#মউফুল(৩) — মার্জিয়া হক

0
208

#মউফুল(৩)
— মার্জিয়া হক

নানী আবার বিয়ে দিল মায়ের। বউ মরা লোক বড় বড় চার ছেলেমেয়ের বাপ, মায়ের দ্বিগুন বয়সী। এভাবে জোয়ান মেয়ে ঘরে রাখা মুশকিল। একে গরীব মানুষ তার উপর মাথার উপর দাঁড়ানোর কেউ নাই।বড় বাড়ির বড়লোকের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচানো দরকার। অবস্থাপন্ন ঘর, খাওয়া পড়ার অসুবিধা নাই। পুরুষ মানুষের আবার বয়স কি? মউফুলের জায়গা হলো না ওই ঘরে। নানীর কাছেই থাকে, হাতে হাতে কাজ করে ইস্কুল যাওয়া আর হলো না। কয় বছর বাদে মামা বিয়ে করে আনল, মামীর ফাই ফরমাস খাটা, নানীর দেখাশোনা করা,মউফুলের কাজ হয়ে দাঁড়াল। মামীর বাচ্চা দুইটা হয়েছিল অল্পদিনের ব্যবধানে, তাই তাদের দেখাশোনাও মউফুলের দায়িত্বে এসে পড়ে। মামী খাওয়া পড়া কম দিত না। আদরও করত। প্রায় সমবয়সী মউফুলের সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল। সারাদিন কাজ করে পড়ন্ত দুপুরে সে একগাদা কাপড় নিয়ে পুকুরঘাটে যেত, কাপড় ধুয়ে গোসল করে বাড়ি আসত। নানীর বাড়িতে সুখেই ছিল মউফুল।
মা খুব কম আসত। বাড়িতে অনেক কাজ। ছেলে মেয়ে, নাতিপুতির সংসার। আর স্বামীও বদমেজাজি। বাপের বাড়ি আশা পছন্দ করে না। মা যখন আসে সারাক্ষণ বাপের গল্প করে অভাবের সংসার হলেও কত সুখ ছিল! কপালে সুখ সহ্য হলো না। মা ভুলতে পারে না বাপকে, যেমন মউফুল পারে না।

সব কাজ শেষে কাপড় নিয়ে একদিন পুকুরে গেছে মউফুল। কাপড় ধুয়ে রেখে আরাম করে গোসল করছিল। সাঁতার দিয়ে দুইবার পুকুর এপার ওপার করলো। উঠতে যাবে কে যেন পা টেনে ধরল, চিৎকার দেবার আগেই পানির নীচে টেনে নিল। একটা যুবক ওকে সাপের মত জড়িয়ে নিয়েছে। হাঁসফাঁস করে দম চলে যাবার আগেই আবার ছেড়ে দিয়েছে। নাকে বাতাস পাবার সাথে সাথে কাশতে কাশতে দম যায় যায়। এর মধ্যে সেইজন পুকুরের ওপারে পৌঁছে গেছে, উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। মউফুল পড়িমরি করে দৌড়। এক দৌড়ে বাড়ি। ওকে হাঁপাতে দেখে মামী দৌড়ে আসে,
—” কিরে হাঁপাস ক্যান?”
—-” কুত্তা তাড়া করছিল মামী” ঝটপট উত্তর দেয় মউফুল।
— “কস কি কামড়ায় নি তো? তাইলে আবার ইঞ্জিশন দেয়া লাগব”
— “না মামী কামড়াইতে পারে নাই”
— “তাড়াতাড়ি কাপড় ছাইড়া আয়, ক্ষিদা লাগছে”
— “পেত্যেক দিন আমার লিগা বইসা থাক ক্যান, খায়্যা নিলেই পার”
— বেশী কতা কইস নাতো, তাত্তাড়ি আয়।তোরে ছাড়া খাইছি কখনও? ”
মউফুল ভিজা কাপড় পাল্টাতে যায় আর মামী কেচে আনা কাপড় গুলা শুকাতে দেয়। কাপড় ছাড়তে এসে মউফুল বারবার শিহরিত হয়,এমন আচমকা পুরুষের স্পর্শ, কেমন দিশাহারা লাগে ওর। পরদিন থেকে ভোর সকালে উঠে কাজ সেরে দুপুর দুপুর ঘাটে যখন অনেক লোক থাকে,তখন কাপড় কেচে নিয়ে চলে আসে।

