#তুমি_শুধু_আমারই_হও
লেখনীতে- অরনিশা সাথী
|৯|
ছাদের এক সাইডে উৎসব এবং সায়ান ছিলো। যা হয়তো অর্নি ওরা কেউ-ই তেমন ভাবে লক্ষ্য করেনি। ছাদের দরজার সামনে এগিয়ে আসতেই উৎসবের দৃষ্টি থেমে গেলো৷ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। রাগে যেন পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর। চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে৷ নিজের রাগ সংযত করতে পারছে না। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে মাহিরের হাতের দিকে৷ যে হাত দিয়ে মাহির অর্নির কোমড় স্পর্শ করে রেখেছে৷ মাহির ছেলেটাকে যেন অর্নির আশেপাশে একদমই সহ্য হয় না উৎসবের। মাহিরের দিকে তেড়ে গেলেই সায়ান আটকে দেয় ওকে। বলে,
–“রেগে যাচ্ছিস কেন? অযথাই ঝামেলায় জড়াস না। অর্নির সাথে তো তোর কোনো সম্পর্ক নেই তাহলে এসব করছিস কেন?”
সায়ানের কথায় সেখানেই থেমে যায় উৎসব৷ সামলে নেয় নিজেকে। মাহিরের থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো অর্নি। মাহির একবার এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার অর্নির দিকে তাকালো। অর্নি কিছু না বলে নিচে নেমে গেলো। ওর পেছনে নূর আর তরীও নেমে যায়৷ মাহির সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে অর্নিকে দেখলো যতটা সময় দেখা যায়৷ মেয়েটাকে প্রথম দেখাতেই ওর ভালো লেগে যায়। তাই তো পেছনে পড়ে আছে৷ ওরা যদিওবা বলছে উৎসব অর্নির বয়ফ্রেন্ড, সেটা মাহিরের একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। মেয়েটাকি ওর থেকে দূরে থাকার জন্য এমন নাটক করছে? হয়তো বা। এসব ভেবে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে ছাদে উঠতেই দেখা হলো উৎসবের সাথে৷ উৎসবের চাহনী দেখে ক্ষানিকটা ভড়কে গেলো মাহির। কি ভয়ানক ভাবে তাকিয়েছে মাহিরের দিকে, যেন চোখ দিয়ে একদম শেষ করে দিবে। মাহির দ্রুত কদমে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
ক্ষানিক বাদে সন্ধ্যা নামবে, তাই এখন রিসোর্টের আশেপাশেই ঘুরে ফিরে দেখছে সকলে। কাল নাস্তা সেরে বিছানা কান্দির উদ্দেশ্যে বের হবে৷ সকলেই হাঁটতে বের হয়েছে৷ সবাই আগে আগে যাচ্ছে নূর আর অর্নি দুজনে একসাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। ওদের পেছনেই রুশান তরী নিজেদের মতো কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে। ওরা দুজনেই সবার পেছনে। মাহির অর্নির পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। ওকে দেখে নূর আর অর্নি দুজনেরই মেজাজ বিগড়ে গেলো। লোকটা পেয়েছে কি? এভাবে কেউ সবসময় পেছনে লেগে থাকে? মাহির একগাল হেসে বলল,
–“চলে এলাম তোমাকে বিরক্ত করতে।”
অর্নি চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
–“আমাকে বিরক্ত করা ছাড়া কি আপনার আর কোনো কাজ নেই?”
–“উঁহু, সত্যি এটা ছাড়া আর কাজ নেই আমার।”
নূর রাগ সামলে নিয়ে বললো,
–“আপনি যাবেন, নাকি ভাইয়াকে ডাকবো আমি?”
–“মিস ঝগরুটে, তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি আমি।”
মাহিরের কথায় নূর আরো রেগে গেলো। থেমে গিয়ে বললো,
–“আমার ভাবীর সাথে কথা বলতে এসেছেন, কিন্তু হবে না এটা। আমি কথা বলতে দিচ্ছি না।”
মাহির নূরের দিকে ভ্রু কুঁচকে ক্ষানিকটা সময় তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর অর্নিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আচ্ছা অর্নি, এমন ঝগরুটে মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ হলো কি করে তোমার?”
