#সুখের_খোঁজে৩
(বড় গল্প)
পর্ব ৩
‘আমাদের কখনো কিছু জানাসনি কেন, শায়লা? তুই একা এতো কষ্ট করছিস এতোটা দিন। রফিক কি সবসময়ই এমন ছিল?
– কি করতে শুনি? নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি, তুমি তোমার বিয়ে নিয়ে নয়ছয় করছো, মা বাবার মধ্যে সামান্য মিলটুকুও নেই; কার কাছে বলতাম এসব কথা? মা কে আর কত কষ্ট দেয়া সম্ভব ছিল বলতো আপা? ভালোই হয়েছে মা মরে গিয়ে। একটা জীবন শুধু সহ্যই করে গেলো। আর বাবাকে দেখো, দিব্যি বিয়ে করে সংসারী কদিন না যেতেই। যেন আমরা কোনদিন তার অস্তিত্বের কোন অংশই ছিলাম না।
মা বেঁচে থাকলে আমাদের জীবনটা হয়তো অন্যরকম হলেও হতে পারতো রে শায়লা। আমি দুবাই চলে গেলে অন্তত তোকে কিছু টাকাতো পাঠাতে পারতাম। রফিক তাহলে এতো অত্যাচার করার সুযোগ পেতোনা। বাবাও হয়তো দ্বিতীয় বিয়ে করতো না। আমাদের একটা নামকাওয়াস্তে পরিবারতো অন্তত থাকতো।
– আপা শোন, মেয়েলোকের জন্ম হয় পুরুষের সাথে মানিয়ে চলার জন্য। তুমি হাজারেও একটা পুরুষ পাবেনা যে মেয়েলোকের কথা মেনে চলে কিংবা অন্তত বোঝার চেষ্টা করে। মেয়েলোককে শাসন করাই তাদের কাজ। তাই রফিকের এসবে মানিয়ে নিতে শিখে গেছি দিনে দিনে। এটার জন্য আমরা মেয়েরাও দায়ী। নিজের ছেলেদের শেখাইনা কিভাবে মেয়েদের সম্মান করতে হয়। বরং তুমি ছেলে কাজেই তোমার সব কিছু ভালো পেতে হবে এভাবেই তাদের বড় করি। আর সময় হলে নিজেরাই ছেলের জন্য আরেকটা মেয়েকে ঘরে আনি, তাকে শেখাই মানিয়ে চলা। কিরকম দুমুখো চিন্তাভাবনা আমাদের ভেবে দেখো? জামাই জ্বালালে শাশুড়িকে দোষ দেই কিন্তু নিজের ছেলের ক্ষেত্রে আবার একই কাজই করি আর বৌ খারাপ বলে দোষ দেই। তুমি দুবাই গিয়ে যখন সংসার করতে তখন দেখতে বাদল ভাইয়েরও কত ইতিহাস বের হয়।’
দুপুরের খানাদানা শেষে বাচ্চারা যখন একটু ভাতঘুম দিত তখন দুবোন এজাতীয় দার্শনিক কথাবার্তায় মেতে উঠতাম। আসলে বলা ভালো নিজেদের কষ্টগুলোকে আড়াল করতাম নানা দার্শনিক কথার ভাঁজে ভাঁজে। রফিক যতক্ষণ বাসায় থাকতোনা নিজেদের মধ্যে একথা ওকথা বলে একটু করে ভুলে থাকতাম আর আগের রাতের শোনা কথার জ্বালা মেটাতাম মনে মনে ওর শাপশাপান্ত করে।
হামবড়া ভাবের কারণে কখনোই কারো সাথে সেভাবে বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি আমার; না স্কুলে না কলেজে। ঐ যে বললাম, আলগোছে অন্যদের নাক সিঁটকে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর। তবু জানা অজানা কতজনকে যে একটা চাকুরীর কথা বলেছি। সবাই দেখছি দেখবো বলে পাশ কাটিয়ে গেছে। একেকটা সকালে ঘুম ভেঙে আমার মনে হতো আরো একটা দিন বেঁচে থাকতে হবে? রাস্তা দিয়ে হাসিমুখে হেঁটে যাওয়া মানুষদের দেখে মনে হতো কিভাবে ওদের মনে এতো সুখ? নিজের সংসার না করতে পেরে আমি দুঃখে আছি, যে বোনের সংসার হয়েছে সে ও তো সুখে নেই; তাহলে ঐ রাস্তার লোকগুলো এতো সুখ কোথা থেকে পায়? একটা চাকুরী নয়তো একটা বিয়ে; অন্তত মাথা গোঁজার একটা নিরাপদ ঠাইয়ের জন্য আমি তখন পুরোপুরি দিশেহারা। রফিকের কথার অত্যাচার আমি আর সত্যিই নিতে পারছিলাম না।
