#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
সারারাত বাচ্চার জন্য ঘুমাতে পারেনি তৃধা। বাচ্চা সামলানো সহজ নয় সেটা সে জানতো, তবে এতোটা হিমশিম এতোদিন পোহাতে হয়নি তাকে। বাচ্চা কিছুসময় তার কাছে, কিছুসময় মা বা ভাবীর কাছে ছিলো বিধায় সামলানো কিছুটা সহজ ছিলো। কিন্তু এখন একা বাচ্চাকে সামলাতে ভীষণ স’মস্যা হচ্ছে তৃধার। তেজবীনও সারারাত অন্য একটা রুমে ছিলো। আগবাড়িয়ে সাহায্য করা তো দূর বাচ্চার কান্না শুনে একটু উঁকি পর্যন্ত দেয়নি সে। যেখানে বাচ্চার বাবাই বাচ্চার প্রতি এতোটা উদাসীন সেখানে অন্যকারো কাছ থেকে সাহায্য পাবে এটা তৃধা আশা করেনা।
ক্লান্তি এবং চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়েও সকালবেলা উঠে পড়লো তৃধা। মেয়েকে বিছানায় শুয়ে পাশে ছোট দু’টো বালিশ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। প্রত্যেকটা রুমের দরজা বন্ধ দেখে সে বুঝতে পেরে গেলো এখনো কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। নিঃশব্দে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সে। দরজায় দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে রান্নাঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো৷ সম্পূর্ণ রান্নাঘরে চোখ বুলিয়ে তৃধা আর সামনে গেলোনা। পুনরায় রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। রুমে এসে দরজাটা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লো।
ঘুমের মাঝে হাতে টান পড়তেই ঘুম হালকা হয়ে গেলো তৃধার। কি হয়েছে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ তাকে টেনে তুলে ফেললো। ঘুম চোখে সবকিছু ঝাপসা দেখছিলো তৃধা। কয়েক সেকেন্ড চোখ জোড়া বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্থ করলো। এবার চোখ খুলতেই সে স্পষ্ট দেখতে পেলো। চোখ তুলেই তৃধা দেখলো তেজবীন দাঁত ক’টমট করে তার দিকে রা’গী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে এখনো তৃধার হাত শক্ত করে ধরে আছে। এতো জোড়ে ধরাতে তৃধার কিছুটা ব্য’থা লাগছিলো। তেজবীনের হাত সরাতে সরাতে তৃধা বললো,
” কি হয়েছে? হাত ছাড়ো, আমার লাগছে। ঘুম থেকে এভাবে কেউ টেনে তোলে? হুট করে ঘুম থেকে উঠা স্বাস্থ্যের পক্ষে বি’পদজনক জানোনা?”
তৃধার কথাগুলো যেন আ’গুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। তেজবীন তাকে তো ছাড়লোনা বরং আরো শক্ত করে ধরে সামনে টেনে নিয়ে এলো।
” বড্ড বাড় বেড়েছে না তোর? বাচ্চা জন্ম দিয়ে নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করেছিস না? এতো বছর পর বাচ্চা জন্ম দিতে পেরেছিস কিন্তু তাও তো কোন কাজের না৷”
” তেজবীন নিজের মুখ সংযত রাখো। আমার মুখ খুলিও না। আমার কোন বাড় বাড়েনি বরং তোমরা আরো নিচে নে’মে গিয়েছো। কথায় আছে না যে যেমন, অন্যকে ঠিক তেমনিই ভাবে। আ….”
রা’গ সংযত করতে না পেরে তৃধার চুলের মু’ঠি ধরে টা’ন দিলো তেজবীন। আচমকা আ’ক্রমণে ব্য’থায় কেঁ’পে উঠলো তৃধা। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ধাক্কা দিয়ে তাকে সরাতে পারলো তৃধা।
” কি হয়েছে কি? সকালবেলা এই ধরণের অ’মানুষের মতো ব্যবহার করছো কেন?” প্রচন্ড রা’গ নিয়ে বললো তৃধা।
” তুই কি মনে করেছিস? তুই নবাবের ঝি এর মতোন শুয়ে থাকবি আর আমি তোকে আদর করবো? আমরা মা-বোন চাকরের মতোন তোর আর তোর মেয়ের সেবা করবে? বেশি বাড়াবাড়ি করলে না মা, ঝি দু’টোই লা’থি মেরে ঘর থেকে বের করে দেবো।”
তেজবীনর কথার ধরণের তৃধার প্রচুর রা’গ হচ্ছে।রা’গে গিরগির করে কাঁ’পছে সে।
” এভাবে কি দেখছিস? চোখ নামা, চোখ নামা বলছি। না হলে কলম দিয়ে চোখ অ’ন্ধ করে দেবো।” রা’গে তেজবীন কি বলছে হয়তো সে নিজেও বুঝতে পারছেনা৷ তৃধা বিছানা থেকে নেমে ধুপধাপ পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ এসেই সে দেখতে পেলো ফাতেমা বেগম এবং নন্দিনী অসহায়ের মতোন চেহারা করে সোফায় বসে আছে, তিথি নিজের মতোন টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে৷ তিথির দিকে মনোযোগ না দিয়ে তৃধা শাশুড়ী এবং বড় ননদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
