রংধনু-৩য় পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
আমার সমস্ত পৃথিবী মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেলো। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি মাথা ঘুরে পরে যাবো। আজাদ একজন বিবাহিত পুরুষ তার একটা ছেলে রয়েছে, যার কোন কিছুই আমাদের জানানো হয়নি। আমাদের সাথে ধোকাবাজি করা হয়েছে। ঠকানো হয়েছে আমাকে। কেন এমনটা করলো যখন ভেবে চলছিলাম ঠিক তখনি আরিশা বাচ্চাটাকে টেনে কোলে নিতে নিতে বলে উঠলো,
আরিশা: নিশাদ মা বিদেশ থেকে এসেছে, বিশ্রাম নিতে দাও দেখবে মা সারাদিন তোমার সাথে খেলবে।
নিশাদ: আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি?
আমার ভিতরে কষ্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ালাম। আরিশা আমার হাত ধরে টেবিলে নিয়ে আসলো।
সবাই নিজেদের মত করে নাস্তা করছে, আমার মুখ দিয়ে কিছুই ঢুকছে না। বার বার শুধু মনে হচ্ছে এই বাড়ির সবাই প্রতারক, আমার সাথে এরা প্রতারণা করেছে। এদের দেখতে যতটা ভদ্র দেখায় বাস্তবে এরা ঠিক ততটাই নোংরা মানুষিকতার লোকজন।
মা: কি চিন্তা করছো প্রিয়া?
মাথাটা নাড়িয়ে বললাম কিছু না।
মা: তোমার কি বাড়ির কথা মনে পরছে? তুমি কি তাদের সাথে কথা বলতে চাও?
হ্যাঁ তবে এখন না পরে বলবো মা। বলেই হাত ধুয়ে চলে উঠে দৌঁড়ে চলে আসলাম দু’তলায়। বিছানায় পরে কান্না করে চলেছি, কি হলো, এরা কেন আমার সাথে এমন প্রতারণা করলো। আমার অপরাধ কি ছিলো। মামার বাড়িতে মামীর বকা আর মাঝে মাঝে মাইর খেতাম। সেটাও ভালো ছিলো, সেখানে সত্যতা ছিলো। কোন রকম ছল চাতুরী ছিলো না। এমন সময় আজাদ ঘরের ভিতর ঢুকলো, আজাদের সাথেই ছোট নিশাদ। তখন ভালো করে দেখা হয়নি বাচ্চাটাকে। চোখ জুড়িয়ে আসার মত একটা বাচ্চা। হাসলে থুতনীতে ছোট একটা টোল পরে। দেখতে একদম বাবার মতই ফর্সা। চোখ দু’টোতে অনেক মায়া।
নিশাদ এসে আমার পাশেই বসলো আজাদ বারান্দায় যেয়ে সিগারেট জ্বালালো। আমি নিশাদের সাথে দুষ্টমি করছি, খেলছি আর লক্ষ রাখছি কখন আজাদের হাতের সিগারেট শেষ হয়। তার সাথে যে আমার অনেক কথা রয়েছে, আমার যে তাকে প্রশ্ন করতে হবে কেন সে এমন প্রতারণা করলো আমার সাথে। এক সময় আজাদ হাত থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি নিশাদকে বললাম তুমি ফুপির কাছে যাও একটু পর মা ডেকে নিয়ে আসবো তোমাকে। নিশাদ আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
নিশাদ বের হতেই আমি ব্যালকনিতে প্রবেশ করলাম। অনেক সুন্দর করে সাজানো জায়গাটা। বেশ কয়েক রকমের ফুল আর লতাপাতা গাছ দিয়ে সাজানো। বাম পাশে দু’টো চেয়ার আর একটা ছোট টেবিল রাখা রয়েছে। টেবিলের উপর রয়েছে ইংরেজী ম্যাগাজিন। আমার কাছে ব্যালকনিটা অসাধারণ লেগেছে। এখানে দাঁড়ালে মেইন গেটের বাহিরের বড় রাস্তার অনেকটা পথ দেখা যায়। এছাড়া বাড়ির ভিতরের সুন্দর বাগানটাও পুরোপুরি দেখা যায়। আমি আজাদের পাশে দাঁড়ালাম আজাদ প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তিতে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে এই প্রথম আমার দিকে তাকিয়ে কথা বললো।
আজাদ: তুমি কি কিছু বলবে?
