#রংধনু-৪র্থ পর্ব
#লেখনীতে_শাহরিয়ার
নিশাদ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি নিশাদকে কোলে তুলে নিলাম আর আরিশাকে তার ফোনটা দিয়ে দিলাম। এই প্রথম কেন জানি সত্যি সত্যি নিজের ভিতর থেকে এক অন্যরকম মায়ার আবির্ভাব হচ্ছিলো। ছোট বেলা থেকে মা বাবা ছাড়া আমি বড় হয়েছি। তাই এর কষ্ট বুঝি, হয়তো আমি নিশাদের জন্মদাত্রী মা নই। কিন্তু তবুও আমি ওর মা। আমি আমার সাধ্যমত ওকে ভালো ভাবে লালন পালন করবো বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম।
আরিশা: এই ভাবী কোথায় হারালে?
কই নাতো কিছু না।
আরিশা: ভাইয়াকে খুঁজছো নাকি? লাভ নেই ভাইয়া এখন বাহিরে বের হয়েছে কখন ফিরবে তা বলা যায় না। তবে ঘরে যেহেতু আমার সুন্দরি নতুন ভাবী তাই আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে আশা করা যায়।
তোমার ভাইয়া আবার কোথায় গেলো?
আরিশা: কোথায় যাবে হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়েছে।
আচ্ছা আরিশা সেদিন তুমি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলে তোমার ভাইয়ার সম্পর্কে আজ বলো তাহলে শুনি।
আরিশা: সে অনেক কথা ভাবী। শোন তবে, ভাইয়া ছোট বেলা থেকেই ছিলো বেশ চঞ্চল। পুরো বাড়ি হাসি আনন্দে মাতিয়ে রাখতো সব সময়। ভাইয়ার ভার্সিটি জীবন শেষ করার আগেই বাবা মারা যায়। তখন থেকে বাবার ব্যবসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ভাইয়া বুঝে নেয়। লেখাপড়া আর ব্যবসা দু’টোই এক সাথে শুরু হয়। এর মাঝেই পরিচয় হয় ভাবীর সাথে দুই বছরের রিলেশনের শেষে ভাইয়া ভাবীকে বউ করে নিয়ে আসে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়। দু’জনের সংসারও চলছিলো বেশ। দু’জনের মাঝে বুঝাপড়া আর ভালোবাসার কমতি ছিলো না। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমাদের বাড়ি আলো করে আসে নিশাদ। সেদিন ভাইয়া ভাবী কারোরই আনন্দের শেষ ছিলো না। আমরা সকলে এতো এতো আনন্দিত হয়েছিলাম যা বলে বুঝাতে পারবো না তোমাকে। বেশ যাচ্ছিলো দিন গুলো। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন ভাবী মাথা ঘুরে পরে যায়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো নরমাল কোন সমস্যা। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কিছু টেস্ট করানো হয়। সেখান থেকে বের হয়ে আসে এক ভয়ংকর সত্য। যা আমরা কেউ কোন দিন কল্পনাও করিনি। ভাবীর ব্রেণ ক্যান্সার আর সব চেয়ে বড় কথা খুব দ্রুত তা ভাবীর সমস্ত শরীরে সরিয়ে পরে। ভাইয়া চিকিৎসার কোন রকম কমতি রাখেনি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি আস্তে আস্তে একটা সময় ভাবীর শরীর দূর্বল হতে থাকে। এবং নিশাদের বয়স যখন এক বছর তখন ভাবী আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। ভাইয়া এতে হয়তো প্রচণ্ড আঘাত পায় যার কারণে আস্তে আস্তে ভাইয়া এমন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাবী বিশ্বাস করো ভাইয়া সত্যিই অসাধারণ একজন মানুষ। আর একটা মানুষ সারা জীবন কি করে একা কাটিয়ে দিবে বলো। তাই আমি আর মা অনেক বুঝিয়ে অবশেষে তোমার সাথে ভাইয়ার বিয়ে দিয়েছি।
আরিশার চোখের কোনে পানি টলমল করছে। আসলেই ভালোবাসার মানুষ গুলো আমাদের কাঁদিয়ে খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। আমরা চাইলেও তাদের ধরে রাখতে পারি না।
আরিশা: ভাবী তুমি আমার ভাইয়ার মুখে আবার হাসি ফিরিয়ে দিবে। কি দিবে না?