কথায় বলে বাবা মারা গেলে লোকে এতিম হয়। আর আমরা এতিম হয়েছি আমাদের মায়ের মৃত্যুতে। বাবা বেঁচে থেকেও আমাদের জীবনে কোথাও নেই। আর মামারা সেই মায়ের মৃত্যুর পরই যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পাছে কোন দায়িত্ব না এসে পরে কাঁধে। তবু মনের ভুলে একদিন বড়মামা কিভাব যেন দাওয়াত দিয়ে ফেলেন আমাদের দুবোনকে। হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইশারাই ছিল ঐ রকম। সেই দাওয়াতে পরিচয় হয় শহীদের সাথে।
আগেই বলেছি আমরা তিনবোনই বেশ রূপবতী ছিলাম। কিন্তু মনের কষ্টের চাপে শরীরী রূপ যেন ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছিল রোজ। চোখের নীচের ক্লান্তি আর হতাশার কালো দাগ মুছতেই মামার বাড়ির দাওয়াতে একটু কড়া প্রসাধনীর সাহায্য নিতেই হয়। আর তাই যেন আমার জন্য শাপেবর হয়ে দাঁড়ায়। সপ্তাহ ঘুরতেই মামার কাছে শহীদ বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। অদ্ভুত হলেও সত্যি শহীদও ছিল দুবাইবাসী। যেন আমার ভাগ্য সৃষ্টিকর্তা লিখে দিয়েছেন বহুদূরের ঐ দুবাই শহরের সাথে। একটাই সমস্যা শহীদ বিপত্নীক। তার দুটো ছেলের দুটোই বাকপ্রতিবন্ধী।
মামা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ভাবতে বলেন। সত্যি বলতে কি আমি দ্বিতীয়বার কোন চিন্তা ও করিনি। আমার শুধু মনে হতো আমি নিজের দূর্ভাগ্যের সাথে ছোটবোনের দূর্ভোগও কেবল বাড়িয়েই চলেছি। অন্ধ বোবা কালাও যদি কেউ বিয়ে করার কথা বলে আমি তাতেও রাজী তখন। অন্তত রোজ রাতে নিজের স্বামীর কটুকথা শুনতেও আমি প্রস্তুত তবু রফিকের কথা আর না।
নিতান্তই আড়ম্বরহীনভাবে দু সপ্তাহের মাঝেই হয়ে যায় আমার আর শহীদের বিয়ে। শহীদের ছুটি ছিল এক মাস। এই একমাস ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরনীয় সময়। যেন দীর্ঘ কারাবাসের পর অপার মুক্তির আনন্দ। শহীদ ওর বাচ্চাদের জন্য অনেক আগেই আলাদা বাড়ি করে দিয়েছিল যেখানে ওর মা মানে আমার নতুন শাশুড়ি আর ননাস ওদের খেয়াল রাখতো। ছেলে দুটোকে আমি যত্ন করতে চেয়েছি কিন্তু ওরা ওদের বাবার দ্বিতীয় বিয়েটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। আমি নিজেই কি পেরেছি আমার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে? আমার অবস্থান শহীদের ছেলে দুটোর মতো হওয়াতেই বুঝিবা তাদের কষ্ট আমাকে দারুনভাবে নাড়া দেয়। কিন্তু আমারই বা কি করার ছিল? বেঁচে থাকতে হলে যে এই বিয়েটা করা ছাড়া আমার আর দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিল না।
বাদলের সাথে করা ভুল আমি শহীদের ক্ষেত্রে করিনি। আর তাই তিনমাসের মাথায় স্পন্সরের কাগজ পাঠানোর সাথে সাথেই আমি দুবাইয়ের পথে রওয়ানা দিতে দেরী করিনি এক মূহুর্তও। বিয়ের পরপরই শহীদের একটা ব্যাপার আমার নজরে পরে দারুনভাবে। সে ছিল ভীষণ কৃপণ ধরনের। এছাড়া সে আর অন্য সবদিকেই সহনীয় ছিল। আমি নিজেই বা কি এমন হাতিঘোড়া? বরং নিশ্চিন্তে থাকা খাওয়ার যোগাড় হয়েছে, প্রতি রাতে কারো অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে হচ্ছেনা, ছোট বোনটা অন্তত আমার জন্য কষ্টে থাকছেনা এটাই যে আমার জন্য তখন বিশাল পাওয়া।