অর্নি চোখ রাঙিয়ে তাকালো। আঙুল তাক করে বললো,
–“ফারদার আমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে কিছু বলবেন না আপনি নয়তো__”
–“নয়তো কি?”
–“জাস্ট খুন করে ফেলবো।”
কথাটা বলেই জোড়ে হাঁটা লাগালো অর্নি। ওর পেছনে নূরও গেলো৷ মাহির আবারো এসে এই কথা সেই কথা শুরু করেছে৷ অর্নি পারে না তো কাঁচা চিবিয়ে খায় মাহিরকে। নূরেরও সেম অবস্থা৷
পেছন থেকে কেউ নূরের নাম ধরে ডাকলে ও দাঁড়িয়ে যায়। দেখলো শান্ত ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। নূরের ক্ষানিকটা লজ্জা লজ্জা লাগছে। অর্নি নূরের কানের কাছে গিয়ে বললো,
–“দোস্ত, লজ্জা রাঙা মুখে তোকে দেখে আমরা অভ্যস্ত না। প্লিজ এরকম লুক দিবি না একদম।”
নূর চোখ পাকিয়ে তাকায়৷ অর্নি হেসে দিয়ে বললো,
–“এই তো, এখন আমাদের আগের নূর লাগছে তোকে।”
ফিক করে হেসে দিলো নূর। সাথে অর্নিও। শান্ত দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“কি ব্যাপার, কি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে?”
–“তেমন কিছু না ভাইয়া, কেমন আছেন আপনি?”
অর্নির কথায় শান্ত প্রসস্থ হাসলো। নূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তোমার ফ্রেন্ডের দেখা পেয়েছি এখন তো অবশ্যই ভালো থাকবো। তোমাদের কি খবর?”
–“এই তো চলছে। আপনারা কথা বলুন, আমি এগোচ্ছি।”
এই বলে অর্নি শান্ত আর নূরকে আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলো। নূর আর শান্ত পাশাপাশি হাঁটছে। শান্ত বারবার তাকাচ্ছে। নূরের দিকে৷ নূর ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেলেও সেটা চেহারায় ফুঁটিয়ে তুলছে না। শান্ত বললো,
–“আমার ফ্যামিলি রাজি আছে নূর।”
কথাটা নূরের কর্ণগোচর হতেই চকিত তাকালো শান্তর পানে। শান্ত পুনরায় বললো,
–“ট্যুর থেকে ফিরে তোমার ফ্যামিলির সাথে কথা বলবো। আই হোপ, তারাও আপত্তি জানাবে না।”
নূরের বুক ঢিপঢিপ করছে। আচ্ছা ফ্যামিলি মানবে তো? যদি না মানে? তাহলে তো নিজের ভালোবাসাকে পেয়েও হারাবে নূর৷ নূরকে চিন্তিত দেখে শান্ত ডাকে। নূর শান্তর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো৷ দুজনে টুকটাক কথা বলতে বলতে এগোচ্ছে সামনের দিকে।
–
–“এই অর্নি, আই লাভ ইউ।”
অর্নি বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে মাহিরের দিকে তাকালো। লোকটা পেয়েছে কি? সেই কখন থেকে একই কথা বলে যাচ্ছে। অর্নি খুবই শান্ত স্বভাবের সহজে রাগে না তবে একবার রাগ উঠে গেলো যা-তা করে ফেলতে পারে৷ অর্নির রাগটা তড়তড় করে বাড়ছে৷ তবুও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,
–“আর একবার যদি আপনি আমার সামনে আসেন তাহলে আমি কি করবো আমি নিজেই জানি না। একদম বিরক্ত করতে আসবেন না আমায়।”
বলে অর্নি হাঁটা লাগালো। মাহির আবারো অর্নির পেছন পেছন গিয়ে বললো,
–“এই অর্নি, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।”
অর্নির রাগ এবার আকাশ ছুঁই হলো৷ নিজেকে এবার শান্ত রাগা বড্ড দায় হয়ে যাচ্ছে অর্নির। কিছুদূর সামনেই উৎসবকে ওর বন্ধুদের সাথে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো অর্নি৷ উৎসব মাথা তুলে তাকালো অর্নির দিকে। মেয়েটা ভয়ানক রেগে আছে তা চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উৎসব ক্ষানিকটা অবাকই হলো অর্নিকে ওর সামনে দেখে। যে মেয়ে উৎসবকে দেখে দূরে দূরে থাকে সে আজ নিজে থেকে উৎসবের কাছে এসেছে? উৎসবের এসব ভাবনার মাঝেই অর্নি ঝাঁজালো কন্ঠে বললো,
–“আপনি এদিকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন ওদিকে যে মাহির আমায় বিরক্ত করছে তার বেলায়? কেমন বয়ফ্রেন্ড হলেন আপনি আমার?”
