#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(১০)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
_________________
হাসপাতালের নির্দিষ্ট একটা বেডে বছর সাতেকের লিকলিকে গড়নের এক বাচ্চা ছেলেকে আবিষ্কার করলো অন্বেষা। অযত্ন, অবহেলায় শ্যামবর্ণের গায়ের রঙে কালো আস্তরণের প্রভাবে গায়ের রঙ পেয়েছে অনেকটা তামাটে বর্ণের। জীর্ণশীর্ণ রোগা শরীর। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। বাচ্চাটাকে দেখেই অন্বেষার বুঝতে সামান্য বেগ পেতে হলো। অবহেলায়, অনাদরে বেড়ে ওঠা তার। গভীর নিদ্রা আচ্ছন্ন সে। অন্বেষা আর ডাকলো না। অন্বেষাকে বাচ্চাটার কাছে রেখে সারফারাজ গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে বাচ্চাটাকে অন্বেষা। আবেগপ্রবণ মনটা কেঁদে উঠলো অন্বেষার। বড্ড মায়া হলো ছেলেটার জন্য। মায়াবর ছোট্ট মুখটাই মলিনতার ছোঁয়া স্পষ্ট।
অন্বেষার চুরির রিনিঝিনি শব্দে ঘুমের রেশ কাটলো। আখি পল্লব মেলে দিয়ে এক অতীব সুন্দরী রমনীর দেখা পেল ছেলেটি। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টিতে কৌতূহলের খেলা। সফেদ রঙা সালোয়ার কামিজে নিজেকে জড়িয়েছে অন্বেষা। মাথায় বড় করে ওড়না টানা। হাতে দুটো সোনার বালা। মধ্যমা আঙ্গুলে ছোট্ট একটা আংটি। সবমিলিয়ে দারুণ সুন্দর লাগছে অন্বেষাকে।
ছেলেটিকে জাগ্রত দেখে মিষ্টি হাসলো অন্বেষা। অনেকক্ষণ থেকে কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করছিল। ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল, “এখন কেমন লাগছে বাবু? শরীরে ব্যাথা আছে?”
প্রতিত্তোরে ছেলেটির আস্তে করে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, “ভালো লাগছে। ব্যাথা মাঝেমধ্যে অল্প হয়।”
“তোমার নাম কি বাবু?”
“রিফাত।”
“মা শা আল্লাহ্ খুব সুন্দর নাম। কোথায় থাকো তুমি? কিভাবে গাড়ির সামনে পড়লে বল তো!”
“আমার মা আইজ পাঁচদিন হইলো ম’রে গেছে। আব্বায় অনেক আগেই আরেক বেডিরে বিয়া করছে। আমি আর মায় মিলে বস্তির একটা ঘরে থাকতাম। এহন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। ডাস্টবিনে খাবার খুজতে গিয়া কুত্তার দৌড়ানি খেয়ে গাড়ির সামনে পড়ছি। বিশ্বাস করেন আমি ইচ্ছে কইরা এমন করি নাই।”
চোখ যুগল ছলছল করে উঠলো বাচ্চাটার। অন্বেষার চোখের কোণেও অশ্রুরা জড়ো হয়েছে। কি দুঃখের কথা। আল্লাহর দুনিয়ায় বুঝি এতটা অসহায় কেউ হয়! অন্বেষার মনে হলো দুনিয়ায় তার থেকেও বহুগুণ অসহায়, নির্যাতিত, অবহেলিত মানুষের বাস আছে। মাতৃ স্বত্তা জেগে উঠলো বাচ্চাটার জন্য অন্বেষার। মায়া ভরা কন্ঠে শুধালো, “খাবার খেয়েছো আজ!”
