#ধারাবাহিক গল্প
#হৃদ মাঝারে রেখেছে তারে
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী
আমি আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে শুনেছি আমার শ্বশুর নাকি শাশুড়ীমাকে না দেখেই বিয়ে করেছেন। তারপর ও এতো ভালোবাসা। বিয়ের পর থেকে এক মুহুর্তের জন্য শাশুড়ী মাকে চোখের আড়াল করেননি। আমার শাশুড়ী মা ছিলেন আমার দাদাশ্বশুরের বন্ধুর মেয়ে। দীর্ঘ জীবনের চড়াই উৎড়াই, সাংসারিক টানাপোড়েন, কত অভাব অনটন এতো কিছুর পরেও কিভাবে এই প্রেম অটুট থাকে। আমি বুঝে পাই না। সময়ের স্রোতে এই প্রেমের বন্ধন এতটুকু ও হালকা হয়নি। বরং দিন দিন যেন এ বাঁধন আরোও মজবুত হয়েছে। অথচ আমি আর আরমান চারবছর ধরে নিজেদের মধ্যে জানাশোনা। আমিও আমার শ্বশুরের বন্ধুর মেয়ে। কিন্তু আরমানের প্রকাশভঙ্গীটা একদম অন্যরকম।
আমার শ্বশুর আমার শাশুড়ী মাকে বিয়ের পর কিছুদূর পড়িয়েছেন। আমার শাশুড়ী মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে। তারপরে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে। আমার শাশুড়ী মা সংসার সামলে পড়াশোনাটা আর আগাতে চাননি। কিন্তু শ্বশুরের কথা হচ্ছে মা শিক্ষিত না হলে সন্তান সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। মা নাকি সন্তানের প্রথম পাঠশালা।
এর মাঝে আরমানের মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করার অফার পেলো। ওর তখন বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমার চাকরি ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে আমি যাবো কি যাবো না এই নিয়ে আরমানের কোনো হেলদোল নেই। আরমানের আচরণে আমার শ্বশুর খুব অবাক হোন। উনি এ বয়সেও বউ ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারেন না অথচ উনার ছেলে হয়ে আরমান কিভাবে এতো নির্বিকার থাকে। অবশ্য আমিও অবাক হই যার বাবা এতো রোমান্টিক তার ভিতরে কেন রোমান্সের র টুকুও নেই। জেনেটিক ব্যাপার বলেও তো একটা কথা আছে। অথচ আরমানের মাঝে তাও অনুপস্থিত। অগত্যা একদিন বিকালে আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে বললেন,
—–সালেহা তোমার যেহেতু যোগ্যতা আছে তুমি চাকরি পাবে। কিন্তু যদি আরমানের সাথে একবার দুরুত্ব তৈরী হয় তাহলে সেটা আর কখনও আগের অবস্থায় ফিরবে না।
আমার শাশুড়ীর কথার সুত্র ধরে শ্বশুর আমাকে বললেন,
——পরিবেশ অনুকূলে থাকলে স্বামী স্ত্রীকে সবসময় কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতে হয়। কারণ কথায় আছে চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়ে যায়। তুমি ওর সাথে আমেরিকা চলে যাও। এবং তুমি একটা স্কলারশিপ ম্যানেজ করার চেষ্টা করো।
আমি উনাদের চিন্তা চেতনায় অবাক হলাম। ভাবলাম আমি চলে গেল উনারা এতো বড় বাড়িতে একা থাকবে। সেজানের ভার্সিটি থেকে আসতে সন্ধা হয়ে যায়। তাই শ্বশুরকে বললাম,
——বাবা আমি চলে গেলে আপনারা তো একা হয়ে যাবেন। তাছাড়া আরমান তো পিএইচডি শেষ করে দেশেই ফিরেই আসবে।
—–আমাদেরকে নিয়ে চিন্তা করো না। বুড়ো বুড়ি আছিতো একসঙ্গে। বরং আমার মনে হয় তোমার ওর সাথে যাওয়া উচিত।
শাশুড়ী মা তখন আমাকে বললেন,
—–আমি বলি কি সালেহা তুমি এ সময় একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। এই চারবছরে বাচ্চাটা বড় হয়ে যাবে। পাশাপাশি ওখানে জন্ম নেওয়ার সুবাদে সিটিজেন পাওয়া সহজ হবে।
—–মা, আমি দেশ ফেলে কোথাও যাবো না।
——তা, ঠিক আছে। তবে সময়ের সদ্বব্যবহার করতে জানতে হয়।
অবশেষে আমি আমার টাকা পয়সা গুছিয়ে নিয়ে ওর সাথে আমেরিকায় পাড়ি জমালাম। ওখানে আমার ছেলে সাদাফের জন্ম হয়। আমি আমেরিকা থাকতেই শুনেছিলাম সেজান নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। যদিও আমার শাশুড়ী এভাবে বিয়ে করাতে অনেক হার্ট হয়েছিলেন। তারপর আমার শ্বশুর বিয়েটা মেনে নিয়ে শাশুড়ীকে বলে,
——যে সংসার করবে তার যদি ভালো লাগে তাহলে আমাদের অমত করে কি হবে?