হ্যাঁ আমার সাথে আপনারা কেন এমন প্রতারণা করলেন?
আজাদ: এবার বেশ কিছুটা চমকে কিসের প্রতারণা? তোমার কথার কোন কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। প্লীজ একটু বুঝিয়ে বলবে কি?
দেখুন আমি জানি আপনি বুঝেও না বুঝার অভিনয় করছেন। তবুও যেহেতু বলতে বললেন আমি নিশ্চই বলবো। তার আগে আমার কথা কিছু বলি।
আজাদ: হুম বলো।
ছোট বেলায় বাবা মা মারা যায়। তারপর থেকেই মামার বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে থেকেছি। মামা কখনোই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু মামী কারণে অকারণে যখন ইচ্ছে হতো তখনি গায়ে হাত তুলতো। নানান রকম ভাবে অপমান করার চেষ্টা করতো। আমি নিরবে সব অপমান মাথা পেতে নিতাম। কেননা আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলো মামার বাড়ি। এভাবে চলতে চলতে আমার সব কিছু সহ্য হয়ে গেলো। মামীর বকার পাশাপাশি মামার একটু আদর আর স্নেহ আমার সব কষ্ট দূর হয়ে যেতো। সেই সাথে মামাতো ভাই বোন দু’টোকে সাথে নিয়ে আমার বেশ কেটে যাচ্ছিলো। মামীর কেমন করে জানি আমার উপর করুণা হলো। একটা সময় সে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। আমার লেখাপড়া শুরু হলো।
আমি ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো। আর বাবা মা না থাকায় টিচাররাও আমাকে অনেক কেয়ার করতো। এভাবেই এগিয়ে চলতে চলতে আমার এস এস সি আর ইন্টার শেষ হলো। ইচ্ছা থাকার পরেও মামার অভাবের সংসারে আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি।
আজাদ: আচ্ছা তুমি আমাকে এসব কেন বলছো? তুমি কি লেখাপড়া করতে চাও?
না আমি তা বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, সব কিছুর পরেও আমি ভালোই ছিলাম। মামীর কটূকথা শুনেও ভালোই ছিলাম। কিন্তু আমাকে প্রতারণা করে কেন বিয়ে করে নিয়ে আসলেন?
আজাদ: অবাক হয়ে প্রতারণা করেছি মানে? কিসের প্রতারণা?
আপনি বিবাহিত আপনার একটি ছেলে সন্তান রয়েছে এসব না জানিয়ে কেন আপনি আমাকে বিয়ে করলেন?
আজাদ: তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমরা কোন রকম প্রতারণা করিনি। ঘটক তোমার মামাকে সব জানিয়েছে এমন কি আমার মা ও তোমার মামাকে সব বলেছে। সব কিছু জেনে শুনেই তোমার মামা রাজি হয়েছেন। আর আমিতো জানতাম তোমার মামা তোমাকেও জানিয়েছে। দেখো তোমার সাথে আমি বা আমার পরিবার কোন রকম প্রতারণা করিনি। আর তোমার মামাকে এটাও বলেছি তোমাকে সব কিছু জানানোর জন্য। আমি ভেবেছি সে তোমাকে সব জানিয়েছে। আমার নিজের কোন ইচ্ছে ছিলো না বিয়ে করার। মায়ের বয়স হয়েছে। আরিশা ভার্সিটিতে চলে যায়। নিশাদের দেখা শোনা করতে মায়ের কষ্ট হয়। তাই মা আর আরিশার কথা রাখতেই আমার তোমাকে বিয়ে করা।
আজাদের কথায় আমি একদম স্তব্দ হয়ে গেলাম। যে মামা আমাকে এতো স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছে। সেই মামাই কিনা শেষ পর্যন্ত আমার সাথে এমনটা করলো। সত্যিই কি মামা এমনটা করেছে নাকি আজাদ মিথ্যা বলছে কথা গুলো ভাবতেই দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরতে শুরু করলো।
আজাদ: দেখো আমি তোমার উপর স্বামীর কোন অধিকার খাটাইনি আর আগামিতেও খাটাবো না। যদি তোমার মনে হয় তুমি এ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছুক নও। তবে আমাকে তুমি জানাবে আমি তোমাকে তোমার মামার বাড়িতে দিয়ে আসবো। কিন্তু যে কয়দিন তুমি থাকবে দয়া করে আমার পরিবারের মানুষ গুলোকে আঘাত করে কোন কথা বলো না।
কথা গুলো বলে আজাদ ব্যালকনি থেকে বের হয়ে রুম থেকে নিশাদকে কোলে নিয়ে বের হয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছি। নীল আকাশ কোথাও মেঘ জমেনি আজ অথচ আমার হৃদয় মাঝে ঘন কালো মেঘেদের বসবাস শুরু হয়ে গিয়েছে। হায় আল্লাহ এই কোন পরীক্ষায় আমি পরলাম। জীবনের সব সাজানো স্বপ্ন গুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে কখনো ভাবিনি আমি। এমন পরিস্থিতির জন্য পৃথিবীর কোন মেয়েই হয়তো প্রস্তুত থাকবে না। আমিও ছিলাম না। কথা গুলো এক মনে ভেবে চলেছি এমন সময় আরিশা পাশে এসে দাঁড়িয়ে ভাবী কি ভাবছো এমন আনমনে?
