#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৩
অপেক্ষার প্রহর,
হয় না-কো ভোর,
তবু পথো চেয়ে থাকা।
দিনগুলো ক্লান্তময়,
ক্লান্ত দীর্ঘ শ্বাস।
বিটিভিতে ‘অপেক্ষার প্রহর’ ধারাবাহিক চলছে। গ্ৰামের এক জনম দুখীনি মা তার সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে। তার ধারণা সন্তান আসবে। আগে এই ধারাবাহিকটির প্রতি অনুভূতি কাজ না করলেও আজ প্রবল করছে। বুঝতে পারছি কেন এতদিন সবাই এটি দেখেছে। আমিও অপেক্ষায় আছি, সবাইকে দেখার। আনমনে ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে থাকা অশ্রুটুকু মুছে নিলাম। দাদিজান তখন নিচে নামলেন। সবাইকে বিটিভি দেখতে দেখে ডাকলেন আবুল চাচাকে। আবুল চাচা দেখতে মোটাসোটা, আর বাদল চাচা চিকন আলীর মতো। দুজনেই উপস্থিত হলো সেখানে। দাদিমা চুপ থেকে বললেন, “তিনদিন আগে তোদের দু’জনকে ক্যাসেড আনতে বলেছিলাম। এনেছিস?
আবুল চাচা মাথা নেড়ে বলে, “জি বেগম সাহেবা। এনেছি।”
“তাহলে চালু কর। আমিও আজ ওদের সাথে টিভি দেখবো।”
দূর থেকে সবকিছু দেখে হাসলাম। শহরে থাকতে অপূর্ব ভাইয়ের ক্যাবল টিভিতে বিটিভি ছাড়া অন্য চ্যানেল দেখেছি। আজ সিডিতে দেখব। আবুল চাচা চালু করলেন সিডি। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। আঁধারে তলিয়ে গেল সবকিছু। দাদিজান রেগে গেলেন, তার রাগ সবসময় নাকের ডগায় থাকে। সৌর বিদ্যুৎ চালু হলো। সবাই খেতে বসলাম। আমার খেতে ইচ্ছে করলো না। তাই ঘরে গেলাম। ঘুমের মতো লাগল চোখে। ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি জানালার কাছে ময়না পাখিটা সুরেলা কণ্ঠে ডাকছে, “আরুপাখি, আরুপাখি, আরুপাখি। শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন।”
আমি হেসে ফেললাম। ময়নাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে তার ডানা দিয়ে আমাকে আগলে নিল। ডানার সাথে বাঁধা এক টুকরো কাগজ দেখতে পেলাম। লাল রঙের সুতা দিয়ে বাঁধা। কাগজটা খুলতে লেখা দেখতে পেলাম, “শুভ জন্মদিন আমাদের আরু পাখি। শুভ জন্মদিন।”
আমি জানালা দিয়ে বাইরে দেখলাম। অপূর্ব ভাইকে আবছা দেখা যাচ্ছে। ময়না উড়ে চলে গেল সেদিকে। অপূর্ব ভাই চলে গেলেন। কাগজটা বুকে জড়িয়ে নিলাম। আমার জন্মদিন ধুমধাম করে হয়। কিন্তু এবার এই বাড়ির কেউ জানতেই পারবে না , আজ আমার জন্মদিন।
তখনি দরজায় করাঘাত পড়ল। দরজার করাঘাত শুনে উঠতে ইচ্ছে করল না। কাগজটা বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরপর তিনবার টোকা পড়ে থেমে গেল। অতঃপর পায়ের শব্দ শোনা গেল। অর্থাৎ সে চলে গেছে। আমি চোখ গ্ৰথণ করে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার চেষ্টা করলাম। এক পর্যায়ে সক্ষম হলাম আচ্ছন্ন হতে। বিরতি নিল ক্লান্ত মন ও শরীর।
সকাল আটটা বাজে। সূর্যের আলো আমার ঘরে এসে পৌঁছেছে। অনেক আগেই তার আগমন ঘটেছে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। পুনরায় দরজা টোকা পড়ল। ব্যতিব্যস্ত হলাম এবার। মামা বাড়িতে নয়টা বেজে গেলেও ঘুম থেকে ডাক দিতো না, সাড়ে নয়টায় ঘুম থেকে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে টেবিলে যেতাম। মামি তাড়াতাড়ি করে দুমুঠো ভাত মুখে তুলে দিলেন। কোনোরকম খেয়ে ছুটে যেতাম স্কুলে। রাস্তায় তুর ও শেফালীকে ধরতাম। আজকের দিনের তো কথাই নেই, মামি পায়েস রান্না করতেন। সবার প্রথমে আমার মুখে পায়েস তুলে দিতেন। উপহারে ভরে যেতো আমার ঘর। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। দরজা খুলে দেখলাম, দাদিজান দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “শুভ জন্মদিন আরশি মৃধা। বেঁচে থাকো এই দোয়া করি।”
আমি এক চিলতে হেসে ফেললাম। বললাম, “আজ আমার জন্মদিন, আপনি কীভাবে জানলেঞ?”
