#আকাশেও_অল্প_নীল
#পর্বঃ২৭
#আর্শিয়া_ইসলাম_উর্মি
৮৩,
গ্রামের মাটিতে পা রেখেই চোখ বন্ধ করে হাত মেলে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলো রাইমা। ওর দেখাদেখি শার্লিনও তেমন করলো। আরফান তো গাড়ি থেকে নেমেই পায়ের জুতো খুলে গ্রামের মাটিতে ছুটোছুটি শুরু করেছে। গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে পরদিন এগারোটার সময় পৌছালো তারা। গ্রামের মাটিতে, তার প্রকৃতিতে বাতাসের গন্ধ টাই অন্য রকম। একপ্রকার প্রশান্তি ছেয়ে থাকে প্রকৃতির নির্মল বাতাসে। হাসান সাহেব এবং আজাদ সাহেব সম্মিলিত ভাবে গাড়ি থেকে সব ব্যাগ, লাগেজ নামাচ্ছেন। শাহনাজ বেগম আর সাহিরা বেগম বাড়ির বাইরের উঠোনে পা ফেলতেই বাড়ির সব বউঝিরা এসে উনাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। বাড়ির কর্তারা হাসান সাহেব এবং আজাদ সাহেবের হাত থেকে সব ব্যাগ লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে ব্যস্ত। রাইমা আর শার্লিন একত্রে পা ফেলে সবার দিকে আগাচ্ছে। বড়ো হওয়ার পর রাইমার তেমন ভাব গ্রামে আসা হয়নি। বাবা মা এসে ঘুরে গেলেও সে আসেনি। ৩-৪বছর পর একবার এসে ঘুরে গেছে। এবারও এইচএসসি পরিক্ষা শেষে এসে যে ঘুরে গিয়েছিলো! এরপর আর আসা হয়নি। ঘুরকুনো স্বভাবের মানুষগুলো নিজের ঘরেই আর গুটি কতক মানুষের মাঝে সস্তি পায়। রাইমার স্বভাবেও সেই ধাচ আছে। সে নিজের ঘরেই শান্তি পায়, অন্য কোথাও গেলে তার শান্তি লাগে না। রাইমাকে দেখেই তার দাদী হামিদা বেগম এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে একপ্রকার কেঁদে দিয়েই বললেন,
“গ্রামে আসার কথা মনে পরলো বু! আসলা তুমি! আমরাও শহরে যাইতে পারিনা, আর তুমি আমগো দেখতে আসো না। এইটা কি ঠিক বু?”
রাইমা আচমকা জড়িয়ে ধরায় একটু হকচকিয়ে যায়। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরে সে বললো,
“এই যে দাদী আসলাম। আপনি কাঁদছেন কেনো? কান্না থামান, আসছি তো আমি।”
“কতোগুলা বছর পর আসলা বু। আমার একমাত্র বড়ো নাতনী তুমি। অথচ তোমারেই মন চাইলে দেখতে পারিনা। এমন সময় আসলা, যখন বিদেয় দেওয়া লাগবো। এমনেই আসতা না, পরের ঘরে যাবা, আরও আসবা না। ম’রলে শেষবার দেখতে আসতে পারবা কিনা! এটাও সন্দেহের বিষয় হয়ে গেছে।”
“আহ মা! রাইমা মা আসতে না আসতেই তোমার কান্না শুরু। সবাইরে ঘরে যেতে তো দাও। আসলো সবে! একটু দম নিতে দাও।”
হামিদা বেগমের কান্না থামাতে কথাটা বললেন রাইমার চাচা মজিদ সাহেব। তখনই রাইমার চাচাতো বোন শিখা আর রেখা বাড়ির ভেতর থেকে দৌড়ে এসে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে। রাইমা দুজনকে দেখে হেসে দুহাতে জড়িয়ে নেয়। শাহনাজ বেগম নিজের জা সাফিয়া বেগমের সাথে কলাকুশলী আদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন। শিখা আর রেখা রাইমাকে জড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বুবু, কত্তোদিন পরে আসলে। জানো তোমায় কত্তো মিস করেছি!”
