#আড়ালে_অন্তরালে
সূচনা পর্ব__
সদর দরজাটা খোলাই ছিল, তর সইলো না রাশেদা বেগমের, বাহির থেকে ঘরে ঢুকেই বে ধ ড় ক মা র তে শুরু করলেন মায়াকে। তার অপরাধ দরজা খুলতে সামান্য দেরী হওয়া। বারবার করজোড়ে মিনতি করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে ওয়াশরুমে ছিলাম ছোট মা কিন্তু রাশেদা বেগম তা শুনবেন কেন? গলাটা আরো চ ড়ি য়ে বললেন – আপদটা
ম রে রেখে গেছে আরেক আপদকে। সতীনের মেয়ে তো সবসময় আমার ক্ষতিই চাইবি, বুঝিনা ভেবেছিস?
পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে দুয়েকজন উঁকি দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে নিজের মতই রইলো, কেউ ছাড়াতে এলোনা কারণ প্রতিদিন এটাই হয়।
ক্লান্ত হয়ে মায়াকে ছেড়ে দিয়ে রাশেদা বললেন তাড়াতাড়ি পানি আন, গলা শুকিয়ে গেছে।
শরীরে মা রে র তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তড়িঘড়ি করে পানি আনতে ছুটলো মায়া।
– ছোটমা! পানি।
মায়ার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন দরজাটা এখনো লাগাসনি কেন? তোর ম রা মা এসে লাগাবে নাকি?
প্রতিবাদ না করে দরজাটা বন্ধ করতে এগিয়ে এলো মায়া। কাউকে নিচে নেমে যেতে দেখলো সে, অবয়বটা সে চিনে মনে হলো পরক্ষণে সেসব চিন্তা বাদ দিয়ে দরজা আঁটকে ভেতরে চলে গেল। মায়া বুঝতেও পারলো না তার উপর হওয়া এই অ ত্যা চা র আজ কেউ একজন প্রত্যক্ষ করেছে, সে শীঘ্রই তাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চায়।
____
নিজের ঘরে এসে ফাহিম বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই মনে পড়লো সেই মেয়েটার উপর অ ত্যা চার করা দৃশ্য। চুলের মুঠি ধরে ধূমধাম মা র।
ফোনটা হাতে নিয়ে কল লাগালো বন্ধুর ফোনে..
দুটা রিং হওয়ার পর রিসিভ করে ওপাশ থেকে মিলন বলল – বল দোস্ত।
– শোন, ভণিতা ছাড়াই বলছি। তোদের বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় বাম পাশের ঘরটায় আজ দেখলাম একটা মেয়েকে তার ঘরেরই কেউ বে ধ ড় ক পিটাচ্ছে। ঐ মেয়েটা….
ফাহিমের কথাটা শেষ হবার আগেই মিলন বলল
– তুই কি কোনভাবে মায়ার কথা বলছিস? আসলে এ বিল্ডিংয়ে এমন মা র ওকেই দেয় ওর সৎমা। বে ডি মানুষ না ডা ই নী।
ফাহিম কথাটা শুনে বলল – মেয়েটা দেখতে সুন্দর।
ওকে আমার চাই। বউ করে আনবো, কি করতে হবে?
মিলন বন্ধুর কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল – আজকাল বেশ রোমান্টিক হয়ে যাচ্ছিস, ভুলে যাস না তুই কি করিস।
– আমার জানা আছে আমি কি করি। তুই শুধু আমাকে বল মেয়েটাকে ওখান থেকে উদ্ধার করতে হলে বিয়ে ছাড়া আর কোন উপায় আছে? নাইতো। তাহলে!!
