#আড়ালে_অন্তরালে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বঃ৪
সব কাজ নিখুঁতভাবে করে দিয়েও সিনিয়রকে খুশি করতে না পারার য ন্ত্র ণা টা ফাহিমের আত্মবিশ্বাসটা তলানিতে নিয়ে ঠেকিয়েছে। ব্যালেন্স শিট থেকে শুরু করে কোম্পানির সকল কর্মচারীর বেতন এবং বোনাস শিট রেডি করে অপারেশনের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিল। ভেবেছিল অপারেশন বুঝি খুশি হবে! কিন্তু অপারেশনকে খুশি করা আর পাথরে ফুল ফোটানো একই মনে হলো ফাহিমের। মনটা বিষিয়ে উঠলো, ন’টা পাঁচটা ডিউটি করে বাইশ হাজার টাকা বেতনে চলা যায়না। কাজের খুঁত ধরে ধরে বেতন বাড়ানোর রাস্তাটায় যেন সীলমোহর এঁটে দিয়েছে অপারেশন। নিজের চলতে কষ্ট হয় সেখানে জীবনে কাউকে জড়ালে তার চাহিদা মেটানোর জন্য নূন্যতম খরচটা কতটুকু যোগান দিতে পারবে তা ভেবে বিয়ের চিন্তা থেকে মুখ ফিরিয়েছে সে। কিন্তু মায়াকে দেখার পর বারবার মনে হচ্ছে বিয়ে তাকে করতেই হবে এবং বেতন বাড়ানোর প্রস্তাবটা সরাসরি ম্যানেজমেন্টের কাছে রাখবে। ছোটো বিড়াল ছানার মত মেয়েটাকে বুকে আগলে রেখে না খেয়ে থাকলেও নিশ্চয়ই ছা /না /টা কষ্ট পাবেনা। বুকের উষ্ণতায় মুখ গুঁজে ভুলে যাবে তৃষ্ণা আর ক্ষিদের কষ্ট।
কল্পনার জগতে যখন ডানা মেলে উড়ছিলো ফাহিম সেই সময়টায় সম্বিত ফিরলো মিলনের কথায়। অফিস শেষে কফিশপটায় বসে কফি না খেলে চলেনা তার। গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করার ভঙ্গি নিয়ে বলল – কি বললি যেন?
ফাহিমের প্রশ্নে আশকারা পেয়ে মিলন বলল – কাজের সূত্রে যোগাযোগ হলো আমাদের অথচ তোর ফ্যামিলি সম্বন্ধে কিছু জানিনা।
প্রশ্নটা শুনে স্বাভাবিক স্বরে ফাহিম বলল – আমার মা নেই, বাবা আছে। ছোট একটা দোকান আছে মুদির, সেটা থেকে আসা ছোট্ট আয় দিয়ে বাবার আর বোনের খরচ চলে। আর আমার অবস্থা তো দেখছিসই। বেতনের অর্ধেক বাবাকে পাঠাই, বাকিটা দিয়ে কোনরকম চলছি। উপার্জনের এ অবস্থা হলে জীবনে বিয়ে করার ইচ্ছে পূরণ হবে না।
ফাহিমের কথাগুলো শুনে মিলন একেবারে দাঁত গলিয়ে হেসে বলল – আরে তুই এসব চিন্তা করছিস? আমিতো ঠিক করেছি এমন কাউকে বিয়ে করব যাকে সিঁড়ি বানিয়ে উপরে ওঠা যায়। আরে তুই মায়ার কথা বললি না! ব্যা টা আমিতো ভাবছি তুই জেনেশুনে প্ল্যান করে ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস, ওকে বিয়ে করলে তুইও তরতরিয়ে উঠে যাইতে পারবি, একদম মই ছাড়া।
