বইছে আবার চৈতী হাওয়া ৫৬

0
341

বইছে আবার চৈতী হাওয়া
৫৬
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আশিক থমকে গেলে। ঘরের আলো নেভানো। টেবিলের উপর টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলছে শুধু । মীরাকে দেখা যাচ্ছে চেয়ারে বসে আছে। টেবিল ভর্তি বই পত্র ছড়ানো, বোঝাই যাচ্ছে পড়াশোনার চেষ্টা চলছিল। মিরা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। কান্নার দমকে শরীরটা কেপে কেঁপে উঠছে বারবার। আশিকের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো। মীরাকে আঘাত দেওয়ার কথা ও কল্পনাতেও ভাবেনা কখনো , অথচ আজকে ওর কারণে এতটা কষ্ট পাচ্ছে মীরা।

আজ ভোর রাতে মিরা খুব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল
আপনি কোন ঝামেলা করবেন না তো ?
আশিক জবাব দেয়নি। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল “ঘুমিয়ে পড়ো” এর আরও অনেক, অনেকক্ষণ পর মীরা ঘুমিয়ে পড়ার পর আশিক উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

আজ থেকে ওদের গ্রুপ স্টাডি করার কথা জগন্নাথ হলে, রিপনের রুমে। ফাইনাল ইয়ার বলে রিপন আলাদা রুম পেয়েছে। পড়াশোনাটা এখানে ভালই হয়, আড্ডাও হয়। আজ সবারই আসার কথা। ভালই হলো। রাসেলের সঙ্গে বোঝাপড়াটা খুব জরুরী।

রিপনের রুমটা দোতালায়। জানালার পাশে খাট তার পাশে টেবিল, যদিও সবাই বসেছে মেঝেতে। ওদের সবার মধ্যে সবচাইতে ভালো ছাত্র রিপন।নোটপত্র সব ওই তৈরি করে। তবে পড়ায় সুমন। একটু মুখচোরা ধরনের এই ছেলেটা অসম্ভব ভালো বোঝাতে পারে। সবাই চলে এসেছে শুধু রাসেল আসেনি। বিছানার উপর বসে সবাই এক দান তাস খেলে নিচ্ছে আর ঘরের এক কোণে বসে সুমন নোটের পাতা উল্টে যাচ্ছে। সবাইকে বোঝাতে হলে আগে ওর একটু দেখে নিতে হবে। আশিক ঘড়ি দেখলো। সাড়ে নয়টা বাজে। রাসেলের এখনও আসার নাম নেই। আশিক হাতের কার্ডটা নামিয়ে রেখে বলল
– রাসেল এখনো এলোনা? একটা ফোন দে না।
সুমন হাতের কাগজ রেখে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল
– একটু আগে মেসেজ পাঠিয়েছে। প্রায় চলে এসেছে। ও আসলেই শুরু করব