প্রতিত্তোরে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে খেয়েছে।
অন্বেষা বলল, “আমাকে খালামনি বা আন্টি ডাকতে পারো। তুমি যার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছো তিনি আমার হাসবেন্ট। মনে কষ্ট নিও না সোনা।”
ব্যান্ডেজ বিহিন মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল অন্বেষা। তাকে দেখে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে অসুস্থ রিফাতের সাথে কতদিনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মেয়েরা এমনই হয়। সেখানে অন্বেষা তো নিজেও চরম অবহেলার স্বীকার।
আরাম পেয়ে পুনরায় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো রিফাত। ক্লান্ত শরীরে সবটুকু মমতা শুষে নিল রিফাতের ক্লান্ত দেহ।
“কি করছো?” সারফারাজের আগমনে উঠে বসলো বেডের পাশের চেয়ার থেকে অন্বেষা।
প্রতিত্তোরে বলল, “একটু আগে জেগেছিল কিন্তু আমি হাত বুলিয়ে দিতেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“ওর অনেকটা ব্লাড গিয়েছে কাল। শরীর ক্লান্ত তাই আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়েছে।” হাতের ওষুধপত্র নিয়ে বেডের পাশে ছোট্ট ডয়ারে সেগুলো রাখলো সারফারাজ। পূনরায় অন্বেষার উদ্দেশ্যে বলল, “চল, এবার বাসায় যাওয়া যাক।”
অন্বেষা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল, “একটা কথা বলার ছিল। বলব কি?”
সারফারাজ অন্বেষার ভিত হওয়ার কারণ খুজে পেল না। বলল, “আশ্চার্য তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার স্বামী। সবসময় যা বলবে একদম নির্ভয়ে বলবে। বলো কি বলতে চাও!”
“বলছি, বাচ্চাটাকে আমাদের সাথে নিয়ে গেলে হয় না? ওর বাপের সাথে সম্পর্ক বহু আগে ছিন্ন হয়েছে। মা মারা গেছে অল্প কিছু দিন হলো। ডাস্টবিনের পাশে খাবার খুজতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে আপনার গাড়ির সামনে পড়েছিল। নিবেন ওকে?”
”এসব তোমাকে কে বলেছে?”
“ও অর্থাৎ রিফাত নিজেই বলেছে।”
সারফারাজ ঘুমন্ত রিফাতের দিকে এক পলক চাইলো। ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। কি নিষ্পাপ মুখখানা। অতঃপর অন্বেষার হাত ধরে হাসপাতালের নির্জন স্থানে নিয়ে গেল। অন্বেষার উদ্দেশ্য শান্ত কন্ঠে বলল, “শোন অন্বেষা! তোমাকে কয়েকটা কথা বলি! ঢাকার শহরে তুমি নতুন। এ শহরের জটিল প্যাচগোছ তুমি বুঝবে না। ও যে সত্য কথা বলছে সে ব্যাপারে এ মুহূর্তে আমি মোটেও নিশ্চিত নই। হতেও তো পারে ও মিথ্যা বলছে। দয়াকরে বাড়িতে নেওয়ার পর চুরি করে পালাবে না তার কোন নিশ্চয়তা তুমি দিতে পারবে? আবার কর্ম সূত্রে কিছু মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক রেষারেষি পর্যায়ে। এটাও হতে পারে তাদের মধ্যে কেউ আমার ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্য এমন নিচু কাজ করেছে ছেলেটাকে দিয়ে। তবে ওর বলা প্রতিটা কথা যতি শতভাগ সত্য হয় আমি সারফারাজ বলছি, ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব ইন শা আল্লাহ আমি নিব। আগে আমার স্পেশাল সোর্চ লাগিয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই করি তারপর বাকিটা দেখা যাবে। বুঝেছো অন্বেষা?”