বলেই আরিশা আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমার মুখ থেকেও বের হয়ে গেলো এটাতো আমার দায়িত্ব। আরিশার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি নিশাদকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলাম। কখনে কখনো জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। নিশাদ আরাম পেয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিলো।
দুপুরে খাবার টেবিলে আজাদ আসলো না। আমি নিশাদ কে খায়িয়ে দিলাম। খেতে খেতে মা আমাকে বললো বউমা তুমিতো সব কিছুই জানো তোমাকে আর কি বলবো। তোমার হাতেই এখন সব কিছু। আমার ছেলের এলোমেলো জীবনটা আবার আগের মত গুছিয়ে দেবার দায়িত্ব তোমার।
আমি মাথা নত করে বললাম। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো মা। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
মা: চেষ্টা না তোমাকে পারতেই হবে তার জন্য যত কিছু করা লাগে। যে কোন সাহায্য লাগে আমি তোমাকে করবো।
মা আপনি তাহলে আমাদেরকে আমার মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিন কয়েকদিনের জন্য। গ্রামের পরিবেশে উনার ভালো লাগবে আমার মনে হয়।
মা: আমিও তাই ভাবছিলাম আর তোমার মামার সাথেও আমার কথা হয়েছে। সেও তোমাদের যেয়ে কয়েকদিন থেকে আসতে বলেছে। এখন দেখি আজাদকে কি করে রাজী করানো যায়।
খাওয়া শেষ করে নিশাদকে সঙ্গে নিয়ে দু’তলায় চলে আসলাম। বিছানায় শুয়িয়ে দেবার অল্প সময় পরেই নিশাদ ঘুমিয়ে গেলো। আমিও ওর পাশেই শুয়ে রইলাম অল্প সময়ের মাঝে দু’চোখের পাতা লেগে আসলো। বিকেলে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আজাদ ঘরে ঢুকেছে। আমি উঠে বসতেই আজাদ ওয়াশ রুমে চলে গেলো। আমি বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে উনার জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে দু’তলায় চলে আসলাম। ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই খাবার খেতে বললাম।
আজাদ: আমার ক্ষিদে নেই।
আপনার মুখ শুকিয়ে রয়েছে খেয়ে নিন। না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবেন। আর তার জন্য সবাই আমাকে দোষী করবে। আর তাছাড়া আপনি কোন দুঃখে না খেয়ে থাকবেন?
আজাদ: আমি কেন না খেয়ে থাকবো তার কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে?
যদি বলি হ্যাঁ দিতে হবে।
আজাদ: আমি কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
আমি বলিনি আপনি বাধ্য কিন্তু আমার পূর্ণ অধিকার রয়েছে আপনার কাছে কোন কিছু জানতে চাওয়ার।
আজাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাতেই আমি হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে আজাদ বেশ বিরক্ত হয়েছে তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারলাম। নিজেকে বেশ শান্ত করে বললাম আপনি যদি না খেয়ে থাকেন তবে আমিও খাবো না। আর আপনি নিশ্চই চাইবেন না আমি না খেয়ে থাকি।
আজাদ: তুমি না খেয়ে কেন থাকবে?
আপনি খাবেন না বলে।
আজাদ: রেগে আমি না ভেয়ে থাকার সাথে তোমার না খেয়ে থাকার কি সম্পর্ক।
অনেক সম্পর্ক আছে, যেমন আমি ভালো ভালো খেয়ে ইয়া মোটা হয়ে যাবো আর আপনি না খেয়ে থেকে শুকিয়ে যাবেন। বাড়ির লোকজন বা আশে পাশের লোকজন অনেক রকম কথা বলবে। তা শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগবে না নিশ্চই। আর আপনি তা চান না।
আজাদ: কি আজব মানুষ খেলেই কি মোটা হয় নাকি?
