#বসন্তের_একদিন (সিজনঃ০২)
#পর্বঃ০৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
মেয়েকে নিয়ে চুপচাপ একপ্রকার জড় হয়ে বসে আছে তেজবীন৷ আগে কখনো বাচ্চা কোলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে সে ভিষণ ভয়ে আছে যদি পড়ে যাই৷ কথায় আছেনা রক্তের টান সবচেয়ে বড় টান। তাই তেজবীন যতই বাচ্চার প্রতি উদাসীন থাকুন না কেন, আজ মেয়েকে এতোটা কাছে পেয়ে রক্তের টানে নিজের অজান্তেই মেয়ের খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে।
তাদের সাথে মিল রেখে তৃধা মেয়ের নাম দিয়েছে তন্বী। তেজবীন ভেবে রেখেছিলো তাদের ছেলে বাবু হলে “তন্ময়” নাম দেবে। তেজবীন অনুমান করছে হয়তো সেখান থেকেই মেয়ের নাম দিয়েছে তৃধা।
তন্বী বাবার কোলে শান্ত বাচ্চার মতো শুয়ে আছে। তেজবীন বেশ মনোযোগ সহকারে মেয়েকে দেখছে। মুখে আঙ্গুল দিয়ে, ছোট ছোট পা নাড়িয়ে, গোল গোল চোখে সেই তখন থেকে তাকে দেখেছে চলেছে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে। ভালো লাগছে তেজবীনের, তাই সেও বাঁধা দিচ্ছেনা। পিতা হিসেবে অনুভব করছে এই মূহুর্তটাকে। কি মনে করে যেন একটা আঙ্গুল দিয়ে তন্বীর গাল ছুঁয়ে দিলো। বাবার স্পর্শ পেতেই তন্বী হেঁসে ফেললো এবং খপ করে তেজবীরের আঙ্গুলটা ধরে ফেললো। সে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো তবে তন্বী ছাড়লোনা। অনেক শক্ত করে ধরে রাখলো। যেন সে আকারে-ইঙ্গিতে বলছে,
” এবার যখন পেয়েছি, তোমাকে আর যেতে দেবোনা। অনেক পালিয়ে বেরিয়েছো, এখন তুমি শুধু আমার কাছেই থাকবে।”
কিছুক্ষণ টানাটানির পরেও যখন তন্বী আঙ্গুল ছাড়লোনা তখন তেজবীনেরও আর বেশি জোড় করতে ইচ্ছে করলোনা।
বেশকিছু একটানা একিভাবে বসে থাকার ফলে এবার তেজবীনের কোমড়ে ব্য’থা হতে শুরু করলো। মেয়ে ব্য’থা পেতে পারে এই ভয়ে সে নাড়াচাড়াও করছে না।
নন্দিনী দরজার সামনে দিয়ে যেতেও এই দৃশ্যটা দেখে থমকে গেলো। সে অবিশ্বাস্য চোখে তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। হুশ আসতেই একপ্রকার দৌড়ে রুমে ঢুকে পড়লো।
” বাবু তুই এটা কি করলি! মা না তোকে বারণ করেছিলো এর থেকে দূরে থাকতে? বলেছিলো না এই বাচ্চা তোর ক্ষ’তি করবে? আর তুই কিনা একে এখন কোলে নিয়ে বসে আছিস! হে খোদা এটা তুই কি করছি বাবু?”
” আপু তুমি এসব কথা বাদ দিয়ে আগে বাচ্চাটাকে আমার কোল থেকে নাও। আমি একটু ঠিক মতো বসি, আমার কোমড়ে ব্য’থা করছে।”
” না না আমি পারবোনা। এই অলুক্ষুণেকে ছুঁলে যদি আমার কোন ক্ষ’তি হয় তখন? না না বাবা, আমি এই রিস্ক নিতে পারবোনা। তুই ছুঁ’ড়ে বিছানায় ফেলে দে, ম’রবেনা।”
তেজবীন তার বোনের কথার ধরণ জানে, তাই বাড়তি কোন কথা না বলে অনেক সাহস করে তন্বীকে নিজের কোল থেকে সরিয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো। বুদ্ধি খাটিয়ে পাশে দু’টো বালিশ দিয়ে ঘোরাও করে দিলো যেন না পড়ে যায়। এতোক্ষণে তেজবীনের নিজেকে মুক্ত মনে হলো৷ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে হাত-পা গুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
” কিরে আমার কথার উওর দিচ্ছিস না কেন? মা তোকে কি বলেছে মনে নেই? দরদ লাগছে নাকি? এতো দরদ দেখিও না, বিপ’দে পড়লে দূরবীক্ষণ দিয়েও তাদেরকে খুঁজে পাবে না। তখন আমাদের কাছেই আসতে হবে।”
” আপু আমি মোটেও নেইনি৷ তৃধাই হুট করে আমার কোলের উপর দিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।”
” তো তুই হাবার মতো নবাবজাদীর ঝি’টাকে কোলে নিয়ে বসে রইলি কেন? ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে যাইতি।।”
” আপু তুমি প্লিজ থামো। আমি তো আর এতোটাও নির্বোধ নয় যে এতো ছোট বাচ্চাকে একা রেখে বেরিয়ে যাবো। যদি পড়ে গিয়ে কিছু হয় তখন না চাইতেও আমার আফসোস হবে, অবচেতন মন বারবার বলবে আমার ভুলের কারণে ব্য’থা পেয়েছিলো। এসব যেন না হয় তাই আমি পাহারা দিয়ে রেখেছি।”
” এবারের মতো মেনে নিলাম এরপর থেকে যেন আর না হয়।” একপ্রকার হুকুম করে বললো নন্দিনী। পরক্ষণেই তেজবীনের কাঁধে হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
” দেখ বাবু আমরা তো তোর আপনজন। মা, আমি কখনো কি তোর খারাপ চাইবো বল? আমারা তো তোর ঘরের মানুষ, তোর ক্ষতি তো আমরা চাইতে পারিনা। কিন্তু তোর বউ তো পরের ঘরের মেয়ে, তোর ক্ষ’তি করতে তার বুক কাঁপবেনা। ও চাইছে বাচ্চাকে ব্যবহার করে তোকে ব’শ করতে। তুই ওর ফাঁদে পা দিস না। বাচ্চাটা থেকে দূরে দূরে থাক।”
নন্দিনীর কথা শুনে তেজবীন একপ্রকার ঘোরে চলে গেলো।
” এখন কি নিজের মেয়েকে কোলে নিতেও আপনাদের অনুমতি নিতে হবে?”