মিলনের চিন্তা ভাবনা শুনে গা গুলিয়ে উঠলো ফাহিমের। একজন মানুষের রুচির সীমা কি করে শূন্য পার করে সেদিকে যেতে পারে তাই ভেবে ভেতরটা ধিক্কার জানালো হয়তো বাহিরের মানুষটা বুঝলো না। সেখানে বসে বসে এসব রুচিহীন কথা শ্রবণ করার কোন অভিপ্রায় অবশিষ্ট রইলো ফাহিমের। মগে থাকা কফিগুলোতে চুমুক দিতেও তার অসহ্য লাগছে। একজন শিরদাঁড়াহীন পুরুষের সামনে বসে থাকা তার পক্ষে অযৌক্তিক।
চেয়ারটা পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল – বাসায় কিছু কাজ আছে, পরে কথা বলছি।
আর কোন কথা বাড়তে না দিয়ে চেয়ারটা পা দিয়ে সরিয়ে চুলগুলো বামহাতের আঙ্গুলগুলো চালিয়ে ব্যাকব্রাশ করতে করতে কফির বিলটা চুকিয়ে কফিশপটার শক্ত হাতলওয়ালা দরজাটা ঠেলে বাহিরে এসে পিছনে ফিরে দেখলো মিলন তাকিয়ে আছে তখনো। নজর ফিরিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে,আস্তে আস্তে রাস্তায় জ্বলা সোডিয়ামের আলো দেখতে দেখতে বাসার কাছাকাছি এসে মনে পড়ল আলসেমি করে গত তিনদিন ভাত রান্না করেনি। আজ একটু ভাত না খেলে সে ভুলেই যাবে সে বাঙালী।
______
দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে চোখ বন্ধ করে মুরাদ বলল – দরজা খোলা, ভেতরে চলে আসেন।
দরজা খোলার আওয়াজটা শোনার পর পরিচিত পদধ্বনিটাও পেল। আগের অবস্হানে স্হির থেকে বলল – ইমতিয়াজ! কিছু বলবেন?
অপরপাশ থেকে বিস্ময়ের স্বরটা শোনা গেল – একজন মানুষের চতুর্থরূপী কন্ঠটা পেলাম, আর কতরকমে কন্ঠ বদলাতে পারেন মিস্টার মুরাদ?
উত্তরটা দেয়ার আবশ্যকতা বোধ করলো না মুরাদ, টপিক থেকে বেরিয়ে এসে বলল – বউকে আঠারদিন দেখেন নি, আজ বউয়ের কাছে যেতেই হবে। এই আজ্ঞা যেন মঞ্জুর হয় সেই কারণে এই কক্ষে আগমন কিন্তু সেটা না বলে অন্য কথায় খোঁ চা মা/রা/র মানে কি?
মুরাদের কথায় খানিক লজ্জা পেলেও তা প্রকাশ না করে সপ্রতিভ কন্ঠে ইমতিয়াজ বলল – লোকগুলো আগামীকাল থেকে কাজে লাগতে পারবে, তার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন। তাদের পরিবারের কাছে তাদের আয়ের অংশ পাঠানো যাবে অতি শীঘ্রই। আমি আসছি।
মুরাদ বুঝতে পারলো ইমতিয়াজের আচরণ বড়ই অদ্ভুত। তার বউয়ের কথা বলায় হয়ত সে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে কৌশলে। ইমতিয়াজকে থামাতে মুরাদ বলল – যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে যান ইমতিয়াজ আদনান। আপনাকে পৌঁছে দেয়া হবে।
মুরাদের কন্ঠে আদেশ স্পষ্ট ছিলো যা ইমতিয়াজের বুঝতে এক বিন্দু অসুবিধে হয়নি।
ইমতিয়াজ হেসে বললো – বউ অপেক্ষা করছে।
ইমতিয়াজের কথা শুনে মুরাদের ঠোঁটজোড়া খানিক প্রশস্ত হলো, বুঝতে পারলো ইমতিয়াজও তাকে সূক্ষ্ণ খোঁ চা টা দিতে ভুলেনি। ছেলেটার সাহস আছে। তিন সেকেন্ডের মাথায় হো হো করে হেসে উঠলো মুরাদ। হাসিটাকে কোনমতে চেপে রেখে বলল – বউকে ভয় পান নাকি য ম কে?