অন্বেষা নিজের হটকারি সিদ্ধান্তে লজ্জিত হলো। এতটা বুদ্ধি খাটিয়ে সে ভেবে দেখেনি। প্রতিত্তোরে বলল, “জি বুঝেছি। আমি কি আপনার মত বুদ্ধিমান নাকি যে এত সব বুঝবো। ওর অসহায়ত্ত্বে আমার নারী মন কেঁদে উঠেছিল তাই তো আপনাকে তাৎক্ষণিক জানালাম।”
“ভালো করেছো। কখনও কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব যদি মনে হয় তুমি সে বিষয়ে নিশ্চিত নও অবশ্যই আমাকে জানাবে। কারণ অভিজ্ঞতা এবং বয়স দুটোই তোমার থেকে এগিয়ে আমার। তোমাকে ছোট করছি না। একসময় তুমিও বুঝবে। আমার থেকে ভালো বুঝবে সবকিছু। আমার অনুপস্থিতিতে তোমাকেই তো সবটা সামলাতে হবে।”
আঁতকে উঠলো অন্বেষা। অনুপস্থিতি মানে? ধরা গলাই বলল, “কেমন কথা বলেন আপনি? যেখানে আপনাকে ছাড়া আমি নিজের অস্তিত্ব কল্পণাও করতে পারি না সেখানে আপনি দিব্যি নিজের অনুপস্থিতির কথা জানিয়ে দিলেন? এই বিশাল দুনিয়ায় আপনি ছাড়া কে আছে আমার?”
সারফারাজ দেখলো অন্বেষা ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। নিজের উপর রাগ হলো সারফারাজের। কেন যে বোঝাতে গেল। মেয়ে মানুষ বোঝে কম লাফায় বেশি। অন্বেষা চিকন নরম হাতদুটো নিজের পোক্ত হাতের মুটোই পুড়ে সান্ত্বনার সহিত বলল, “বোকা মেয়ে সবকিছু এভাবে ভাবো কেন! আমি আছি ইন শা আল্লাহ থাকবো। আমাদের গন্তব্য হোক জান্নাত পর্যন্ত। হাজারটা হুর চাই না শুধু এবং শুধু তোমাকে চাই। এবার চলো যাওয়া যাক।”
অতঃপর অন্বেষার জবাবের অপেক্ষা না করে হাতখানা ধরে নিজেই হাসপাতালের নির্জন জায়গা ছেড়ে নির্দিষ্ট কেবিনে গেল সারফারাজ। আরেকদফা ছোট্ট রিফাতের সাথে দেখা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
______________
অন্বেষা ব্যালকনিতে ঠিকরে আসা সকালের নরম রোদে দাড়িয়ে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিল। কোমর সমান পানির স্রোতের ন্যায় আঁকাবাকা এক গুচ্ছ ঘন কালো কেশ ছড়িয়ে পড়লো পিঠময়। অন্বেষা টাওয়াল দিয়ে ভালো করে মুছে নিল। চুলে পানি বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা সর্দি লাগতে সময় নিবে না মোটেও। বেঘোরে প্রকৃতি দেখাই মগ্ন অন্বেষা নিজের ঘাড়ে ঘরম স্পর্শের অস্তিত্ব অনুভব করলো। শরীর জুরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল।
ঘুম জড়ানো স্বরে সারফারাজ বলল, “সকাল সকাল এখানে কি করছো বিবিজান? তোমাকে বলেছি না! আগামী সাত দিন শুধু আমার সামনে থাকবে। চোখ ভরে আমার শুভ্রময়ীকে দেখবো। তাহলে এখানে কেন?”
অন্বেষা বিরক্ত হলো সারফারাজের এমন খামখেয়ালি কথায়। বলল, “হ্যাঁ আমি আপনার সামনে থাকি আর আমার সব কাজ কে করে দিবে শুনি?”
“তোমার সব কাজ হওয়া উচিত আমাকে ঘিরে। বাকিটা আমার মা দেখে নিবে। বুঝেছো শুভ্রময়ী!”
অন্বেষা প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। তার স্বামী সাহেব এখন রোমান্টিক মুডে আছে। সে যতই যুক্তি দেখাবে তবুও সারফারাজ তার আজাইরা সিদ্ধান্তে অটল। সুতরাং স্বামীর সাথে অযথা তর্কে না জড়িয়ে পুনরায় সকালে শান্ত সিগ্ধ প্রকৃতি দেখাই মনোনীবেশ করলো। ছাড়া আর কিছু খুজে পেল না অন্বেষা। অন্যদিকে চললো সারফারাজের সকালের রোমান্টিক ডোজ। সে এখন নিয়মিত তার বিবিজানকে রোমান্টিক ডোজ দিয়ে পুষ্ট করে তুলছে। আর অতিষ্ট হচ্ছে অন্বেষা।
ইনশাআল্লাহ চলবে……