#আকাশেও_অল্প_নীল #পর্বঃ১২ #আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

0
470

#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ১২
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি

৩৩,
ব্রেকফাস্ট সেরে স্নেহার রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত। নক করে দরজায়। স্নেহা বিছানায় বসে ফোন দেখছিলো। দিগন্তকে দেখে ফোন রেখে বলে,

“আয় ভেতরে আয়।”

দিগন্ত রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

“তোর সাথে কথা ছিলো আপা। একটু আর্জেন্ট। ফ্রি আছিস?”

“হ্যাঁ, বোস এখানে।”

স্নেহা ইশারা করে তার পাশে বসতে। দিগন্ত স্নেহার পাশে গিয়েই বসে। স্নেহা দু পা ঝুলিয়ে বসে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“বল কি কথা?”

“বিয়ের আর বাকি আছে চারদিন। কেনাকাটা, আয়োজনের ব্যাপার স্যাপার আছে। আমি তো এতোদিক একা সামলাতে পারবো না। ফুফু আর চাচ্চুকে আসতে তো বলে দিয়েছি। উনারা বুধবার আসতে চেয়েছে। বিয়েটা যেহেতু তোর, বিয়ে নিয়ে তো সব মেয়েরই ছোটোখাটো স্বপ্ন থাকে। তোর স্বপ্ন গুলো যদি বলতি, তো আমি সেই অনুসারে আয়োজন করতাম।”

স্নেহা মুচকি হাসে ভাইয়ের চিন্তা দেখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“বড্ড বড় হয়ে গেলি, এতো তাড়াতাড়ি! আমার ছোট্ট ভাইয়ের মাথায় কতো শতো চিন্তা আমায় নিয়ে। সময় কতো দ্রুত চলে যায় তাইনা! একদিন তোকে নিয়ে আমি চিন্তা করতাম, এখন তুই আমায় নিয়ে চিন্তা করিস। তুই বড় হলি কেনো বলতো? সেই ছোট্টটি থাকতি, তোকে আকড়ে থেকে যেতাম নিজের বাড়িতে। কিন্তু ঐ যে হয়েছি মেয়ে, বাবার বাসায় আজীবন থাকার নিয়মটা নেই।”

দিগন্ত বোনের কথাগুলো শুনে একটু দুর্বল হয়ে পরে। বুকের মধ্যে কেমন একটা মোচর দিয়ে উঠে। আর পাঁচটা দিন, এরপর ফজরে কেউ তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নামাজ পড়তে বলবেনা, নাস্তা বানিয়ে টেবিলে ডাকবেনা। দুপুরে কেউ স্কুলে লাঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে কাজের প্রেশার দেখলে বকা দিয়ে খাইয়ে আসবেনা, রাতেও তো কেউ ডিনার সাজিয়ে অপেক্ষা করবেনা। রাতে ঘুম না ধরলে কেউ এসে বলবে না, তোর মন খারাপ! আয় মন ভালো করে দিই! কারোর কোলে মাথাও রাখা যাবেনা। পুরো একটা বাসা, সে একা থাকবে। ইশ কি নিদারুণ যন্ত্র’ণা। এই যন্ত্র’ণা মেনে নেওয়া যায়! তার একাকিত্বের জীবনে মেঘ শেষে বর্ষণ হয়েও কেউ নামবে না। আচ্ছা যেই বোন মায়ের পরের স্থানে থাকে, তাকে কেনো মায়ের মতো সাথে রাখা যায় না! দিগন্ত আর ভাবতে পারলো না। বোনকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। স্নেহা অবাক হলো দিগন্তকে কাঁদতে দেখে। সেই ছোট্টবেলায় মা যখন ছেড়ে গিয়েছিলো! মায়ের আঁচল টেনে কেঁদে মাকে বলেছিলো, যেয়ো না মা। এরপরও যখন মা চলে গেলো, দিগন্ত সেদিন থেকেই কেমন একটা গম্ভীর হয়ে থাকতো! বাকি ১০টা সাধারণ বাচ্চার মতো হাসতো না, খেলতো না। চুপচাপ থাকতো, কাঁদতোও না। কখনও অসুস্থ হলে যেখানে বাচ্চা ছেলেরা কেঁদে মা’কে খুজে, দিগন্ত তখনও কাদতো না। হয়তো সে বুঝে গিয়েছিলো, কাদলেও আর মা আসবেনা। সেই ছেলে আজ কাঁদছে! মানতে একটু কষ্টই হচ্ছে স্নেহার। স্নেহা ছোটো থেকে বড়ো হয়েছে বাবার তাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে করা লড়াই দেখে আর ভাইকে আদরে আকড়ে রাখার লড়া’ই করে। বয়সটা তখন কম থাকলেও কষ্টের সময় গুলো মানুষ বেশি মনে রাখে, সেই নিয়মের স্রোতে স্নেহারও প্রতিটা কষ্টের জার্নির কথা পুরোদস্তুর মনে না থাকলেও একেবারেও সে ভুলে যায়নি। দিগন্তও হয়তো ভুলেনি। সেই ভাইকে একা রেখে চলে যেতে হবে! হয়তো সেজন্য কাঁদছে। তারও তো মনের মধ্যিখানে অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে। স্নেহা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ভাইকে ধরে নিজেও কেঁদে ফেলে। দিগন্ত নিরব হয়ে এসেছে। হয়তো ছেলেদের এভাবে কান্না করা সাজে না বলে চুপ হয়ে গেলো। তবে চোখের জল গড়িয়ে স্নেহার কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছে, এটা স্নেহা উপলব্ধি করতে পারলো। ভাইকে একটু পর ছাড়িয়ে চোখের জল মুছে দিলো। কপালে চুমু খেয়ে বললো,