তাদের হাসিমাখা সেই খুনসুটিতে বাদ সাধলো রিহান। দৌড়ে এসে বললো – নিরুপমা সত্যি ধ রা পড়েছে বস। সে সত্যি এসেছে। আমাদের মেয়েরা তাকে ধ রে ফেলছে। অসীম আর প্রতীককে দেখতে সে নার্সের বেশে এসেছে।
রিহানের অবাক হয়ে বলা প্রতিটি কথা শুনে মুরাদ বলল – অভিজ্ঞতা কখনো বিফলে যায়না।
ইমতিয়াজ চোখ বন্ধ করে বলল – তার কোন ক্ষ তি করোনা।
ইমতিয়াজ কথাটা সারমর্ম আকারে বললেও মুরাদ ভাব সম্প্রসারণ করে নিয়েছে। ঈষৎ ব্যঙ্গ করে বলল – আমি মেয়েদের সম্মান করি, তার ক্ষ তি হবেনা তবে বেশি এদিক সেদিক করলে বিয়ে করে নিব।
_____
শরীরের ব্যাথায় খাটের পাশে ফ্লোরে নেমে বসেছে মায়া। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাথা হচ্ছে। পেইন কি লা র নিয়েও লাভ হলোনা তেমন। নিজেকে কোনমতে শক্ত করে, মনটাকে প্রবোধ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চাদের মতো এলোমেলো ছন্দে হেঁটে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। চারদিকে শুনশান নীরবতা কিন্তু আকাশের তারাগুলো উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে। তারা যেন মায়ার সাথে কথা বলতে চাইছে। সেদিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি দিতে পারলোনা মায়া। ঘাড়টা বেশ কষ্ট দিচ্ছে। মাথাটা নিচু করে রাস্তার দিকে তাকাতেই তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের বাড়িওয়ালা জামশেদ রহমান উঠতি বয়সের একটা মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে ঢুকছে। মায়ার জানামতে লোকটার মেয়ে নেই, তার বউও এতটা যুবতী নয়। তাহলে মেয়েটা কে। মুল ফটকের ভেতর ঢুকেই মেয়েটাকে জড়িয়ে বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছে লোকটা। মায়ার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।
যেই লোকটাকে এত সম্মান করত, যেই লোকটা মায়াকে বাবার স্নেহ দিত সেই লোকটা! ছিহ! আর ভাবতে পারলোনা মায়া। এসব ভাবতেই গা গুলোচ্ছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে কিছু একটা ছুঁড়ে মারতে। আবার তাকালো সেদিকে, এবার তার চক্ষু কপালে উঠার অভিপ্রায়। মূল ফটকটা ঠেলে আরেকজন লোক প্রবেশ করছে বীরদর্পে। লোকটার অবয়ব দেখে মনে হলো বয়সের ছোঁয়াটা পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে বা করেনি। চেনাচেনা লাগছে লোকটাকে। কোথায় যেন সে দেখেছে। জামশেদ রহমান মেয়েটাকে নিয়ে আগত লোকটার পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। সামনের দিকে ইশারা করলো যেতে। আগত লোকটাও মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে গেলো দারোয়ানের ঘরটার দিকে।দরজা খুলে দারোয়ান বেরিয়ে এলেও লোকটা ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল। মায়ার মাথা ঘুরছে ভনভন করে। সে কোথায় আছে। সারাদিন সৎ এবং ভালো মানুষের মুখোশ পরা লোকগুলো রাতের আঁধারে কি করে! অস্ফুটস্বরে বললো – এদের কেউ কেন থামায় না!
সেখানে আর দাঁড়ালো না মায়া। কাঁপা কাঁপা পায়ে আবার ঘরে ফিরে এলো। এসব দেখতে তার ঘৃণা হচ্ছে।
_____
নিরুপমার মুখোমুখি মুরাদ। নীরবতা ভেঙে মুরাদই প্রথম বলল – মুখোশটা সরান মিস নিরুপমা।
নিরুপমাকে চেয়ারে বসিয়ে প্রশ্নটা করলো মুরাদ। নিরুপমা উত্তর দিলোনা ঠিকই কিন্তু মুরাদের বুক বরাবর সজোরে লাথি বসিয়ে দিল। চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়তে গিয়েও ফ্লোরে হাত ঠেকিয়ে নিজের ভারসাম্য ঠিক করে উঠে পড়লো সে।
নিরুপমা পাল্টা আঘাত করার আগেই তাকে প্রতিহত করে গম্ভীর স্বরে মুরাদ বলল – আনাড়ি মেয়ে! সম্মান দিতে চেয়েছিলাম, তুমি নিতে অনাপত্তি জানিয়েছো। বন্দীনি হও।
কথাগুলো বলেই হাতে থাকা ধাতব বস্তুটা তার দিকে তাক করে দরজার বাহিরে থাকা প্রিয়তাকে ডেকে মুরাদ বলল – বেঁ ধে রাখো ওকে। সে বন্দীনি হবে।
চলবে…..
টাইপোগ্রাফি : মারিয়া মিম