“আমিও তোমাদের মিস করেছি পিচ্চিগুলো।”
৮৪,
শিখা আর রেখা পিঠাপিঠি হওয়ায় একই সমান প্রায়। একজন ইন্টার প্রথম বর্ষে অন্যজন ২য় বর্ষে পরে৷ সবার সাথে ভালোমন্দ কথাবার্তা হওয়ার পর মজিদ সাহেব শিখা আর রেখাকে সবার জন্য ঠিক করা ঘর দেখিয়ে দিতে বলে। শার্লিন এতোক্ষণ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিলো। সবাই ব্যস্ত নিজেদের আলাপচারিতা নিয়ে। তার দিকে তো কারোর খেয়ালই নেই৷ রাইমা এসে শার্লিনের পাশে এসে দাড়িয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে জিগাসা করে,
“আমার গোল আলু এখানে এমন কারেন্টের খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছে যে!”
“কি আর করবে সে! তাকে কি কেউ চিনে? যে সে অন্য কারোর মতো জড়িয়ে ধরে গল্প জুড়ে দিয়ে একটা মানুষকেই ভুলে যাবে!”
শার্লিন গাল ফুলিয়ে উত্তর দেয়। রাইমা মুচকি হেসে শার্লিনের গাল টেনে বলে,
“হয়েছে হয়েছে, অনেক রাগ করেছেন। এবার চলেন, ঘরে গিয়ে একটু রেস্ট করবেন। এরপর মন ভরে শান্তিমতো অভিমান করিয়েন।”
“আজকাল অভিমানের আর পাত্তা পাই না। অভিমান করেও আর লাভ নেই।”
শার্লিন আনমনে রাইমার কথার জবাবে কথাটা বলে। রাইমা কারণ টা বুঝতে পারে। সে জবাব দেয়না শার্লিনের কথার। যা করার সে ইফরাদ আসলেই করবে। কিন্তু তাদের আসতে আসতে শনিবার। মাঝখানে আরও দুদিন। ইফরাদের সাথে ফোনে কথার বলার চেষ্টা করেছে রাইমা। কিন্তু সুইচ ওফ দেখালো ইফরাদের ফোন। এসব যে কি হচ্ছে বুঝে আসছেনা রাইমার। স্নেহার সাথে কথা হলো, আমিরা শেখ স্নেহাদের সাথে গ্রামে যাবেন, সেই বিষয়ে যেনো সে দিগন্তকে একটু বোঝায়, সেই কথা বলে রেখেছে স্নেহা। আর দিগন্তের কাছে উনার কথা বললে ঠিক কি রিয়েকশন হবে দিগন্তের! এটা নিয়েই সন্দিহান রাইমা৷ ভালোই লাগছেনা কিছু।
“কি হলো রাইমা, ওখানেই দাড়িয়ে থাকবে? ঘরে আসো।”
সবাই প্রায় নিজেদের ঘরে চলে গেছে। শিখা আর রেখা সবার জন্য ঠিক করা ঘরগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। বারান্দায় দাড়িয়ে থাকা চাচীর ডাক শুনে নিজের চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রাইমা। শার্লিনের হাত আকড়ে পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। মেসবাহ আসতে চেয়েও আসতে পারেনি। তার অফিসের কাজে আটকে পরেছে। সেও বাবা মায়ের সাথেই আসবে। রাইমার মামা-মামীরা, কাজিন’স রাও সব শনিবারেই আসবে। আপাতত বাড়ি একটু ফাঁকাই আছে। রাইমা আর শার্লিনের জন্য ঠিক করে দেওয়া ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে রাইমা। শার্লিন টইটই করে পুরো বাড়ি ঘুরতে শুরু করেছে। রাইমার দাদার বাড়িটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে রাইমার কাছে। ইট পাথরের বাড়ির বদলে এক সারিতে ৪টা ঘর, চার ঘরের সাথে বাকা করে উত্তর আর দক্ষিণ দুয়ারী করে একপাশে দুটো অন্য পাশে দুটো করে চারটে ঘর। মাঝখানে হেশেলপার, কলপার, টয়লেট, আর একপাশে খোলা জায়গায় টুকিটাকি সবজির মাচা দেওয়া, আর বাগান করা। হেশেলপারে সবার জন্য খাবার বানাতে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন সাফিয়া বেগম এবং হামিদা বেগম। নানা রকমের পিঠাপুলি, নাস্তা, সেমাই, দুপুরের খাবারের জন্য আলাদা করে খাবার বানানো সবকিছুই বাড়ির ভেতরের বারান্দায় একপাশে খাবার টেবিল রাখা, সেখানে সাজিয়ে রাখছেন উনারা। শাহনাজ বেগম আরফানকে ফ্রেশ করিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে বের হলেন৷ শার্লিনকে বাড়িতে ঘুরঘুর করে দেখে উনি বললেন,
“টইটই পরে করিয়ো আম্মু, ফ্রেশ হয়েছো? ফ্রেশ হতে হবেনা?”