” কিছুদিন ছিলাম না এরমধ্যেই রান্নাঘরটা আর রান্নাঘর নেই৷ পুরো গো’বরখানা হয়ে গিয়েছে। আমাকে নিয়ে তো আপনাদের খুব সমস্যা, আমার কোন কিছুই আপনাদের পছন্দ হয়না। তাহলে কোন আক্কেলে আশা করেন যে আমি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে, ছোট বাচ্চাকে একা রেখে রান্না করতে যাবো? আমাকে নিয়ে যখন আপনাদের খুব সমস্যা তখন নিজেদের কাজ নিজেরা করুন। আর কেউ যদি না পারে তাহলে সে যেতে পারে। তার যাওয়ার রাস্তা সবসময় খোলাই থাকে। সাথে আরো কেউ গেলে মানা করবোনা, বরং এগিয়ে দিয়ে আসবো।”
এরপর তৃধা তেজবীনের সামনে এসে দাঁড়ালো। টেবিল থেকে কাঁটা চামচটা নিয়ে তেজবীনের চোখে চোখ রেখে বললো,
” কলম দিয়ে তুমি আমাকে অ’ন্ধ করবে তার আগেই আমি কাঁ’টা চামচ দিয়ে তোমার চোখ তু’লে মারবেল খেলবো৷ আর কথায় সংযম রাখার চেষ্টা করো৷ নাহলে পরবর্তীতে আমার মুখতো খুলবেই, সাথে তোমার জিহ্বা আর আ’স্ত থাকবেনা।”
শব্দ করে চামচটা টেবিল রেখে রুমে চলে এলো তৃধা। তৃধার এরূপ দেখে সবাই থমকে গেলো। নন্দিনী নিচুর স্বরে চেচিয়ে বললো,
” ও খোদা এই মেয়েতো দেখছি স’ন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করছে! কিভাবে খু’নীরদের মতো কাঁ’টা চামচ উঁচিয়ে কথা বললো৷ এই মেয়ে তো বড়ই বি’পদজনক! কখন না জানি কখন ঘুমের মধ্যেই আমাদের মে’রে ফেলে ঠিক নেই। তেজবীন তুই কিছু কর, বেশি বাড় বেড়ে গেলে তোরই ক্ষ’তি।”
তেজবীন শুধু শুনেই গেলেই, প্রতিউওরে কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো৷ খাওয়া তিথি অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলো। তেজবীন বেরিয়ে যেতে সেও তার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ফাতেমা বেগম এখনো শক্ত হয়ে বসে আছেন। ভ’য়ে ওনার কলিজা এখনো কাঁ’পছে।
.
.
শুক্রবার বিদায় আজ সবাই বাড়িতেই আছে। ররিবার থেকে তৃধাকে পুনরায় অফিসে যেতে হবে, তাই আজ থেকেই সে সব গুছিয়ে রাখছে। রান্না শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। অত্যাধিক গরমে ঘেমে নেয়ে একার তৃধা। সে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গোসলের উদ্দেশ্য যাবে তখনই তিথি এসে দাঁড়ালো।
” ভাবী, বাবুকে এখন তুমিই রাখো। আমাকে এখুনি বাইরে যেতে হবে।”
” আর কিছুটা সময় রাখোনা না বোন। আমি একটু গোসলটা করে আসি। বেশিক্ষণ লাগবেনা, গায়ে পা ঢেলেই চলে আসবো।”
কিন্তু তিথি সম্পূর্ণ কথা না শুনেই বাচ্চাকে তৃধার কোলে রেখে দিয়ে বললো, ” সরি ভাবী, আমাকে এখুনি বের হতে হবে। আমার ফ্রেন্ড’সরা সবাই রাস্তায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি অন্যকারো কাছে রেখে গোসল করতে যাও। আমি আসছি, দরজা বন্ধ করে দাও।”
তিথি তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলো। তৃধা হতাশাভরা মুখ নিয়ে দরজা বন্ধ করে ভাবতে লাগলো এখন কি করবে? বাচ্চাকে সে ভুলেও শাশুড়ী আর বড় ননদের কাছে রাখবেনা। সে এতোটাও বোকা নয় যে শে’য়ালকে বলবে মুরগী পাহাড়া দিতে।
” তুমি এখন কোথাও যাবে?”
” কেন?” ফোনের দিকে তাকিয়ে উওর দিলো তেজবীন। তার উওর শুনে তৃধা ভীষণ বিরক্ত হলো। তেজবীন সবসময় এরকম করে। কিছু জিজ্ঞেস করলে সোজাভাবে উওর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করবে। তৃধা কোনকথা না বলে বাচ্চাকে তেজবীনের কোলে দিয়ে দিলো। তৃধার আচমকা কাজে তেজবীন ভড়কে গেলো এবং না চাইতেও মেয়েকে আগলে ধরলো।
” এটা কি ধরণের অ’সভ্য’তামি তৃধা? দেখছো আমি কাজ করছি, সেখানে তুমি হুট করে একে কোলে কেন দিলে? এখন যদি পড়ে যেতো তখন তো আরেকটা নাটক শুরু করতে।” রা’গী কন্ঠে বললো সে। তেজবীনের কথায় তৃধার মনোযোগ না দিয়ে জামা-কাপড় ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।
” আমি গোসল করতে যাচ্ছি। ততক্ষণ তুমি বাচ্চার খেয়াল রেখো। আমি যেন এসে মেয়েকে তোমার কাছেই দেখতে পাই। উল্টোপাল্টা কিছু হলে কিন্তু খবর আছে।”
তৃধা চলে গেলো, এদিকে তেজবীন পড়লো বি’পদে৷ এখন সে কি করবে? তৃধা বাথরুমের দরজা হালকা খুলে দৃশ্যটা দেখে হাসলো।
অবিশ্বাস্য হলেও বাবা হওয়া স্বত্তেও এতোদিন পর আজই প্রথম তেজবীন নিজের মেয়েকে ছুঁয়ে দেখেছে, তাকে কোলে নিয়েছে। তৃধা আজ মন ভরে অনেকক্ষণ গোসল করবে। এতে তার ক্লান্তিও দূর হবে আর গোসলের অজুহাতে মেয়েও বাবার কাছে বেশ সময় থাকবে।
চলবে……..