– তোরা বস, আমি ওকে নিয়ে আসছি
– নিয়ে আসার কি আছে?
– আসছি। একটা সিগারেটও খেয়ে আসি
আশিক নেমে গেল। রাসেলকে আজকে ধরতেই হবে। ওকে আজ বলতেই হবে এই কাজটা ও কেন করল। রাসেলকে দূর থেকে হেঁটে আসতে দেখা যাচ্ছে । আশিক এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল
– চল বিড়ি খেয়ে আসি
– দুজন গেটের বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরালো
– চা খাবি?
– না, চল ভেতরে যাই
রাসেল ভেতরে যেতে উদ্যত হল। আশিক ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল
– একটু পরে যাই
রাসেল কেমন একটু মিইয়ে গেল। আসিক সিগারেট ফেলে দিয়ে বলল
– তুই এই কাজটা কেন করলি রাসেল ?
রাসেল একটু কেঁপে উঠলো। মুখে বলল
– কোন কাজটা ?
– তুই জানিস না কোনটা? তুই মিরাকে ফোন করে মিথ্যা কথা কেন বলেছিস? আশিকের শরীর একটু একটু কাঁপছে । রাগটা বাড়ছে। ইচ্ছা করছে ঘুষি মেরে রাসেলের নাক ফাটিয়ে দিবে। রাসেল আড়চোখে একবার আশিককে দেখল। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ছোটবেলায় এরকম অনেক বার হয়েছে এবং তার ফলও হয়েছে ভয়ঙ্কর। রাসেল এগিয়ে এসে আশিকের হাত ধরল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
– আমাকে মাফ করে দে দোস্ত
– এটা আমার প্রশ্নের উত্তর না।
– আমার খুব রাগ হয়েছিল।
– রাগ? কার উপর?
– তোদের দুজনের উপরেই। মীরার কারনে তুই আমার কলারে হাত দিয়েছিলি।
– আর মীরা? ও কি করেছে তোর ?
– মীরা আমাকে দেখলে এমন ভাব করে যেন আমি পথের কুকুর। সবার সঙ্গে ঠিকি কথা বলে। আমি কি এতই খারাপ?
– তাই তুই প্রমান করলি যে তুই কতটা খারাপ?
– তোদেরকে একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম তোর ইমেজটা নস্ট হোক।
আর মীরা? ও কি করেছে তোর? ওর এই ক্ষতিটা তুই কেন করলি?
– আমি মানছি শুভকে ফোন করাটা আমার উচিত হয়েনি, দরজা বাইরে থেকে লাগানোটাও বিরাট ভুল হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস কর তোদের কোন ক্ষতি আমি করতে চাইনি।
আশিক অবাক হতেও ভুলে গেল। কোনমতে বলল
– তুই কি বলেছিস শুভকে?
রাসেল ভয়ে ভয়ে বলল
– বলেছি তোর আর মীরার মধ্যে কিছু আছে। ও আগেও তোর অফিসে রাত কাটিয়েছে
আশিক টের পেল ওর সমস্ত শরীর বেয়ে তীব্র ক্রোধের একটা স্রোত বয়ে যাচছে। এতক্ষনের সামলে রাখা বাধটা আচমকাই ভেঙে গেল। ও রাসেলের চোয়াল বরাবর একটা ঘুষি মারল। আচমকা এই আঘাতের জন্য রাসেল প্রস্তুত ছিল না। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। আশিক তবু থামল না। পেটের মধ্যে পরপর কয়েকটা লাথি মাড়ল। রাসেল বাধা দিল না। কোঁকাতে কোঁকাতে বলল
– মার, যত ইচছা মার। আমি তোর কাছে অন্যায় করেছি
– তুই মীরার সাথে এটা কেন করলি ? বল কেন করলি হারামজাদা? তোর কারনে ওর সঙ্গে শুভর সম্পর্কটা ভেঙে গেল।
রাসেল পেট চেপে ধরে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল
– আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু শুভ ওকে ভালবাসতো না। নহলে আমার কথা শুনে সম্পর্কটা ভাঙত না। আর তুই আমাকে না বললে কি আমি বুঝি না যে মীরাকে তুই ভাল……।
রাসেল কথা শেষ করতে পারল না তার আগেই আরো একটা ঘুসি এসে পরল ওর নাক বরাবর। নাক বেয়ে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল। রাসেল নাক চেপে ধরে বলল
তুই আমাকে যত খুশি মার কিন্ত দোহাই লাগে আঙ্কেলকে বল কেসটা তুলে নিতে। বাবা এম্নিতেই অসুস্থ, এসব জানলে মরে যাবে।
আশিক এবার থামল। ও জানে রাসেলের বাবা প্যরালাইজড। ওর মা অনেক কস্ট করে ওদের সংসারটা চালিয়েছেন। ওর একটা ছোট বোন আছে। এখন ওর বিরুদ্ধে কেস হলে পরিবারটা ভেসে যাবে।
আশিক একটা হাত বাড়িয়ে রাসেল কে টেনে তুলল। তারপর বলল
চিন্তা করিস না। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলব।
————–
আশিক আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল। মীরার কাছে আসতেই ও চমকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর হড়বড় করে বলল
– কোথায় ছিলেন আপনি? আমি সারাদিনে কত বার ফোন করেছি। বলতে বলতে ওর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। আশিক ওকে কাছে টেনে নিল, তারপর দুই হাতে ওর নিটোল মুখটা তুলে ধরে বলল
এইভাবে কাঁদে কেউ? কি অবস্থা করেছ?
মীরার ভোখ ভর্তি জল। ও আশিকের বুকের মধ্যে মুখ গুজে বলল
-কোথায় ছিলেন আপনি? রাসেল ভাইয়ের কাছে তাইনা?
-হু
-কেন? আপনার বিশ্বাস হয়েনি আমার কথা?
-হয়েছে তো?
-তাহলে কেন?
-আমার জানার দরকার ছিল ও এটা কেন করেছে।
-আমার ফোন ও ধরেননি সারাদিন
-আচছা ভুল হয়েছে আমার। সরি
-আমি কত টেনশনে ছিলাম। আপনাকে আমি, আমি কতবার বললাম আমি উনার কথা বিশ্বাস করিনি।
আশিক ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলল
-আমি জানি তুমি ওর কথা বিশ্বাস করনি, করলে তুমি আমার এত কাছে আসতে না।
মীরা জবাব দিল না। আশিক ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
এখন আর একটু কাছে আসবে?
কাছেই তো আছি। আর কত কাছে আসব?
আশিক ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল

“কাছে আসো আরো কাছে, সহজেই যেন চোখে পড়ে
তোমার সূক্ষ্ম তিল, আঙুলের সামান্য শিশির
যেন দেখি তোমার সজল চোখ, তোমার মদির সলজ্জতা
দূরদৃষ্টি নেই মোটে, কেবল কেবল সন্নিকটে।
তুমি খুব কাছে আসো, খুব কাছে, ঠিকই খুব কাছে
যতোখানি কাছে এলে আর কোনো আড়াল থাকে না”

চলবে…………

আজকের কবিতার নাম “কাছে আসো, সম্মুখে দাঁড়াও” লিখেছেন মহাদেব সাহা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here