ফাহিমের সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো মিলন। ছোট্ট করে বন্ধুকে বলল – আরেকটু ভেবে দেখি, সাবধানের মা র নেই।
ফাহিম হাসতে হাসতে বলল – আরে একটা মেয়ের উপরও তোর সন্দেহ হয়? তুই ইলিউশনে ভুগছিস।
ফাহিমের কথায় হালকা হেসে মিলন প্রত্যোত্তর করলো না। কলটা ডিসকানেক্ট করে দিল।
কিছু একটা মনে হতেই মিলন এবার তড়িঘড়ি করে কল লাগালো ফাহিমের নাম্বারে।
কলটা রিসিভ করেই ফাহিম বলল – তুই ঠিকই ধরেছিস, আমার কোন ম ত ল ব আছে এই সিদ্ধান্তের পেছনে।
মিলনকে বাড়তি কিছু বলতে না দিয়ে কলটা ডিসকানেক্ট করে মুঠোফোনটাকে হাত থেকে রেখে দিলো সে।
___
– স্যার, আমরা যাকে খুঁজছি তার শারীরিক গঠনটা কেন যেন নারীদের মতো মনে হয়। আমার খুব করে মনে হয় আমাদের উপর নজর রাখা মানুষটা কোন মেয়ে।
ফোনে কথাটা শুনে অপরপাশের মানুষটা বলল – তার পদক্ষেপ মেপে আমরা পা ফেলবো, টেনশন করার কিছু নেই।
– জি স্যার।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বড় কাগজটা বের করে মুরাদ হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সাত ফুট দেয়াল টপকে অনায়াসে পালিয়ে যাওয়া মানুষটা ছেলে না মেয়ে তা নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। কোন ক্লু নেই। তার সম্বন্ধে কেউ জেনে গেলে তো তাকে আবার রূপ বদলাতে হবে।
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখলো মুরাদ। চুল আর দাঁড়িগুলোতে একটু হাত লাগাতে হবে। রহস্যেভরা লোকটা নিজের চুলে হাত বুলিয়ে শান্তমনে বললো – আজ থেকে তোদেরও হারাতে হবে। সময় হলে আবার ফিরিয়ে আনবো।
– অভিকে পাঠিয়ে দে, দশ মিনিটে আসতে বল। নয়তো দেরী হয়ে যাবে।
– জ্বি স্যার।
___
রাস্তার ধারে বসে থাকা ভাসমান মানুষগুলো দেখে মায়ার মনে হলো তাদের মতো হলেও জীবনটা বেশ ভালো লাগতো কিন্তু সৎমায়ের সংসারে সে কষ্টে আছে, কেউ কেন তাকে নিয়ে যায়না!
পাশের চা দোকানে থাকা টেলিভিশনের আওয়াজটা কানে এলো মায়ার।
– আঠার বছরের এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হ ত্যা করেছে তিন যুবক। তরুণীর মৃ ত দে হ পুলিশ জঙ্গলের ভেতর থেকে উদ্ধার করেছে। সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো বরাবরের মতো এবারও ধর্ষকদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ঐ তিন যুবকের বাসস্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তারা রাতে বাড়ি এসেছিলো, মধ্যরাতে কারো কল পেয়ে ঘরের বাইরে আসার পর আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে নি হ ত তরুণীর ছোটবোনের লা শ সিলিং ফ্যানের সাথে ঝু ল ন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
আর শুনতে পারলো না মায়া, খুব কষ্ট হচ্ছে তার। চা দোকানে বসে থাকা লোকগুলোও আফসোস করছে।
___
– স্যার, লোকগুলো আনা হইছে।
– কোথায় আছে?
– মিনহাজের কাছে, তাদের চেহারায় পরিবর্তন আনার জন্য মিনহাজ একটু চেষ্টা করছে।
কথা আর বাড়ালো না মুরাদ। তার চোখে ভেসে উঠেছে র ক্তা ক্ত সেই ক্ষ ত বি ক্ষ ত দেহটা। যাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল আমি এমন পাপীদের ছাড়বো না। মুরাদের চোখজোড়ায় লাল বর্ণটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সুস্থ সুন্দর জীবনটা ছেড়ে এ জীবনে আসা খুব কষ্টের ছিলো। এখন সয়ে গেছে। কিন্তু তবুও তার যাত্রাটা খুব বন্ধূর। বারবার বাঁধা আসছে। বারবার নিজেকে ছদ্মবেশ দিতে হচ্ছে।
ভাবনার সীমানাকে ছোট করে উঠে দাঁড়ালো মুরাদ। হেঁটে করিডোরটার বামে এসে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। অচেতন তিনটে লোককে দেখে বলল – এখন থেকে কিছুই মনে থাকবে না তোদের, তোদের কোথায় এনেছি, তোরা কারা কিছুই মনে থাকবে না।
মিনহাজ হেসে বলল – ঐ মেয়েটার ছোট বোনের কি দোষ ছিলো। তাকে কেন সম্মোহিত করলি?