“পাগল ছেলে। এভাবে কেউ কাঁদে! আমি তো একেবারে ম”রে যাচ্ছি না। মনে পরলেই গিয়ে দেখে আসবি।”

স্নেহার মুখে মৃ”ত্যুর কথা শুনে চমকে উঠে দিগন্ত। বোনের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে,

“একদম ম”রণের কথা বলবি না আপা। আমি বাঁচবো না আর।”

৩৪,
স্নেহা বিস্মিত হলো দিগন্তের কথায়। তার গম্ভীর, বদ মেজাজি ভাইয়ের মাঝেও যে বাচ্চা স্বভাবের সত্ত্বাটা রয়ে গেছে বুঝতে পারে। শুধু অনুভূতিরা মৃ’ত প্রায়। জীবিত করার চেষ্টার অভাবে দিগন্তের জীবনে চঞ্চলতা নেই৷ স্নেহা আদুরে স্বরে ভাইকে জবাব দেয়,

“ওটা তো শুধু কথার কথা। এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো?”

“বাবা মা”রা যাবার পর তুই আমার দুনিয়া আপা। তোর কিছু হলে আমার দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যাবে। আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে আপা। পুরুষ মানুষ বলে দেখ কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারলাম না। আমাদের দুই ভাইবোনের জীবনটা এমন হলো কেনো আপা! বাবা-মা, তুই, আমি সুন্দর একট পরিবার হতে পারতো তো আমাদের! হলে কি খুব ক্ষতি হতো আপা! উপরওয়ালা মা’কে দূরে নিয়ে গেলেন৷ বাবাকে একেবারে নিয়ে নিলেন, তোকেও আমার থেকে দূরে যেতে দিতে হচ্ছে। আমার জীবনটা এমন এলেমেলো কেনো আপা! আমি কাউকে ভালোওবাসতে পারলাম না। কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারিনা তুই ছাড়া। মনে হয় আমার মায়ের মতো, বাবা যেমন বি’পদে পরেছিলো বলে মা ছেড়ে গিয়েছিলো, আমারও তেমন কিছু হলে ছেড়ে যাবে। ভয় লাগে আপা বড্ড ভয় লাগে। কষ্ট হচ্ছে আপা, আমি তোকে ছাড়া থাকবো কি করে?”

দিগন্তের বাচ্চাদের মতো আচরণ দেখে স্নেহা হতবিহ্বল হয়ে যায়। এই কোন দিগন্তকে দেখছে সে! যে সবসময় নিজেকে গুছিয়ে নেয়, সেই দিগন্ত আজ মিসিং। স্নেহা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