“রাইমা এসেই আগে ধপা”স করে শুয়ে পরলো আন্টি। আমি কি করবো! তাই ঘুরে ঘুরে দেখছি। জন্মের পর তো গ্রাম চোখে দেখছি কিনা সন্দেহ! বড়ো হয়েও দেখেছি বলে মনে পরে না। শহরের ইট পাথর দেখতে দেখতে কা”না হয়ে গেলাম। বাপ দাদার ঠিকুজি গোষ্ঠী সব ঢাকা। প্রথমবার গ্রামের বাড়িঘর এতো কাছ থেকে দেখা তো, দেখে মন জুড়োচ্ছে না আন্টি৷”
৮৫,
শার্লিন কপাল চাপড়ে উত্তর দেয় শাহনাজ বেগমের কথার। ওর কথার ভঙ্গিতে উপস্থিত সকলেই হেসে ফেলে। হামিদা বেগম শার্লিনকে লক্ষ্য করে শাহনাজ বেগমকে বললেন,
“বড়ো বউমা! এ ছেড়িরে তো চিনলাম না। দেখতেছি তোমরা আসার পর থাইকা। কিন্তু চিনি নাই।”
“তা কেন চিনবা বুড়ি, তুমি তো তোমার নাতনীরে নিয়াই ব্যস্ত ছিলা। আমারে তো কেউ চিনোও না ভালোও বাসো না। অবশ্য বাসবা কেন? সতীন লাগি তো তোমার। তা আমার বর টা কই গো বুড়ি?”
হামিদা বেগমের প্রশ্ন শুনে শার্লিন হামিদা বেগম পিড়িতে বসে তরকারি খুন্তি দিয়ে নেড়ে দিচ্ছিলেন, সেই বসা অবস্থাতেই উনার গলা জড়িয়ে কথাগুলো বললো শার্লিন৷ হামিদা বেগম খুন্তি টা রেখে তরকারিতে ঢাকনা দিয়ে শার্লিনের হাত ধরে গলা ছাড়িয়ে ঘুরে বসে ওর গালে হাত দিয়ে বললেন,
“তোরেই আমার নাতনী নাতনী লাগতেছে রে ছেড়ি। আমার নাতনী তো শান্ত মেয়ে, দাদীর সাথে যে একটু রসিকতার একটা সম্পর্ক, তা ওর মাঝে খুজেই পাওয়া যায় না।”
“এখন কও তো আমার বুড়ো বর টা কই! সবাইরে দেখি, তারে দেখিনা যে?”
“তোর বুড়ো বরটা কামলা হইছে, ভু্ট্টা তুলতেছে ক্ষেতে। তোরে আসার পর থেকে খেয়াল করতেছি, তুই কেডা এইডা আগে ক তো ছেড়ি!”
“ও আপনার নাতনীর সবথেকে কাছের বান্ধবী আম্মা। ওর বিয়ের জন্য আসছে আগেই৷”
শাহনাজ বেগম শার্লিনের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর শার্লিনকে ফ্রেশ হতে বলে আরফানের হাত ধরে ঘরে চলে গেলেন। শিখা আর রেখা তখুনি বাড়ির ভেতর উঠানে ঢোকার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে হাত ভর্তি কাঁচা তেতুল নিয়ে। শার্লিন কলপারে ঢুকতে গিয়ে কাচা তেতুল দেখে থেমে যায়। ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এগুলো কোথায় পেলে তোমরা?”
