#কুয়াশা_মিলিয়ে_যায়_রোদ্দুরে
#পর্ব_১৭
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“কুয়াশা তিন্নির মেয়ে হয়েছে। কিন্তু!”
“কিন্তু কী? আপু ঠিক আছে তো মা?”
“তিন্নির শারীরিক অবস্থা ভালো না। ওকে র ক্ত দিতে হবে।”
“র ক্ত পাওয়া যায় নি?”
“না। কুয়াশা সমস্ত মান-অভিমান ভুলে তুমি আজই বগুড়ায় এসো। তোমার আর ওর র ক্তে র গ্রুপ এক। ওকে বাঁচাও তুমি!”
“আপু আমার সাথে কী কী করেছে সব ভুলে গেলে মা?”
“ভুলিনি রে মা। কিন্তু একজনের জীবন নিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি? দিন শেষে তিন্নি কিন্তু তোমার বোন। ওকে বাঁচানো দরকার। অন্তত ওদের মেয়ের জন্য ওর বেঁচে থাকা দরকার। তুমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসো। ডক্টরস ক্লিনিকের দ্বিতীয় তলায় আসবে।”
আর কিছু বলার সুযোগ পায় না কুয়াশা। তার আগেই কল কেটে যায়। কুয়াশার মুখে লেগে আছে তাচ্ছিল্যের হাসি। যে হাসি বলে দিচ্ছে,
“আমার ক্ষতি করে এখনো আমার সাহায্য দরকার তোমার। নিয়তি বুঝি একেই বলে? হয়তো তাই!”
খুব দ্রুত তৈরি হয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দেয় কুয়াশা। বিকালের বাসে উঠে রাত এগারোটার মধ্যেই ক্লিনিকে পৌঁছে যায় সে। আজ অনেক দিন পর সবাইকে একসাথে দেখছে সে। সবার মুখেই বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। কুয়াশা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সর্বপ্রথম তিন্নি আর ফয়সালের একমাত্র মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। অতঃপর ছোট্ট রাজকন্যার কপালে তার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে। বাচ্চার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখে হাসিমুখে বাচ্চাটাকে বুকে আগলে নেয় সে। ফয়সাল এসে কুয়াশার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ স্বরে বলে,
“কুয়াশা তিন্নিকে বাঁচাও। ওর অবস্থা অনেক খারাপ। এই মুহূর্তে একমাত্র তোমার র ক্ত ওকে বাঁচাতে পারবে। নতুবা ওও শেষ হয়ে যাবে।”
কুয়াশা শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
“কোথায় যেতে হবে সেখানে নিয়ে চলুন আমাকে। আমি প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।”
ফয়সাল দ্রুত কুয়াশাকে নিয়ে চলে যায়। একটা বেডে তাকে শুইয়ে দিয়ে তার শরীর থেকে র ক্ত নেওয়া হয়। সেই র ক্ত তিন্নির শরীরে প্রবেশ করানোর পরেই সবাই চিন্তামুক্ত হয়। কারণ তিন্নির অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। আশঙ্কা অনেকটা কমে গিয়েছে। কুয়াশা চোখ বন্ধ করে ভাবছে,
“তোমার পাপের শাস্তি পাওয়া হয়তো এখান থেকেই শুরু আপু। এটা কেবল শুরু হলো। ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেকভাবে তুমি বুঝতে পারবে, তুমি আমার সাথে যা করেছ সেটা মারাত্মক অন্যায়। এই অন্যায় ক্ষমার যোগ্য নয়। তাই তোমাকে শাস্তি পেতেই হবে। আজ আমি তোমাকে বাঁচালাম। কারণ তোমার জীবন নিয়ে আমি প্রতিশোধ নিতে চাই না। আর বাচ্চাটা নিষ্পাপ। ওকে মা হারা করতে চাই না। তাই আমার র ক্ত দিয়ে আজ তোমাকে নতুন জীবন দিলাম আমি।”
নিজের মনে কথাগুলো বলে কুয়াশা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সে প্রচুর ক্লান্ত আজ। এখন তার বিশ্রামের প্রয়োজন। সারারাত ঘুমিয়ে ভোরে ঘুম ভাঙে কুয়াশার। পাশে তাকিয়ে দেখে মা বসে আছে।
“মা তুমি এখানে কী করছ?”
“তোমার পাশে বসে আছি। আমার মেয়েটা একদম ভালো নেই। তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে এটা।”
“মা জানো? রায়াদ বিয়ে করেছে।”
“কবে?”
“এইতো কিছু দিন আগে।”
“ওর কথা এখনো কেন মনে করো তুমি?”
“চাই না মনে করতে। কিন্তু চাইলেও কি প্রথম ভালোবাসা ভুলে থাকা যায় মা?”
“ওর মত ছেলেকে মনে রাখার কোনো দরকার নেই। ওকে যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে তত তাড়াতাড়ি নিজের জীবনে ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে।”
“শুধু রায়াদ নয়। তুরাবের কাজকর্ম আমাকে প্রতিনিয়ত খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি আর এসব মেনে নিতে পারছি না মা। আমিও মানুষ। আর কত সহ্য করব?”