“মেয়েরা জানিস তো জীবনে এমন একজনকে চায়, যে তার বাবা আর ভাইয়ের মতো তাকে আগলে রাখবে। আর ছেলেরাও তেমনই, নিজের মা আর বোনের মতো একজন হলেই তাদের আর কিছু লাগবেনা। নিজেদের দিক থেকে সম্পর্ক আগলে রাখার চেষ্টা আজীবন করে যায়। আমাদের জীবনটা যেমন গড়মিলে, কোন স্রোত কোথায় গিয়ে আছড়ে পরছে ঠিক নেই, তেমনই স্রোতে ভাঁটা পরার জন্য হলেও কেউ না কেউ ঠিকই আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা, সে এসে পরবে। আমার জীবনে যেমন মাহাদ আসলো। হয়তো তোর জীবনেও কারোর আসার সময় হয়েছে। এখন তোর আপত্তি না থাকলে আমাদের দুই ভাইবোনের একদিনে বিয়েটা হতে পারে। তুই বউ আনবি ঘরে, আমি বউ হবো অন্য কারোর ঘরে।”

দিগন্ত বোনের শেষের কথার আগামাথা বুঝতে পারেনা। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“বউ আনবো মানে?”

“আমি তোর জন্য মেয়ে ঠিক করেছি, মেয়ের মায়ের সাথে কথাও হয়েছে। তুই হ্যাঁ বললেই, বিয়েটা হয়ে যাবে। বিয়ে নিয়ে তেমন স্বপ্ন নেই আমার। ছোটোখাটো আয়োজন, ঘরের কিছু মানুষ, আর এতিমখানার বাচ্চাদের খাওয়াবি। এইটুকু হলেই চলবে। বিয়ের নামে বাড়তি টাকা নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। মাহাদেরও এক কথা। বড়ো করে আয়োজন করবি, মানুষ এসে সেই বিয়ে বাড়ির নামে কুট কাচালি করার জায়গা পাবে। দরকার নেই সেসবের। যেহেতু ছোটো পরিসরে আয়োজন,এজন্য তুই মতামত দিলেই বিয়েটা হয়ে যাবে। তেমন সমস্যা হবেনা।”

“মেয়েটা কে?”

স্নেহার কথার শেষে দিগন্ত প্রশ্ন করে। স্নেহা জবাব দেয়,

“রাইমা, মাহাদের খালামনির মেয়ে। দেখেছিলি তো তুই, মেয়েটিকে আমার বেশ ভালো লাগে। মাহাদের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর থেকেই ওর গল্প শুনতাম মাহাদের মুখে। এরপর ৩বছর যেতেই দেখা হয়েছিলো আমাদের। তখন থেকেই দেখে আসছি ওকে। মাহাদের মুখে ওর গল্প শুনতে শুনতে একসময় এমন লাগতো, মনে হতো মাহাদ আমায় না ওকে ভালোবাসে। হিংসে হতো ওকে। পরে বুঝতে পারি মেয়েটা কত্তোটা ভালো। তুই শুধু একবার হ্যাঁ বল ভাই! তোর কাছে আমার একটাই শেষ চাওয়া। আর কিছু চাইবোনা। আমার কথাটা রাখ ভাই প্লিজ!”

মাহাদ স্নেহার মুখে রাইমার সম্পর্কে কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকায়। থমথমে স্বরে বলে,

“দুনিয়ায় আর কোনো মেয়ে পেলি না আপা! আর কোনো কিছু তোর শেষ চাওয়া হলো না! সব বাদ দিয়ে এটা তোর শেষ চাওয়া?”

“কেনো রাইমার মধ্যে সমস্যা কি পেলি তুই? দেখতেও বেশ ভালো, ব্যবহারও ভালো। আমায় যদি বড়ো বোন হিসেবে সম্মান দিয়ে থাকিস, তো আমার এই কথাই শেষ কথা বিয়ে হবে। ব্যস, আমি আর কোনো কথা শুনতে চাইনা।”

স্নেহার কথায় দিগন্ত বিরবির করে বলে,

“ব্যবহার ভালো না ছাই।”

স্নেহা তা দেখে বলে,

“কিছু বললি?”