অর্নির কথায় উৎসব ভ্রু কুঁচকালো। অর্নির কথায় হৃদি ওরা চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে উৎসবের দিকে৷ উৎসব বলেছিলো অর্নির সাথে ওর রিলেশন নেই তাহলে অর্নি এখন এসব বলছে কেন? এখানে তো মাহিরও নেই। মাহির অনেকটা দূরে দাঁড়িয়েই এদিকে তাকিয়ে আছে। উৎসব এক পলক মাহিরের দিকে তাকালো। তারপর অর্নির হাত ধরে মাহিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“কি ব্যাপার? বারবার বারন করা স্বত্তেও বিরক্ত করছো কেন ওকে?”
–“বিরক্ত করছি না, ভালোবাসি তাই কনভেন্স করার চেষ্টা করছি।”
মাহিরের এমন জবাবে উৎসবের রাগ হলো কিছুটা৷ এই ছেলে তো দেখছি ভারী নাছোরবান্দা। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। উৎসব আবারো বললো,
–“অন্যের গার্লফ্রেন্ডকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বানানোর জন্য কনভেন্স করছো?”
–“অন্যের গার্লফ্রেন্ড কোথায়? অর্নির তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“তাহলে আমি কে?”
–“নূরের ভাই।”
–“উহুঁ, ভুল বললে। নুরের ভাইয়ের পাশাপাশি অর্নির বয়ফ্রেন্ডও।”
মাহির ক্ষানিকটা সময় হাসলো তারপর বললো,
–“বোকা পাইছেন আমারে? যা বলবেন তাই বিশ্বাস করবো? আপনাদের দেখে কে বলবে আপনারা রিলেশনে আছেন? দুজনকে কাছাকাছি তো দূরে থাক, একজনের আশেপাশেও আরেকজন কে দেখা যায় না৷ দুজনের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয় না। আর নিজেদের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দাবী করছেন। হাউ ফানি।”
উৎসব দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“কাছাকাছি থাকলেই ভালোবাসা হয় না। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়।”
শেষ কথাটা উৎসব একদম নরম স্বরে অর্নির দিকে তাকিয়ে বললো। এতে অর্নি ক্ষানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। উৎসবের এমন চাহনীর ব্যাখ্যা খুঁজে পেলো না অর্নি। উৎসব মাহিরকে পুনরায় বললো,
–“লাস্ট টাইম ওয়ার্নিং করছি, অর্নিকে বিরক্ত করা তো দূরে থাক ওর আশেপাশেও যাতে না দেখি তোমাকে।”
মাহির অর্নির হাত ধরে অর্নিকে ওর পাশে নিয়ে এসে বললো,
–“আমাকে অর্নির পাশেই দেখবেন সারাজীবন। ও আপনার গার্লফ্রেন্ড হোক আর যাই হোক সেটা দেখার বিষয় না। অর্নি তো আমারই হবে৷ বিয়ে তো ওকে আমি করেই ছাড়বো আর সেটা খুব শীঘ্রই।”
আচমকাই উৎসব মাহিরের গালে সজোরে চ/ড় মারলো। তা দেখে ভড়কে গেলো অর্নি। এর জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। উৎসব অর্নিকে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো,
–“নেক্সট টাইম ওকে স্পর্শ করার আগে এই চ/ড় এর কথা যেন মাথায় থাকে।”
বলেই অর্নির হাত ধরে হনহন করে চলে গেলো ওখান থেকে। মাহির রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের যাওয়ার দিকে।
–
রিসোর্টে ফিরে এসে অর্নির হাত ছেড়ে দিলো উৎসব৷ অর্নি জিজ্ঞেস করলো,
–“এটা কি ছিলো?”
