#তুমি_শুধু_আমারি_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|৬|
আজ ভার্সিটি এসেই অর্নি রুশান আর নূর ট্যুরের জন্য টাকা জমা দিয়ে দেয়। তিনজনেই ভীষণ খুশি। এই খুশিতে পানি ঢালার মতো সংবাদ নিয়ে এলো মাহির। জানালো ও ট্যুরে যাচ্ছে শুধুমাত্র অর্নির কাছাকাছি থাকার জন্য। যা শুনে অর্নির থেকে নূরের মাথাটা গরম হয়ে গেলো বেশি৷ ফলস্বরূপ নূর রেগেমেগে বললো,
–“আপনি ট্যুরে যান নয়তো জাহান্নামে যান, আমাদের শুনাইতে আসছেন কেন? চোখের সামনে থেকে দূর হোন।”
মাহির নূরকে আরো একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
–“আহা শালীকা! এমন রেগে যাও কেন তুমি? তুমি কি চাও না তোমার বন্ধুর সাথে বেশি বেশি সময় কাটিয়ে ওর মনে নিজের জন্য জায়গা করে নিই আমি?”
নূর গাছের একটা চিকন ডাল উঠিয়ে মাহিরের দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,
–“একদম চাই না।”
মাহির দু কদম পিছিয়ে গিয়ে বললো,
–“কেন কেন?”
নূর চট করেই বলে ফেললো,
–“কারন অর্নির বয়ফ্রেন্ড আছে৷”
নূরের কথা শুনে অর্নি আর রুশান দুজনেই আহাম্মকের মতো নূরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ নূর অর্নির দিকে তাকিয়ে মেকি হাসলো। মাহির অবাক হলো প্রথমে। তারপর আবার ওদের মুখভঙ্গি দেখে চট করেই বুঝে গেলো মিথ্যে বলছে ওরা। তাই মাহির বাঁকা হেসে বললো,
–“তা অর্নির বয়ফ্রেন্ড কে? ডাকো তাকে, আমিও একটু দেখি, পরিচিত হয়ে নিই দুজনে।”
মাহিরের কথায় নূর এবার আমতা আমতা শুরু করলো। আশেপাশে এদিক ওদিক তাকিয়ে উৎসবকে দেখে নূরের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। নূর চট করেই উৎসবকে দেখিয়ে বললো,
–“ওই যে দেখছেন, কালো শার্ট পড়া একটা ছেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে ওই ছেলেটাই অর্নির বয়ফ্রেন্ড।”
নূরের কথায় সকলেই সামনে তাকায়৷ অর্নি সামনে তাকিয়ে উৎসবকে দেখতে পেয়ে কেঁশে উঠে৷ তা দেখে নূর অর্নির হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে,
–“চুপ, এমন করছিস কেন? তোর ভালোর জন্যই তো এসব বলছি।”
অর্নি নূরের দিকে কিছুটা ঝুঁকে গিয়ে বললো,
–“তাই বলে উৎসব ভাই?”
মাহির উৎসবের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অর্নি আর নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোমরা দুজন ফিসফিস করে কি বলছো?”
অর্নি হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“বলছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড একদম ঠিক টাইমে এন্ট্রি নিয়েছে।”
এই বলে অর্নি উৎসবের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত জড়িয়ে ধরে বললো,
–“এতক্ষণে আসার সময় হলো তোমার? আমি কিন্তু বেশ রেগে আছি তোমার উপর, অনেক লেট করে এসেছো আজ।”
অর্নির এহেন কথায় উৎসব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। পাশেই নূর আর রুশান দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছে। উৎসব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
–“মানে কি এসবের? আর তুমি এভাবে কথা বলছো কেন?”
অর্নি অভিমান করে বললো,
–“সেই ঘটনার জন্য এখনো রেগে আছো আমার উপর? স্যরি তো।”
–“আরেহ আজব, এই নূর তোর ফ্রেন্ড এসব কি বলছে? মাথা ঠিক আছে তো ওর?”