“না, তোর ভালো লাগলে আমারও ভালো লাগবে আই উইশ। দেখ মেয়ে রাজী থাকলে আমার সমস্যা নেই।”

দিগন্ত কথাটা বলেই উঠে চলে যায়। স্নেহা খুশিতে মাহাদের কাছে কল দেয়। দিগন্ত রুম ছেড়ে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অস্ফুটস্বরে বলে,

“গড, মেয়েটা যেনো রাজী না হয়। যে ধানী লঙ্কা। প্রতিদিন ঝাঁজে মে”রে ফেলবে আমায়। বোনের চাওয়ার দিকে তাকিয়ে সম্মান দিয়ে হ্যাঁ তো বললাম। বাকি টা তুমি সামলে নেও খোদা।”

৩৫,
সময়টা বিকেলবেলা। শার্লিনদের বাসায় শার্লিনের রুমের বিছানায় বসে আছে রাইমা আর শার্লিন। একটুপরই পাত্রপক্ষ আসবে, সেই তোড়জোড় চলছে ড্রইং রুমে। সকালবেলায় অনেক বুঝিয়ে শার্লিনের কান্না থামিয়ে শার্লিনকে বাসায় রেখে গিয়েছিলো রাইমা। দুপুরের খাওয়া না হতেই আবার শার্লিনের কল পেয়ে আবার এসেছে ওর কাছে। দু বান্ধবীর মাঝে নিরবতা ভেঙে শার্লিন বললো,

“বিয়েটা ভাঙবো কি করে রাই? আমার ভালো লাগছেনা এরকম জোকারের মতো সেজেগুজে অন্য একটা ছেলের জন্য বসে থাকতে। ইফরাদ তো সব শুনে বলেই দিয়েছে অন্য ছেলের বউ হওয়ার উদ্দেশ্যে যেনো কারোর সামনে না যাই। কিছু একটা কর! আমার বিরক্ত লাগছে এবার।”

“যা করার আমিই করবো। এতো ভেবেচিন্তে দেখলাম, তুই আর তোর ইফরাদ, দুই বলদ আর বলদীরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। খ”বিশের দল, ভালোবাসতে পারে। সাহস করে পরিবার মানিয়ে বিয়ে করতে পারেনা। চুলের ভালোবাসা তোদের।”

“চু”ল না বলে সরাসরি বা* বললেও তো পারিস। চুলের হিন্দিই তো ওটা।”

রাইমা শার্লিনের আহাম্মক কথাবার্তা দেখে কটমটিয়ে তাকায় শার্লিনের দিকে। সিরিয়াস মুহুর্তেও এই মেয়ের নির্লজ্জ কথাবার্তা থামবেনা। শার্লিন মুখটা কাচুমাচু করে বলে,

“দুইটা মেয়ের মাঝে এর থেকেও কতো ভয়া”নক কথাবার্তা হতে পারে তোর কল্পনাও নেই। আমি তবু ভদ্র কথাই বলেছি।”

“তা আপনার কল্পনা কোথা থেকে হলো!”

“ফেসবুকে একটা মেয়ের সাথে পরিচয়, সে এমন সব কথা বলে, লজ্জায় আমি ব্লক করে দিয়েছিলাম।”

“তুই পাগল, যতোসব পাগল তোর কপালে জুটে।”

রাইমা কথাটা বলেই হনহনিয়ে শার্লিনের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। শার্লিন পিছনে ছুটতে ছুটতে জিগাসা করে,

“কোথায় যাস আমায় রেখে।”

“তোমার বিয়ে ভাঙতে। দয়া করে একটু ধৈর্য ধরে চুপ করে বসে থাকো নিজের রুমে। নয়তো সিরিয়াস মুহুর্তে তোমার উল্টাপাল্টা কথা সব তলিয়ে দিবে।”

শার্লিন থেমে যায় রাইমার কথায়। নিজের জায়গায় ফিরে এসে চুপটি করে বসে। ভেতরে ভেতরে টেনশন কাজ করতে শুরু করে। কি যে হবে! উপরওয়ালা জানেন। শার্লিন উপর দিকে তাকিয়ে বলে,

“ওহ খোদা, এবারের মতো বাচিয়ে নেও। প্রমিস আমি ভালো হয়ে যাবো।”

কথাটা বলেই শার্লিন আবার জিভে কাম”ড় কাটে। নিজের মাথায় টোকা মে”রে বলে,

“আমি ভালো হবো কি! খারাপ ছিলাম কবে! ভালোই তো ছিলাম, আছি, থাকবো। ধুর কি সব বলছি। পাগ’ল হয়ে গেলাম এই বিয়ের চক্করে। এজন্য মানুষ বলে সিঙ্গেল লাইফ ইজ ঝাকানাকা লাইফ। বিয়েটা শুধু ভাঙুক, কাউকেই বিয়ে করবোনা ধুর। জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিলো এই বিয়ে নামক শব্দটা।”

চলবে?

ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আসসালামু আলাইকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here