকক্ষণ যাবত ঘাস দেখতে দেখতে তটিনির নজরে আসলো সিগারেটের খালি প্যাকেট ঘাসের মাঝে পড়ে আছে।সে পেছনে তাকিয়ে বললো,’আপনি সিগারেট খান?’
‘নাহ’
‘মিথ্যে কেন বলছেন?আপনি ছাড়া আর জোয়ান কে আছে বাসায়?’
‘দুলাভাই খায়।হয়ত আজ যখন এসেছিল তখন খেয়েছে।কেন কি হয়েছে আবার?’
‘মদ খান?’
‘আমি যদি এগুলা খাইও,তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে?তাছাড়া আরেকটা কথা হলো, আমি যদি কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট ও করি তোমার কি তাতে কিছু যায় আসে?’
‘যায় আসে নাকি না আসে তাতে আপনার কি যায় আসে?আমার ইচ্ছা আমি প্রশ্ন করবো।ঠিকঠাক জবাব দেবেন নাহয় প্রশ্নটা আপনার মাকে গিয়ে করবো।বুঝতে পারছেন? ‘
চলবে♥