হুম আমি হই।
আজাদ: দেখো এসব ন্যাকামি দেখাবে না একদম আমার সামনে আমার সহ্য হয়না।
আমি মোটেও ন্যাকামি করছি না। ন্যাকামি করার স্বভাব আমার নেই। আর আপনিও নিজেকে কষ্ট দিবেন না। আমাকে সহ্য না হলে সরাসরি বলে দিবেন আমি চলে যাবো। কিন্তু অনুগ্রহ করে আমাকে যতদিন এ বাড়িতে রাখবেন কোন রকম অনিয়ম করবেন না। কেননা তার জন্য সকলে আমাকেই দোষী করবে। আর আপনি নিশ্চই চাইবেন না। মা আরিশা তারা কষ্ট পাক আপনার আমার এমন সম্পর্ক দেখে।
আজাদ এবার কিছুটা নিরব হয়ে গেলো। কোন রকম কথা না বলে সে খাবার প্লেটে হাত লাগালো। আমি তার পাশেই বসে রইলাম। মানুষটার মনে হয়তো আমি জায়গা করতে পারবো না। তবে মানুষটা যেনো ভালো থাকে পরিবারকে ভালো রাখে সেদিকে আমাকে লক্ষ রাখতে হবে। আজাদ খাচ্ছে আর আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে হয়তো রাগেই তাকাচ্ছে। তাতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি চাই মানুষটা ভালো থাকুক, কেননা তার ভালো থাকার উপর নির্ভর করছে পুরো পরিবারের ভালো থাকা। হয়তো আমার ভালো থাকাটাও তার ভালো থাকার উপর নির্ভর করছে। খাওয়া শেষ হতেই আমি প্লেট গুলো উনার সামনে থেকে নিয়ে নিচে ডাইনিং এ রেখে উপরে এসে দেখি উনি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আবার সিগারেট জ্বালিয়েছে। আমি আস্তে আস্তে যেয়ে উনার পাশে দাঁড়ালাম।
আজাদ: একি তুমি এখানে কেন? কিছু বলবে?
হ্যাঁ আপনি এতো সিগারেট কেন খান?
আজাদ: সিগারেট খাওয়া যায় না, এটাকে বলে ধুমপান করা।
ঐ হলো একই কথা, এটা ছেড়ে দিন। এটা ভালো না।
আজাদ: সব ভালোই কি ভালো? এতো ভালো দিয়েই বা কি হবে? আমার কাছে ভালো লাগে এটাই আসল কথা।
দেখুন আপনি তো আর সেই ছোট বেলা থেকেই ধুমপান করেন না। তাছাড়া আমার সহ্য হয়না সিগারেটের ধোয়া। নিশাদ আমি আপনি সকলের জন্যই এই সিগারেটের ধোয়া খারাপ।
আজাদ: আমিতো তোমাদের থেকে দূরে থেকেই সিগারেট খাই। তুমি ভিতরে চলে যাও।
আমাদের থেকে দূরে খান কিন্তু নিজেকেতো শেষ।করে দিচ্ছেন। তাই খাওয়া ছেড়ে দিন। জীবনে কোন কিছুই থেমে নেই আর কোন কিছুই থেমে থাকবে না। কথাটা বলেই আমি ব্যালকনি ছেড়ে রুমের ভিতর ঢুকে পরলাম। আজাদ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে দ্রুত নিশাদকে কোলে তুলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। মানুষটা সত্যিই অনেক ভালো মনের এটা তার কথায় আর ব্যবহারেই বুঝা যায়। তাই তার এই বাজে স্বভাবটা যে করেই হোক পরিবর্তন করাতে হবে। কেন জানি মানুষটার প্রতি আমার তীব্র মায়া জন্মাতে শুরু করেছে। হয়তো এভাবেই মায়া থেকেই ভালোবাসার শুরু হয়। জগৎ অনেক কিছুই উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা যায় না।
#চলবে…