কথাগুলো উৎসব নূরের দিকে তাকিয়ে বললো। মাহির বোঝার চেষ্টা করছিলো উৎসব সত্যিই অর্নির বয়ফ্রেন্ড কিনা। কিন্তু ওদের কথাবার্তা শুনে তেমনটা মনে হচ্ছে না। মাহির এগিয়ে গিয়ে বললো,
–“ব্যাস, অনেক নাটক করেছো আর করতে হবে না। অর্নি আমি বুঝে গেছি এটা তোমার বয়ফ্রেন্ড না। সে যদি তোমার বয়ফ্রেন্ড হতো তাহলে এভাবে কথা বলতো না।”
নূর এগিয়ে এসে বললো,
–“আরেহ কি বলছেন? বয়ফ্রেন্ড হবে না কেন? একশবার এই ছেলেটাই মানে আমার ভাইয়া অর্নির বয়ফ্রেন্ড।”
নূর মাহিরকে উদ্দেশ্য করে প্রথমে এই কথাগুলো বললো। তারপর আবার উৎসবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আচ্ছা ভাইয়া, সামান্য একটা বিষয়ে কেউ রেগে থাকে এখনো? অর্নি একটা ভুল করেছে তার জন্য স্যরিও বলেছে। তুমি ক্ষমা করার বদলে উলটো সবার সামনে ওকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে পরিচয় দিতে অস্বীকার করছো? দিস ইজ নট ডান ভাইয়া। তার থেকে তো বরং এই মাহির ছেলেটাই ভালো৷ এতদিন যাবত অর্নির পেছনে ঘুরছে আর অর্নি কিনা ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না৷ ঠিক আছে তুমি এখনই ব্রেকাপ বলে দাও। আমি এক্ষুনি এই মাহিরের সাথেই অর্নির সম্পর্ক জুড়ে দিবো।”
নূর কথাগুলো বলতেই অর্নি নূরকে টেনে কিছুটা সাইডে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“এবার বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? উৎসব ভাই এখন ব্রেকাপ বললেই তো এই মাহির আরো জেঁকে বসবে।”
–“নো চিন্তা দোস্ত, আমি আছি না?”
এই বলে নূর অর্নিকে নিয়ে আবারো ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। রুশান মুখ টিপে হেসে বললো,
–“আচ্ছা ভাইয়া আপনি বরং ব্রেকাপ বলে দিন। আপনার থেকে এই মাহিরের সাথেই অর্নিকে বেশি মানাবে।”
নূর আর রুশানের এমন কথা শুনে মাহিরের মনে লাড্ডু ফুটছে। বেচারা খুশিতে আটখানা হয়ে পড়েছে। ওর এই খুশিকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে উৎসব অর্নিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“ঝগড়া হোক আর যাই হোক আমার গার্লফ্রেন্ড তো আমারই। ব্রেকাপ কেন করবো? অর্নি আমার ছিলো আর আমারই থাকবে।”
উৎসবের কথায় নূর আর রুশানের মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠলো। আর বেচারা মাহির ছোট ছোট মুখে বললো,
–“অর্নি সত্যি আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
উৎসব অর্নিকে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে অবাক কন্ঠে বললো,
–“এনি ডাউট? তোমাকে শুধু শুধু মিথ্যে কেন বলতে যাবো আমি?”