কৃপণ আর হিসেবী এই শব্দ দুটোর মধ্যে যে আকাশ আর পাতালের ব্যবধান তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই দুবাই এসে। শহীদের এক কথা, সব টাকা যদি খেয়ে আর আয়েশ করে শেষ করে ফেলি তাহলে ভবিষ্যতের সম্পদ হবে কিভাবে? জীবনের এ প্রান্তে এসে শহীদের কষ্টের টাকায় গড়া বাড়ির ফ্লাটে বসে আমার খুব শহীদকে কবর থেকে তুলে বলতে ইচ্ছে করে, দেখোতো নিজে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে যে সম্পদ রেখে গেছো তোমার সেই সম্পদের ভোক্তারা কি সেটা বোঝে? সে যাই হোক মানুষের অসাধ্য নাকী কিছু নেই। আর তাই শহীদের সাথে থেকে থেকে আমিও দারুন হিসেব করা শিখে গেলাম। ছটাক পরিমাণ তেল দিয়ে কিভাবে সপ্তাহের রান্না সেরে ফেলা যায়, কিভাবে নানা লোকের বাসায় দাওয়াত খেয়েও নিজেরা পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে এক বা বড় জোর দুটো তরকারী দিয়ে সপ্তাহ পার করে ফেলা যায়; তিন মাসের মাথায় আমি মোটামুটি সেসব আয়ত্ব করে ফেললাম।
শহীদ যখন থেকে বুঝতে পারলো আমিও ওর মত হিসেবী হয়ে উঠেছি তারপর থেকে বাজার করার দায়িত্বও আমাকে দিয়ে দিল। অবাক হলেও সত্যি ও যে টাকা আমায় সপ্তাহের বাজারের জন্য দিত আমি কিভাবে কিভাবে যেন সেটা থেকেও কিছু সঞ্চয় করে ফেলতে লাগলাম। পরিমাণে সামান্য হলেও তা একটা ছোট বাক্সে জমা রাখতাম, শহীদকে একদিন চমকে দেব বলে। শহীদ সকাল সাতটায় বেরিয়ে যেত ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হতো। দুজন মানুষের সামান্য কিছু রান্না, আসবাববিহীন দু কামরার ঘর পরিস্কার করেও আমার হাতে অঢেল সময় থেকে যেত। দিন দিন বাজার করতে যাওয়া আসার পথেই পরিচয় হয় একই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের আরো কিছু মহিলার সাথে। তাদের মধ্যেই এক মালয়েশিয়ান মহিলার সাথে আমার দারুন সখ্যতা জমে ওঠে। ভাষাগত পরিবর্তনও আমাদের বন্ধু হওয়ার পথে অন্তরায় হয়নি। ও মাঝে মাঝে কোন কাজে গেলে ওর বাচ্চারা আমার কাছে থাকতো বা আমি ওর বাসায় যেয়ে ওর বাচ্চাদের রাখতাম।
কথায় বলে জীবনের নিয়মই হচ্ছে এতে চড়াই উৎরাই থাকবে। আমার নিস্তরঙ্গ জীবনেও সেই দিন এলো, তবে এক ভয়ংকর রূপে। আমি সেদিন বাজার নিয়ে মাত্রই ঘরে ঢুকে দেখি বসার ঘরের চেয়ারে শহীদ বসা।
– কি ব্যাপার, তুমি অসময়ে বাসায়? কোন সমস্যা?
‘কতদিন ধরে গোপনে বোনকে টাকা পাঠাস, শুনি?’
শহীদের হাতে মানি এক্সচেঞ্জের কাগজে রিসিভার শায়লা আক্তার নামটা যেন ব্যঙ্গভরে চেয়ে থাকে আমার দিকে আর বলে, ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়।’
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস
চলবে
পর্ব ২
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/permalink/2443171119061400/