অতঃপর সেজান বউ নিয়ে বাড়িতে উঠে গেল। সেজান একটা সফটওয়্যার কোম্পানীতে জব করছে। বিয়ের বছরখানিকের মাথায় সেজানের মেয়ের জন্ম হয়।
তারপর হঠাৎ একটা খবর শুনে খুব আহত হই। আসলে আমার শাশুড়ী মা ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনার একটা সিভিয়ার অ্যাটাক হয়। আমার শাশুড়ী মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন কেবলই আরমানের পিএইচডি কমপ্লিট হয়েছে। আমাদের দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি চলছে। এর মাঝে খবর পেলাম সেজানের বউ রুহী ওকে ছেড়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছে। কারণ ওর বোন কানাডায় থাকতো। উনার চেষ্টায় রুহীর কাগজ হয়ে যায়। রুহীর বাবা মা আগেই ইমিগ্রান্ট হয়েছেন। সেজান রাগ করে রুহীর কাছে মেয়েটাকে দেয়নি। কারণ সেজানের কথা হচ্ছে দেশে তো ওরা ভালোই আছে। সবকিছু গোছানো। সেখানে চাকরি ছাড়া বিদেশে গিয়ে স্ট্রাগল করার কি দরকার? কিন্তু রুহীর কথা হচ্ছে ও ওর বাবা মা ভাইবোনকে ছেড়ে এদেশে একা পড়ে থাকতে পারবে না। সেজান ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলো শ্বশুর দিতে দেননি। তার কথা হচ্ছে এতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসার পথ বন্ধ করা ঠিক নয়। মা যেহেতু প্রথম থেকেই রুহীর ব্যাপারে নেগেটিভ ছিলো তাই ওর এই আচরণে প্রচন্ড শকড হোন। এ অবস্থায় আমি আর আরমান তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসি। উনার অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে যাওয়াতে আমার ভাসুর আর জা গাজীপুর থেকে ছুটি নিয়ে কল্যানপুরে চলে আসেন।
একমাস হাসপাতালে থেকে আমার শাশুড়ী মা না ফেরার দেশে চলে যায়। আমি ভাবলাম উনি আল্লাহপাকের কাছে চলে গেছেন কিন্তু যে মানুষটাকে দুনিয়াতে রেখে গেলেন তার কি হবে। তার দুনিয়াটা তো মরুভুমি হয়ে গেল। পয়ঁতাল্লিশ বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে উনার দিনগুলো কিভাবে পার হবে। স্মৃতির অনলে জ্বলতে জ্বলতে নাকি একরাশ শুন্যতা উনাকে গ্রাস করবে। কারণ স্মৃতিযে বড় বেদনা ময়। এতো স্মৃতি উনি ভুলবেন কেমন করে? যাকে একমুহুর্তের জন্য কখনও চোখের আড়াল করেননি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যে মানুষটাকে উনি হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী বানিয়ে রেখেছিলেন তার অনুপস্থিতে ঐ মানুষটার হৃদয়পুরটা যে বিষাদে ঢেকে রবে। সমস্ত রঙ বিবর্ণ হয়ে যাবে। আমার শাশুড়ী মায়ের কাছে শুনেছিলাম উনি যখন বাপের বাড়ি বেড়াতে যেতেন আমার শ্বশুরও সঙ্গে যেতো। এমনকি সন্তান ডেলিভারীর সময় উনি যে কয়দিন হাসপাতালে ছিলেন শ্বশুরও উনার সাথে থাকতেন।
আমি ভাবতে লাগলাম শাশুড়ী মাকে হারিয়ে এই ব্যথার সুনামী আমার শ্বশুর কিভাবে পাড়ি দিবেন। যদিও ছেলেরা বলেছিলো উনাকে বাসায় চলে আসতে। কিন্তু উনি আসেননি। শাশুড়ী মায়ের লাশের সাথে উনি বাসায় এসেছেন। তারপর যতক্ষণ লাশ দাফনের প্রস্তুতি চলছিলো ততক্ষণ চেয়ার নিয়ে লাশের পাশে বসেছিলেন। একমুহুর্তের জন্য উনাকে কেউ ওখান থেকে সরাতে পারেনি। কথায় আছে না অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। উনার অবস্থাটা সেরকম। এক ফোঁটা জল ও চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়েনি। কথায় আছে বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না। অনেক সময় দূরেও ঠেলিয়া দেয়। শুধু মাঝে মাঝে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। আত্মীয় স্বজন সবাই উনাকে নিয়ে কানাঘুষা করতে লাগলো। এতো বউ পাগল মানুষটা বউ ছাড়া কিভাবে থাকবে? যাইহোক তাড়াতাড়ি লাশ দাফনের জন্য প্রস্তুত করা হলো। লাশ দেশের বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়া হবে। ছেলেরা শ্বশুরকে যেতে নিষেধ করেছিলো। উনি নিষেধ মানেননি। লাশের সাথে উনিও কুমিল্লায় রওয়ানা হন। সেদিন খুব তাড়াতাড়ি উনারা কুমিল্লায় পৌঁছে যান। পারিবারিক গোরস্থানে উনাকে দাফন করার পর আমার শাশুড়ী মায়ের পাশের জায়গাটা উনি উনার জন্য বরাদ্দ করে রাখেন। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শ্বশুর ছেলেদের সাথে ঢাকায় ফিরে আসেন। তারপর উনার আচরণে আমাদের সবার ধাক্কা খাওয়ার যোগাড় হলো।
চলবে