মাহিরের মুখটা আগের তুলনায় আরো বেশি ছোট হয়ে গেলো। অসহায় মুখে অর্নিকে বললো,
–“আ’ম স্যরি অর্নি, এতদিন বিরক্ত করার জন্য।”
এই বলেই মাহির চলে গেলো। অর্নির এতক্ষণ দম বন্ধ অবস্থা ছিলো। এক ঝাটকায় উৎসবের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে ক্যানটিনে চলে যায় ও। ক্যানটিনে বসে বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকে অর্নি। ইশ্ আর একটু হলেই অর্নির দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। এভাবে কেউ কাছে টানে? অর্নি এক বোতল পানি মূহুর্তেই ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে ফেলে। তারপর আবারো জোরে শ্বাস নিতে থাকে।
–
কাল সকাল সকাল ভার্সিটি থেকে বাস ছাড়বে সিলেটের উদ্দেশ্যে। নূর অর্নি আর রুশান ভিডিও কলে কথা বলছে। ওখানে গিয়ে কি কি করবে না করবে সেইসব বিষয়েই বেশ এক্সাইটেড ওরা। বিশেষ করে অর্নি। এবার প্রথম ও পরিবার ছাড়া ট্যুরে যাচ্ছে। এর আগে একা কখনো ঘুরতে যায়নি ও। সবসময় সাথে অর্নব নয়তো টায়রা বা পুরো পরিবারসহ ঘুরতে গেছে। তাই এবার প্রথম একা একা যাওয়ায় অর্নির আনন্দের সীমা নেই। অর্নি ভিডিও কলে কথা বলছে আর ব্যাগ প্যাক করছে। ওর জামা প্যাক করা দেখে রুশান বললো,
–“এত্ত জামা কেন নিচ্ছিস সাথে? মনে হয় সারাজীবনের জন্য যাচ্ছিস আর আসবি না।”
অর্নি প্রশস্ত হেসে বললো,
–“সারাজীবন থাকতে পারলে তো ভালোই হতো। যাওয়ার আগেই মনে হচ্ছে তিনদিনে আমার পোষাবে না।”
নূর বাঁকা হেসে বললো,
–“তাহলে সিলেটের স্থানীয় কোনো ছেলের প্রেমে চট করে পড়ে যাস। আমরা সেখানেই তোর বিয়ে দিয়ে শশুড়বাড়ি রেখে আসবো।”
অর্নি হেসে বললো,
–“নট ব্যাড, তোর আইডিয়া মনে ধরেছে। এখন সেই মোতাবেক যদি কাউকে মনে ধরে যায় তাহলে সিউর থাক, বিয়ে করে ওখানেই থেকে যাচ্ছি আমি।”
অর্নির কথায় নূর আর রুশান দুজনেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সাথে অর্নিও যোগ দিয়েছে। আচমকা উৎসবের কন্ঠস্বর শুনে অর্নি চমকে নূরের পেছনে খেয়াল করে উৎসব বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে নূরকে জিজ্ঞেস করছে,
–“এত হাসাহাসি কিসের এখানে?”
কথাটা বলে উৎসব বাঁকা চোখে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা অর্নির মুখপানে তাকালো। উৎসব ভ্রু কুঁচকে অর্নির দিকে তাকাতেই অর্নি নিজের দিকে একবার চোখ বোলালো। নাহ সবকিছু তো ঠিকঠাকই আছে তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন উৎসব? এই ভেবে অর্নি গোলগোল চোখে আবারো উৎসবের দিকে তাকালো। তা দেখে উৎসব বাঁকা হাসলো। উৎসবের মুখের হাসিটাও অর্নির কাছে কেমন রহস্য রহস্য লাগছে। তাই আরো একবার নিজের দিকে চোখ বুলিয়েই চট করে লাইন কেটে দিলো।
বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অর্নি। অসভ্য লোকটা এতক্ষণ ওকে এভাবে দেখছিলো? ছিহঃ! অর্নির পেটের কাছে টি-শার্ট কিছুটা কুঁচকে গিয়েছিলো। আর সেদিকেই উৎসব___লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে নিলো অর্নি। উৎসব কাছে এলেই এমন বুক দুরুদুরু করে কেন ওর? অর্নি কোনো ছেলের এতটা কাছে যায়নি যতটা কাছে উৎসব এসেছে। অর্নি নিজেও কোনো ছেলেকে এতটা ভয় পায় না যতটা ভয় উৎসবকে পায়। এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে চায় না অর্নি। তাই চুপচাপ প্যাক শেষ করে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়লো। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে তো।