শার্লিনকে আগেই নিজের আত্মীয় স্বজন সবার ছবি দেখিয়ে নাম পরিচয় বলে দিয়েছে রাইমা। এজন্য শার্লিনের সাথে মন সংকোচ হচ্ছে না সবার সাথে মিশতে। শিখা আর রেখার হাতে কাঁচা তেঁতুল দেখে সাফিয়া বেগম ধমকে বললেন,
“রাইমা আসতে না আসতেই তোদের বাঁদরামি করে তেতুল আনা শুরু!”
“ইশ রে আন্টি ওদের ধমক কেনো দিচ্ছেন? কাঁচা তেঁতুল রাইমার মতো আমারও পছন্দ। এই এগুলো ধুয়ে লবণ মরিচ সহ একটা প্লেটে সাজিয়ে আমাদের জন্য ঠিক করা ঘরে নিয়ে চলো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
শার্লিনের কথা শুনে সাফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না। শিখা আর রেখা শার্লিনের কথামতো কাজে লেগে পরে। বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পরে নিজেদের কাজ শেষ করে৷
রাইমা ফোন হাতে বসে আছে। দিগন্তের কাছে কল দিবে কি দিবে না সংকোচে একবার নাম্বার ডায়াল করছে তো রিং হওয়ার আগেই কেটে দিচ্ছে৷ ওদের যা কথা হয়েছে, সবই তো সরাসরি। ফোনে কথা বলা হয়ে উঠেনি এখনও। আবার প্রথম বার ফোন দিয়েই আমিরা শেখের কথা বলবে! ভয়ই লাগছে তার৷ একটু সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে সাহস নিয়ে দিগন্তের নাম্বারে ডায়াল করেই ফেলে রাইমা। মাহাদের থেকে দিগন্তের নাম্বার টা নিয়েছে সে। এদিক থেকে একটু চিন্তাতেও ছিলো রাইমার নাম্বার না চিনে যদি রিসিভ না করে! কিন্তু রাইমার চিন্তা ভুল প্রমাণ করে দিগন্ত ফোন টা রিসিভ করলো৷ রাইমা ফোন টা কানে ধরে কিছু বলার আগেই শুনতে পায়,
“এই যে মিস রাইমা খন্দকার, অস”ভ্য মেয়ে! আমায় মিস করছিলেন বুঝি?”
দিগন্তের শীতল কণ্ঠে মিস করার কথা টা শুনে রাইমার মনের মাঝে এক প্রশান্তির ঢেউ খেলে যায়। উত্তর দিতে যেনো ভুলে যায়। সেকেন্ড গড়িয়ে সময় মিনিটে পরিণত হলে দিগন্ত আবারও শীতল কণ্ঠে বলে,
“নিশ্বাস গুণতে ফোন দিয়েছেন বুঝি? কথা বলছেন না যে!”
“আপনি আমার নাম্বার কি করে চিনলেন? কথা না বলতেই আমি ফোন দিয়েছি, ধরে ফেললেন যে!”
রাইমা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে। দিগন্ত স্মিত হাসে। রাইমার কথার উত্তরে বলে,
“নাম্বার চেনা কি খুব কঠিন বিষয় ম্যাম?”
চলবে?
ভুলত্রুটি মার্জনীয়, রিচেইক করিনি। রাইটিং ব্লকে পরে গেছি জানেন! গল্পটা যে লিখে শেষ করে দিবো, আমি লিখতে বসেও একটা শব্দ সাজাতে পারিনা। কি যে কষ্ট লাগে। গল্প দিলে তো আপনারা ২-৩মিনিটে পড়ে ফেলেন। আর এটুকু লিখতেই আমার ২-৩দিন লেগে যাচ্ছে। শব্দ মাথায় গিজগিজ করে অথচ লিখতে বসে সাজাতে না পারা! কতোটা যে কষ্টের! ব্যস্ততা কমে গিয়েছে। রেগুলার লিখতে চাই,অথচ লেখায় মন বসেনা। আমায় ক্ষমা করবেন এতো অপেক্ষা করানোর জন্য। চরিত্রের নাম আমিই ভুলে যাই, মিসবাহ আর মেসবাহ, এক টা চরিত্রের নাম আমি গুলিয়ে ফেলি। একবার মিসবাহ তো আর একবার মেসবাহ লেখি। একটু মানিয়ে নিয়ে ভুলটা ক্ষমা করবেন। আসসালামু আলাইকুম