আমি সাথে সাথেই আরিশার দিকে ঘুরে তাকিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে না তেমন কিছু না।
আরিশা: তুমি কাঁদছো কেন? ভাইয়া তোমাকে কিছু বলেছে?
আরে না না তা না বাড়ির সবার কথা মনে পরছে তাই মনটা একটু খারাপ লাগছে।
আরিশা: ওহ এই কথা আচ্ছা এই নাও ফোন তুমি বাড়িতে ফোন দিয়ে কথা বলো আমি নিশাদকে একটু দেখে আসছি।
কথাটা বলে আরিশা ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে মামার নাম্বারে ফোন দিলাম।
রিং বাজার সাথে সাথেই মামা ফোন রিসিভ করতেই, কেমন আছো মামা?
মামা: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা তুই কেমন আছিস?
হুম ভালো আছি, মামা তুমি আমার সাথে কি করে এমনটা করলে? একবারও কি তোমার মনে হয়নি আমার কাছে কথাটা বলা দরকার ছিলো তোমার?
তুমি না বলতে আমি তোমার মেয়ে তবে কেমন করে এমনটা করতে পারলে তুমি?
মামা: মারে আমি অনেক বার তোকে বলতে চেয়েও কথাটা বলতে পারিনি। আমার সাহস হয়ে উঠেনি। আমাকে তুই ক্ষমা করে দে। তবে এটা বিশ্বাস কর আমি যা করেছি তোর ভালোর জন্যই করেছি। আজ হয়তো তোর কাছে খারাপ লাগছে আমাকে অপরাধী মনে হচ্ছে কিন্তু একটা সময় দেখবি তুই অনেক সুখে থাকবি আর আজকের অভিযোগ গুলো তখন তোর নিজের কাছেই অর্থহীন মনে হবে।
আমি জানি না মামা আমার জীবনের আগামি দিন গুলো কেমনে কাটবে। তবে আমি কখনোই এমনটা চাইনি। এমন পরিস্থিতির জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তুমি চাইলে আমাকে বলতে পারতে। আমি কি কখনো তোমার কোন কথার অবাধ্য হয়েছি?
মামা: আমি জানি তুই অবাধ্য হতে না। কিন্তু কেমন করে আমি তোকে বলতাম বল একজন বিবাহিত পুরুষ যার স্ত্রী মারা গেছে একটা বাচ্চা ছেলে আছে তার সাথে তোকর বিয়ে দিচ্ছি।
মামার গলা শুকিয়ে এসেছে আমি বুঝতে পেরে, জিজ্ঞাসা করলাম মামী, রিফাত, ঝুমা ওরা সবাই কেমন আছে?
মামা: সবাই ভালো আছে, তুই পারলে জামাইকে নিয়ে বেড়াতে চলে আয় দেখবি তোর ও ভালো লাগবে।
দেখি মামা আচ্ছা রাখছি পরে তোমাকে ফোন দিবো। বলেই লাইনটা কেটে দিলাম। এমন সময় দরজা খুলে নিশাদ দৌঁড়ে আসলো মা মা বলতে বলতে।
#চলবে…