ছয়টা পনেরো বাজে। অর্নির ফোনে এলার্ম বাজছে। কিন্তু ওর উঠার নামই নেই। আটটার মাঝে ভার্সিটির মাঠে থাকতে হবে। অর্নির আম্মু এসে এবার টেনে উঠালেন অর্নিকে। অর্নি তখনো চোখ বন্ধ করেই রেখেছে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“আহা আম্মু! এত সকাল সকাল টানছো কেন? ঘুমোতে দাও না আর একটু।”
–“আর একটু ঘুমালে ট্যুরের বাস মিস করবি, তখন আবার বলবি না কিন্তু আমি কেন ডাকলাম না।”
ট্যুরের কথা শুনে অর্নির ঘুম পালিয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। অর্নি তাড়াতাড়ি উঠে শাওয়ারে চলে গেলো। আধঘন্টা বাদে বাথরোব পরে বেরিয়ে এলো অর্নি। কাবার্ড থেকে একটা সবুজ কামিজ এবং ধূসর রঙের একটা জিন্স পড়ে নিলো। চোখে গাঢ় করে কাজল এবং ঠোঁটে নুড কালার লিপস্টিক দিয়ে নিলো। কোমড় সমান ভেজা সিল্কি চুলগুলো ছেড়ে রাখলো। হাতে ঘড়ি পড়ে নিলো। ব্যাস অর্নি এতেই রেডি। বের হবার আগে আরো একবার ব্যাগের সবকিছু দেখে নিলো। তারপর গলায় স্কার্ফ পেচিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এলো। তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গেলেই মিসেস অদিতি জোর করে একটা অমলেট খাইয়ে দিলেন মেয়েকে। অর্নব এসে বললো,
–“কিরে চল, অলরেডি সাড়ে সাতটা বাজে। এরপর বাস মিস করবি তো।”
ভাইয়ের কথায় অর্নি হুশ ফিরে দ্রুত মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ভাইয়ের সাথে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে৷ পৌনে আটটা নাগাদ অর্নব অর্নিকে নিয়ে ভার্সিটি পৌঁছে যায়৷ অর্নিকে দেখেই নূর আর রুশান দৌড়ে আসে। নূর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
–“অলওয়েজ তুই লেট করিস৷ আর একটু লেটে আসলেই বাস ছেড়ে দিতো৷”
–“ছাড়েনি তো৷ তার আগেই এসে পড়েছি।”
–“হুম তা তো এসেছিস।”
রুশানের কথায় অর্নব বললো,
–“সাবধানে যেও তোমরা। আর কখন কি হয় না হয় ফোনে জানিও। কোনো দরকার হলেও জানাবে কিন্তু। আর অর্নির দিকে খেয়াল__”
–“রিল্যাক্স ভাইয়া। আমরা আছি তো, আপনি এত চিন্তা করবেন না তো।”
নূরের কথায় অর্নব আলতো হাসলো৷ তারপর নূরের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
–“তোমরা আছো বলেই তো ওকে ছাড়ছি। ও এর আগে একা কোথাও যায়নি এবারই ফাস্ট।”
–“চিন্তা করবেন না ভাইয়া। বাস ছাড়বে এক্ষুনি আমরা তাহলে আসছি?”
অর্নব সম্মতি জানাতেই রুশান অর্নির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে গেলো। সাথে নূরও অর্নিকে আসতে বলে বাসে উঠলো। অর্নি যাওয়ার আগে একবার বেশ শক্ত করে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। অর্নব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
–“সাবধানে থাকিস এই তিনদিন।”
আনিতা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই অর্নব বোনকে ছেড়ে দিলো৷ অর্নি বাসে উঠে বসতেই অর্নব গিয়ে ওদের বাসের একজন টিচারের সঙ্গে কথা বলে বাইক নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
চলবে~