“হম। জানতাম। আমার নাতির জন্মদিন আর আমি জানবো না। তোর নাড়ি নক্ষত্র সব জানি। আমার সাথে এসো।” হাত ধরে নিয়ে গেল সবার কাছে। বৈঠকখানায় বাড়ির সবাই তখন উপস্থিত। শপিং ব্যাগের ছড়াছড়ি। যেন একটা মার্কেট বসেছে। দাদি জান হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলেন, “তোমার পরনের উপযোগী কোনো পোশাক নেই। তাই এগুলো তোমার জন্য। (সবচেয়ে আকর্ষণীয় পোশাকটা আমার হাতে দিয়ে বলেন) আজ এটা পরবে। তোমাকে রাজকুমারীর মতো লাগবে।”
বাইরে চ্যাঁচামেচির আওয়াজে মুখরিত হলাম। দাদি জান আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন সেদিকে। বাইরে মানুষের ভিড়। দাদি জান হাতের ইশারা করতেই পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। নম্র গলায় বলতে শুরু করলেন, “আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আপনারা?”
সবাই সালামের উত্তর নিয়ে দাদি জান ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইলেন। দাদি জান উত্তরে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। গতকাল গ্ৰামের সবাইকে বলে দিয়েছিলাম আজ সকাল আটটায় উপস্থিত হতে। আপনারা এসেছেন, আমার কথা রেখেছেন। আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার আসা যাক মূল কথায়, কেন আমি আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছি।” সবাই সায় দিল। দাদি জান আমাকে সবার সামনে নিয়ে এলেন। বললেন, “এই হচ্ছে আমার নাতি। আমার মেজো ছেলের একমাত্র মেয়ে আরশি মৃধা আরু। আমার পরে আমার এই নাতি নেতৃত্ব দিবে। আমার এই নাতির জন্মের পর আমি তাকে দেখিনি। গতকাল প্রথম দেখেছি। আরুর জন্মের এক বছর পর মামার বাড়িতে চলে গেছিল। যে আমাদের চির শ/ত্রু। আমি নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আরুকে এই বাড়িতে ফিরে আনব। আমি কথা রেখেছি। কারো কাছে মাথানত করিনি। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আজ আরুর জন্মদিন। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।”
দাদি জান থামতেই উচ্চ ধ্বনিতে শুনতে পেলাম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সবকিছু আজ পূর্ণ মনে হলো। আমি হেসে দাদিজানকে জড়িয়ে ধরলাম। দাদিজানও আমার পিঠে হাত রাখলেন।
___
দিঘির পাড়ে বসে ঢিল ছুড়ে দিচ্ছি জলে। পাশে কলস রাখা। পানি দিতে এসে আসন পেতে বসেছি। মনটা বড্ড অশান্ত। আজ স্কুলে যাবো না ভেবে নিয়েছি। এমন সময়ে একজন আগন্তুক পাশে বসল। ঘাড় কাত করে দেখলাম তাকে। অপূর্ব ভাই এসেছেন। আনমনে ভেবে হাতে চিমটি কে/টে পরখ করে নিলাম। সত্যি অপূর্ব ভাই এসেছেন। অভিমানী গলায় বললাম, “আপনি এখানে? কাল রাতে চো/রের মতো এসে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। সামনাসামনি জানাতে পারেন নি?”
অপূর্ব ভাই তার ফোনটা বের করলেন। অন্যহাতে আমাকে ব্যঙ্গ করতে দিঘির জলে ঢিল ছুড়ছেন। উত্তর না পেয়ে ধৈর্যহারা হয়ে আমি বললাম, “কী হলো? বলছেন না কেন?”
“মা, নাও আরুর সাথে কথা বলো।”
মামিকে উদ্দেশ্য করে ফোনে কথাটা বললেন। অতঃপর ফোনটা এগিয়ে দিলেন। মামি ওপাশ থেকে আমার নাম জপে যাচ্ছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিয়ে বললাম, “মামি।”
“তোকে কতদিন বলেছি, ফোন ধরার পর সাগে সালাম বিনিময় করবি। কথা মনে থাকে না?”
“স্যরি!” ছোটো করে।
“অপূর্ব কাছে পায়েস পাঠিয়েছি তোর জন্য। খেয়ে নিস। এবার নিজ হাতে খাওয়াতে পারিনি, তাতে কী? অপু খাইয়ে দিবে। আর মামির উপর রাগ করিস না।” অপূর্ব ভাইয়ের অন্যপাশে টিফিন ক্যারিয়ার রাখা। খেতে ইচ্ছে করছে ভিশন। তবুও বললাম, “নিজ হাতে যখন খাওয়াতে পারবে না, তাহলে কষ্ট করে রান্না করতে গেলে কেন?”
“ওটা অভ্যাস, ভালোবাসা। তুই বুঝবি না।বড়ো হ, তখন বুঝবি।” কল বিচ্ছিন্ন হলো। অপূর্ব ভাই ফোনটা নিয়ে পকেটে রেখে দিলেন। দিঘির এদিকে কেউ আসবে না। মামাদের বাড়িতে ওয়াশরুম ঘরে নেই বিধায় সবাই দিঘিতে গোসল করতে আসে। এখানে ঘরে ঘরে ওয়াশরুম, তাই নিশ্চিন্ত। অপূর্ব ভাই টিফিন ক্যারিয়ার খুললেন। চামচ দিয়ে মুখে দিলেন পায়েস। আমার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছিল। আলতো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে পা/গ/লীটা আমার। কাঁদছিস কেন? সবকিছু খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]