আচমকা তৃধার কন্ঠ শুনে তেজবীন এবং নন্দিনী দু’জনেই চমকে উঠলো।
” কি হলো বলুন? তেজবীন আমি জানতাম তুমি কাপুরষ কিন্তু এতোটা ব্যক্তিতহীন, মেরুদণ্ডহীন তা তো জানতাম না। তোমার কি নিজের বিবেকেও লাগেনা তাদের অন্যায় আবদার মেনে নিতে?”
” এই মেয়ে আমরা ভাই-বোন কথা বলছি তার মাঝে তুমি নাক গলাচ্ছো কেন?”
” আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যপারে তাহলে আপনারা নাক গলাচ্ছেন কেন? বাবা তার বাচ্চাকে কোলে নেবে কি নেবে না, তার যত্ন নেবে কি নেবে না তা বলে দেওয়ার আপনি কে? নিজের সীমার মধ্যে থাকুন।” চোখ রাঙিয়ে বললো তৃধা। এবার তেজবীনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” তোমার কাছে তোমার মা-বোন যেমন আপন, তেমনি আমার কাছে আমার পরিবারও আপন। তুমি তোমার পরিবারকে মাথায় তুলে রাখতে পারলে আমি কেন পারবোনা? শোন তেজবীন শুধু তোমার মা-বোনই তোমার আপন আর আমরা ফেলনা এমনটা এবার ভাবা বন্ধ করো। জীবনে মা-বোন যেমন গুরুত্বপূর্ণ স্ত্রী সন্তানও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। তোমার মা তোমাকে জন্ম দিয়েছেন, বোন হয়তো তোমাকে লালন-পালন করেছে তেমনি তোমার স্ত্রী তোমাকে পরিপূর্ণ করেছে৷ কারো জন্য কাউকে নিচু করোনা। অন্যের চোখ নিয়ে নয় নিজের চোখ দিয়ে আশপাশটা দেখো, ঠিক ভুল দেখার চেষ্টা করো। কারোর কথার উপর বিশ্বাস করে অন্ধের মতো চলাফেরা করোনা।”
কিছুসময় চুপ থেকে আবারো সে বললো,
” দরজা খোলা আছে, কেউ রুম থেকে গেলে আমি খুশি হবো।”
তৃধার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে নন্দিনী ধপধপ শব্দ করে বেরিয়ে গেলো।
তেজবীন তখনো থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তৃধার ডাকে সারা না দিলে তৃধা তাকে হালকা ধাক্কা দিলো।
” কি হয়েছে?”
” কোথায় হারিয়ে গেলে? ডাকছি শুনছো না?”
” কিছু না।” বলেই তেজবীন বেরিয়ে গেলো। কিছুদিন ধরে তেজবীনের আচরণ তৃধার কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগছে৷
ভীষণ রেগে নিজে নিজে বিরবির করছে নন্দিনী। তা দেখে ফাতেমা বেগম পান চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে নন্দু? খুশী মনেই তো দেখলাম কিছুক্ষণ আগে, এখন আবার মুখটা এরকম করে রেখেছিস কেন?”
” এরকম কি আর সাধে করে রেখেছি? নবাবের ঝি বাড়ি আসার পর থেকে আগের থেকেও বেশি ফটরফটর করছে। মুখ আগের থেকেও বেশি খুলে গিয়েছে। কিছু বললেই ছ্যাঁত করে উঠে। আজ তো তিনি আরেকটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন।”
” আবার কি করেছে ফ’কি’রের বা’চ্চাটা?”
” সে নিজের ঝি’কে আজ তেজবীনের কোলে তুলে দিয়েছে। আর তেজবীনও ওই বাচ্চাকে নিয়ে আদর-সোহাগ করছে।”
” কি!” নন্দিনীর কথা শুনে ফাতেমা বেগম ভীষণ চমকে গেলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” কি বলছিস তুই? বাবুকে না আমি মানা করেছি ওর কাছে না যাওয়ার জন্য?”
” কিন্তু তোমার বাবু তোমার কথা পাত্তা না দিয়ে আজ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে৷ আমি যখন ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনই দেখলাম। আমি তেজবীনকে বোঝাচ্ছিলাম তখনই তোমার বউ এসেছে কথা শুনাতে লাগলো। এসবের জন্যই তো মে’জা’জ গরম হয়ে আছে।”
” কিন্তু এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিলোনা। বাবু তো আমার কোন কথা অমান্য করার কথা নয়।”
” আমি জানিনা কিছু। যা করার তুমিই করো, কোথায় কি হয়েছে সেটা খুঁজে বের করে তাড়াতাড়ি আবার আমাদের দিকে নিয়ে এসো।”
চলবে……..