উৎসব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কোনটা?”
–“মাহিরকে চ/ড় মারলেন কেন?”
–“কেন চ/ড় মারাতে ব্যাথা কি ওর গালে না লেগে তোমার গালে লেগেছে?”
উৎসবের এমন বাঁকা কথায় অর্নি কপাল কুচকালো। অর্নি বললো,
–“আজব, এভাবে কথা বলছেন কেন?”
উৎসব ক্ষানিকটা উঁচু গলায় বললো,
–“তো কিভাবে বলবো? চ/ড় মেরেছি বেশ করেছি৷ প্রয়োজনে আরো কয়েকটা মারবো৷ তুমি পালটা প্রশ্ন করো কেন, চ/ড় মেরেছি কেন?”
–“আরেহ ভাই, বুঝিয়েই তো বলছিলেন হঠাৎ করে চ/ড় মারার কি হলো ওখানে?”
–“গার্লফ্রেন্ডকে অন্য পুরুষ স্পর্শ করলে সেই পুরুষকে চ/ড় মারা বয়ফ্রেন্ডের জন্মগত অধিকার।”
–“আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড নই। নূরের ভুলভাল আইডিয়ার জন্য মাহিরকে পিছু ছাড়ানোর জন্য অভিনয়টা করতে হচ্ছে, নয়তো কক্ষনো করতাম না।”
উৎসব হঠাৎ করেই রেগে গেলো৷ আনিতার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“মাহির স্পর্শ করবে কেন তোমাকে?”
অর্নি উৎসবের চোখের দিকে তাকিয়ে চট করেই প্রশ্ন করলো,
–“তাতে আপনার কি?”
উৎসব হাত সরিয়ে নিলো অর্নির বাহু থেকে৷ দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। কিছু সময় নিরব থেকে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“জানি না।”
অর্নি পুনরায় বললো,
–“মাহির আমাকে স্পর্শ করাতে আপনি ওর গায়ে চ/ড় মারলেন, আপনিও তো আমার কেউ না৷ তাহলে আপনি বারবার স্পর্শ করেন কেন আমায়?”
অর্নির প্রশ্নে উৎসব শান্ত চোখে তাকালো অর্নির দিকে৷ কিছু না বলে একদৃষ্টে অর্নির মুখপানে তাকিয়ে আছে ও। যেন মুখের দিকে তাকিয়ে অজস্র মাস অজস্র বছর কাটিয়ে দিতে পারবে৷ উৎসবকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে অর্নির৷ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
–“কি হলো, কথা বলছেন না কেন? আপনি আমাকে বারবার স্পর্শ করেন কেন বলুন?”
উৎসব থমথমে গলায় বললো,
–“তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি।”
–“একশ বার বাধ্য আপনি। আমাকেই স্পর্শ করবেন আবার আমি স্পর্শ করার কারন জানতে চাইলে বলবেন বলতে বাধ্য নই, এটা তো হবে না।”
–“সা’য়াদাত আবরার উৎসব কাউকে কোনো জবাবদিহি করা পছন্দ করে না।”
কথাটা বলেই হনহনিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে৷ অর্নি উৎসবের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,
–“অদ্ভুত লোক।”
চলবে~