“তোমাকে আমি বলেছিলাম এই কেস হাতে না নিতে। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনলে না। মলিও মানা করল। কারোর কথায় শুনলে না।”
“ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্য আমার পেশাগত জীবনকে তো হুমকির মুখে ফেলতে পারি না। আমিও এই কেস হাতে নিতে চাইনি। কিন্তু আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। না চাইতেও তুরাবের কেস আমাকেই নিতে হয়েছে।”
“এমন ছেলের সাথে আর কতদিন বিয়ের মত সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতে চাও তুমি?”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”
“কী সিদ্ধান্ত?”
“সময় আসলে সব জানতে পারবে। সবার আগে তোমাকেই জানাব। চিন্তা করো না মা। আমার কিছু হবে না। ভালো থাকব আমি। তোমার মেয়েকে আর কেউ কষ্ট দিতে পারবে না। এমনভাবেই নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি আমি।”
“আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। এবার তোমাকে কিছু খেতে হবে।তোমার শরীর অনেক দুর্বল।”
“আপু কেমন আছে?”
“এখন ভালো আছে।”
মা-মেয়ের কথা বলার এক পর্যায়ে কুয়াশার মামি অর্থাৎ তিন্নির মা সেখানে চলে আসেন।
“কুয়াশা মা এখন কেমন আছিস?”
“ভালো আছি মামি।”
“শরীর কি অনেক দুর্বল লাগছে?”
“খুব বেশি না। ঠিক আছি আমি।”
“তিন্নি তোর সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছে। তুই কি একবার ওর কাছে যাবি?”
“না মামি। আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি, ওর কাছে যাওয়ার জন্য আমাকে কেউ জোর করবে না।”
“একবার!”
“এই মুহূর্তে আর কথা বলতে ভালো লাগছে না আমার। আমি আর একটু বিশ্রাম নিতে চাই। তোমরা এখন আসতে পারো।”
কথাটা বলে নিজের চোখ দু’টো বন্ধ করে নেয় কুয়াশা। মেয়ের এমন আচরণ দেখে আর কিছু বলেন না মিসেস নাহার। তার মেয়ে যা চায় তাই হবে। তাই নিজের ভাইয়ের বউকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি।
কুয়াশার সারাদিন চলে যায় ক্লিনিকে। সন্ধ্যায় কিছুটা সুস্থবোধ করায় নিজের বাড়িতে চলে আসে সে। এসে সবার আগে সাফওয়ানকে কল দেয়। রিং হওয়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে সাফওয়ান কল রিসিভ করে। যেন এতক্ষণ সে কুয়াশার কলের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কুয়াশা কেমন আছ তুমি? শরীর কি এখনো দুর্বল লাগছে?”
“না। আমি এখন ভালো আছি।”
“ঢাকায় ফিরবে কবে? এদিকে তো তুরাবের কেস কোর্টে উঠবে আগামী পরশু। সেখানে তোমাকে থাকতে হবে।”
“আমি আগামীকাল ফিরে যাব। তুমি চিন্তা করো না।”
“তোমাকে আরো একটা খবর দেওয়ার ছিল।”
“হ্যা বলো।”
“আমাদের একটা পুরোনো বাড়ি আছে। ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে। এখন ফাঁকা পড়ে আছে। আগে ওখানে আমার দাদুবাড়ির লোকজন থাকত। এখন যেহেতু কেউ থাকে না, তাই আমি চাই ওই বাড়িতেই বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করতে। বাড়িটা অনেক বড়ো। একপাশে বৃদ্ধাশ্রম আর অন্য পাশে এতিমখানা বানালে কেমন হবে?”
“বাহ্! এটা অনেক ভালো হবে। কিন্তু তোমার পরিবার রাজি হবে?”
“আমি উনাদের থেকে অনুমতি নিয়েছি। এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি রাজি থাকলে আমি আগামীকাল থেকেই বাড়ির কাজকর্ম শুরু করতে চাই।”
“আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে খরচ আমি বহন করব। এতে না করতে পারবে না তুমি।”
“আচ্ছা আমরা দু’জন মিলে সমাম সমাম করে দিব। এবার ঠিক আছে?”
“হুম।”
“খেয়েছ?”
“হ্যা৷ তুমি?”
“আমি খাব একটু পর। অনেক কথা হলো। এখন তুমি ঘুমাও। তোমার আরো বিশ্রামের দরকার।”
“রাখি তাহলে।”
“সাবধানে থেকো। শুভ রাত্রি।”
“শুভ রাত্রি।”
সাফওয়ানের সাথে কথা বলা শেষ করে কুয়াশা ফোন একপাশে রেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। আজ বেশিক্ষণ ভাবনার জগতে থাকতে পারল না সে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে কুয়াশার।
অন্যদিকে তিন্নি যখন থেকে শুনেছে যে কুয়াশা তাকে র ক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে কুয়াশার সাথে কথা বলার জন্য তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু কুয়াশা তার সাথে কথা বলতে চায় না, এই কথাটা শুনে তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। তার মনের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে প্রচন্ড পরিমাণে অস্থিরতা কাজ করছে!
চলবে??
বিঃদ্রঃ ঘুম ঘুম চোখে লিখেছি। তাই লেখা অগোছালো মনে হলে আজকের মত আমাকে মাফ করে দিবেন।