জহির ঢাকায় ভ্যান চালায় । বাপ মরেছে ছোটতে, সংসারে মা,দুই বোন। বড়বোন কে বাপ বিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কিন্তু স্বামীর অত্যাচারে একছেলে নিয়ে বাপের ঘরে ফিরে এসেছে। বোনের স্বামী বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলে বারবার। টাকা দিবে কোথা থেকে ওরা? নিজেদেরই ভাত জুটে না। মা, বড়বোন পাড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে,ছোট বোনের বিয়ে হয় নি তাই বাইরে কাজে পাঠায় না মা। সে ঘরের কাজ করে, বুবুর ছেলেটাকে দেখাশোনা করে। ওদের দুইঘর পরেই কাসেম চাচার ঘর, চাচা ঢাকায় কাজ করে বহুদিন। সে ই প্রস্তাব দেয় ঢাকায় যাওয়ার। ১৭ বছর বয়স থেকে ঢাকায় থাকে জহির এখন বাইশ বছরের টগবগে যুবক। এর মধ্যে বিভিন্ন পেশা পরিবর্তন করেছে সে তবে বসে থাকে নি। মাসে মাসে যে টাকা পাঠিয়েছে তাতে মা হাত দেয়নি কখনও। ছোট বোনের বিয়ের জন্য জমিয়ে রেখেছিল। সেই বোনের বিয়েতেই জহির এসেছিল গাঁয়ে। ঈদ চাঁদ ছাড়া আসা হয় না। থাকাও হয় না বেশী দিন। কিন্তু বোনের বিয়ের জন্য এসে সাত দিন হয়ে গেল যাওয়ার নাম নেই। বোনের বিয়ে হয়ে ফিরনী ঘুরনি সব শেষ তবু জহিরের নড়াচড়া না দেখে মা চিন্তায় পড়ে। জহিরের চোখ পড়েছে মউফুলএ, মন টানে না ঢাকা যেতে। তিন চার দিন আগে পড়ন্ত দুপুরে জহির কাসেম চাচার বাড়ি যাচ্ছিল, জহিরের হাতে চাচী যদি চাচার জন্য কিছু দেয়।চাচার সাথে জহির একই ঘরে থাকে রায়ের বাজার বস্তিতে। কিন্ত পুকুরে সাঁতার কাটতে দেখা মউফুল কে দেখে তার চোখ আঁটকে গেল।গাছের আড়াল থেকে দেখতে লাগল। যেন শাবনূর পুকুরে সাঁতার কাটছে। শাবনূর জহিরের জানের জান নায়িকা তার কোন সিনেমা বাদ রাখে না দেখতে। একটু পর মউফুল উঠে চলে যায়, জহির পিছু পিছু যেয়ে দেখে কোন বাড়িতে ঢোকে। পরদিন দুপুর পর যেয়ে আবার গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে মউফুল কাপড়কাচে,মাথায়, গায়ে সাবান ডলে গোসলে নামে। জহিরের মাথায় খারাপ। পুকুরের ওপার থেকে নিঃশব্দে ডুব সাঁতার দিয়ে মউফুলকে জাপটে ধরে। মউফুল হাঁচড়পাঁচড় শুরু করলে ছেড়ে দিয়ে আবার ডুব সাঁতার দিয়ে ঐ পাড়ে চলে যায়। পাড়ে উঠে মউফুল থরথর করে কাঁপছিল, মুখটা নীল হয়ে গেছিল ভয়ে। তারপর পড়িমরি করে দৌড়।

পরদিন জহির আর মউফুলের দেখা পায় না। তারপর দিনও না। জহিরের তো মাথা নষ্ট। জহিরের মা তার মনমরা ভাব লক্ষ্য করে বারবার জিজ্ঞাসা করে, সমস্যা কি? জহির বলতে পারে না। নিজের বিয়ের কথা নিজে বলে কেমন করে আর কেবলই বোনের বিয়ে দিল এখন বিয়ে করা সম্ভব না।বস্তিতে আলাদা ঘর নিতে হবে। বিয়ের খরচ আছে। হাত খালি করে বোনের বিয়ে দিয়েছে। আবার ভয় হচ্ছে মনে পরের বার আসার আগেই যদি মউফুলের বিয়ে হয়ে যায়! জহিরের মা খালেককে ধরে জহিরের কি হয়েছে জানার জন্য। খালেক জহিরের বন্ধু গাঁয়েই থাকে বাপের জোতজমি আছে তাই দেখাশোনা করে বিয়ে করেছে দুই বছর এক বাচ্চার বাপ।খালেক জানতে চাইলে সব খুলে বলে জহির। জহিরের মা একথা শুনে রেগে আগুন। তার কত সাধ, এক ছেলের বিয়ে দিয়ে কত কি নিবে, দুই মেয়ের বিয়েতে যা খরচ হয়েছে তার ডবল উসুল করে নিবে আর ছেলে কি না বাপ মরা মা ছাড়া মামার বাড়ি আশ্রিত মেয়ে পছন্দ করে তার জন্য দেওয়ানা হয়ে গ্রাম ছাড়ছে না!

উপায়ন্তর না দেখে জহিরের মা যায় মউফুলের নানীর কাছে বিয়ের কথা বলতে, মামা মামী সবাই ছিল সেখানে। মামা বল্ল,” আঠারো বছরের আগে বিয়া দিমু না, দ্যাশের আইনে নাই। অর বয়স এখন সতের। ”
— “আমার পোলা তো পাগল হইছে এই মাইয়ার লাইগা, হ্যারে না লইয়া হে ঢাকা ফিরব না”
— “পোলারে বুঝান। দ্যাশে তো আইন কানুন আছে না কি?”
জহিরের মা বাড়ি ফিরে জহিরকে গালাগালি করে, মউফুল কোন দোষ না করা স্বত্ত্বেও গালাগালি খায়। অবশ্য তা গায়েবী গালাগাল এ তো মউফুল শুনছে না। জহির বলে পাকা কথা যেন তার মা দিয়ে আসে, মউফুলের যেন অন্য কোথাও বিয়ে না দেয়।আর ওর মামারা যদি কিচ্ছু দিতে না পারে তাও বিয়ে যেন হয়।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে জহিরের মা। আবার যায় মউফুলের নানীর বাড়ি। পাকা কথা নেয়ার জন্য। মামা বলে, ” দেহেন বুজান, আঠারো বছরের আগে মাইয়া বিয়া দিমু না।আর এক বছর পর আইসেন।”
জহিরের মা দাবী দাওয়া র কথা তুল্লে, মামা সাফ জানিয়ে দেয়, কিছু দেয়ার সাধ্য তাদের নাই। জহিরের আয় সংসারে কাজে লাগে তাই শরীরের মধ্যে আগুন জ্বললেও সহ্য করে যায় তার মা। এই একটা বছর কি ভাবে যে পার করে জহির!! প্রতি মাসে বাড়ি আসে একবার, ছুতো খোঁজে মউফুল কে কাছে পাবার।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here