মুরাদ ঘাড় না ঘুরিয়েই বললো – আমার কাজের কৈফিয়ত কাউকে দিবোনা।
কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না মুরাদ। দ্রুত পদক্ষেপে স্হান ত্যাগ করলো। মূল ফটকের সামনে আসতেই মনে হলো দেয়াল টপকে কেউ ভেতরে আসছে। কালো গ্লাভস লাগানো হাতগুলো দেয়াল আঁকড়ে ধরেছে, মুরাদ কোন রি স্ক নিতে চাইলো না, নিচ থেকে ইটের টুকরোটা তুলে হাত বরাবর ছুঁড়লো। মুহূর্তেই হাতদুটোর কোন নিশানা দেখা গেলোনা আর। সেখান থেকে বের হলে ধরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা শতভাগ তাই আবারও ভিতরে গিয়ে অন্ধকার রুমটায় এসে ভাবতে লাগল কে হতে পারে? কেউ কি চিনতে পেরেছে? খোঁজ পেল কিভাবে? ভিতরের কেউ কি তথ্য হাওয়ায় ভাসাচ্ছে?
ড্রয়ার খুলে ডায়েরীটা বের করে মুরাদ দেখলো কে কে আছে তার লোক হিসেবে। কাউকে সন্দেহ হচ্ছে না তার। তবে এই গুপ্ত স্হানের খোঁজ কে পাবে? বাহির থেকে ভেতরে ঢুকলে কেউ বুঝবে না ভেতরে কি? কিন্তু এই অংশটাতো!!
আর ভাবতে পারলো না মুরাদ, তার আগেই রিহান এসে খবর দিলো – বস, সেলিম এখানে ইনফরমার হিসেবে আইছে বস। ও তথ্য উড়ায়।
কানজোড়া লাল হয়ে গেছে মুরাদের। রিহানকে বলল – ওরে ডেকে আন।
রিহান আর সেলিম ঘরে ঢুকতেই মুরাদ উঠে দাঁড়ালো। ইশারা করে রিহানকে বেরিয়ে যেতে বলল। রিহান চলে যেতেই সেলিমকে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো – কার হয়ে কাজ করিস? আমার পেছনে কোন মানুষটা লেগেছে, আমার খোঁজ সে কেমনে জানছে?
অবস্থার গতিবিধি বুঝতে মোটেও অসুবিধে হলোনা সেলিমের। ঝাঁ পি য়ে পড়লো মুরাদের উপর, নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত মুরাদ তখন অনিচ্ছায় ছুরিটাকে সেলিমের বুকে বিদ্ধ করে দিল। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে দেরী করে ফেললো মুরাদ, সেলিমকে জিজ্ঞেস করার সময় পেলোনা আর।
মোবাইলে রিংটোনের শব্দ পেয়ে মুরাদ খেয়াল করলো সেলিমের পকেট থেকে আসছে শব্দ। তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে কোন শব্দ পেলোনা। এবার মুরাদ ধৈর্য্যহারা হয়ে হ্যালো বলতেই কলটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। মুরাদ আবার ডায়াল করলো নাম্বারটাতে কিন্তু ততক্ষণে শুনতে পেলো আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে মুরাদ ভাবছে কি করা যায় ঐদিকে অন্য দল ভাবছে – সেলিম কি ধরা পড়ে গেল??
___
খাবার টেবিলে বাবা, মা, ছোট ভাইটা বসেছে, জায়গা হয়নি শুধু মায়ার। আগে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে তারপর নিজে খাবে। সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো মায়া। হঠাৎ রাশেদা বেগম খেয়াল করলেন মায়ার বামহাতটায় সাদা গজ প্যাঁচানো। তিনি ইশারা করে ব্যাপারটা স্বামীকে দেখালেন। আশরাফ আহমেদ কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েকে বললেন – হাতে কি হয়েছে মা?
মায়া তাড়াতাড়ি হাতটাকে ওড়নার ভাঁজে টেনে বলল – গরম তেল পড়েছে, বাবা। একটু তেল, সমস্যা নেই।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কথা বাড়ালেন না আশরাফ। সবাই খাওয়ায় মন দিলো।
খাবার খেয়ে সবাই যার যার ঘরে ঘুমোতে গেল। মায়া ঘরে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, হঠাৎ বারান্দায় কিছু একটার আওয়াজ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখলো কিছুই নেই। এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিরে আসতে যেই পা বাড়ালো অমনি দেখলো পায়ের কাছে একটা ইটের টুকরোতে চিরকুট মত কাগজ বাঁ ধা। ইটের টুকরোটা হাতে নিয়ে সুতোটা খুলে কাগজটা মেলতেই চমকে গেল সে। বুক চিরে চাপা নিশ্বাসটা বেরিয়ে এলো। অস্ফুটস্বরে বললো – ধ্যাৎ।
চলবে…
#মাহমুদা_লিজা