#মিষ্টিমধুর_প্রতিশোধ
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
পুরো বাড়িতে বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। বিয়ের আলোকসজ্জায় আলোকিত চারিদিক। আর মাত্র কিছু সময় তারপরই বিবাহ নামক সম্পর্কে গেথে যাবে দুটি জীবন।
ইভানা সকলের মধ্যমনি হয়ে বসে আছে। নিজের বিয়ে উপলক্ষে সে খুব সুন্দর কারুকাজ করা একটি লাল লেহেঙ্গা পড়েছে। লেহেঙ্গাটিতে খুব সুন্দর মানিয়ছে তাকে। যে কেউ দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবে।
আশেপাশের কিছু আত্মীয় নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছিল। তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ করে ফিসফিস করে বলে,
‘এই মেয়ে মনে হয় এমন রূপ দেখিয়েই ম্যাজিস্ট্রেটকে পটিয়েছে। নাহলে এমন মেয়েকে তো আর কোন ম্যাজিস্ট্রেট এমনি এমনি বিয়ে করতো না। শোনোনি মেট্রিক ফেল করেছিল এবার পরীক্ষা দিয়ে টেনেটুনে পাশ করেছে।’
মুহুর্তেই স্থানটিতে সবার জটলা লেগে গেল৷ সবাই নানা আলোচনা, সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল৷ বিয়ে বাড়িতে অবশ্য এমন পরিস্থিতি খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। কারণ সব বিয়ে বাড়িতেই পাত্র-পাত্রীকে এমন সমালোচনা কমবেশি হয়েই থাকে। কখনো বা রূপ নিয়ে আবার কখনো বা যোগ্যতা, খাবারের স্বাদ নিয়ে। তবে এক্ষেত্রে ইভানাকে নিয়ে বেশ ভালোই সমালোচনায় জমেছে সবাই।
রিয়া এদিক দিয়ে যাবার সময় কয়েকজনকে এভাবে জটলা পাকিয়ে কথা বলতে দেখে থমকে গেল। তার মনে হলো এখানে কি কথা হচ্ছে সেটা একটু শুনে দেখলে ভালো হয়। যেই ভাবনা সেই কাজ। রিয়া সকলের কথার মাঝে ঢুকে পড়ল। যখন বুঝতে পারল সবাই ইভানাকে নিয়েই কথা বলছে তখন রিয়ার মাথায় খুবই দুষ্টু একটা বুদ্ধি এলো৷ রিয়া হঠাৎ করেই সকলের মাঝে বলে উঠলো,
‘আমারো মনে হয় আপনারা ঠিকই বলছেন। ইভানার মতো একটা মেয়ে, যে কিনা মেট্রিক ফেল করেছে তাকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট কোন দুঃখে বিয়ে করতে যাবে? আমার মনে হয়, এর পেছনে কোন কারসাজি আছে। হয়তো কোথাও কোন আকাম কুকাম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে বা এমন কিছুই। জানেনই তো আজকালকার জমানা কেমন। তাই হয়তো বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছে।’
মুখ থেকে নিঃসৃত কথাকে অনেক সাধারণ মনে করা হয়েও এই কথাই কখনো অনেক বেশি অসাধারণ হয়ে ওঠে। কখনো এই কথাই নষ্ট করে দিতে পারে কারো সাজানো গোছানো জীবন৷
এক কথা, দুই কথা মিলিয়ে পুরো জগাখিচুরি যখন তৈরি হয় তখন তা বেশ জটিল রূপ ধারণ করে। এই যেমন এখন রিয়ার বলা কথাটা নিয়ে সবাই নিজেদের মতো করে আলোচনা করছে। সবাই নিজেদের মতো করে বিষয়টা সাজিয়ে নিচ্ছে। সকলের মাঝে একজন যেমন বলেই দিলো,
‘হুম এমন তো হতেই পারে। হয়তো বিয়ের আগেই কোথাও কোন অকাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তাই এখন বিয়েটা হচ্ছে।’
এরকম ভাবে সবাই নানা কথা সাজাচ্ছে নিজেদের মতো৷ রিয়া এসব কথা শুনে কুটিল হাসল। মনে মনে বললো,
‘যেমনটা আমি চেয়েছিলাম ঠিক তেমনটাই হলো। ছোটবেলা থেকে তোকে সুখে থাকতে দেখেছি ইভানা। আমি তোর থেকে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হয়েও সুখ পাইনি আর তুই,, খুব সখ ছিল না ম্যাজিস্ট্রেটকে বিয়ে করার। দেখ এখন কি হয়।’
১১.
ইভানা নিজের রুমেই বসে ছিল। তাকে ঘিরে রেখেছিল তার সমস্ত কাজিন, বন্ধুরা। তোহা, আনহা এবং রিয়াও ছিল সেখানে। হঠাৎ করে সবার মাঝে রোল ওঠে। ইভানার এক কাজিন এসে বলে,
‘তোমরা সবাই চলো বর এসে গেছে।’
ব্যস কথাটা শোনা বাকি আর সবাই দৌড়ে চলে গেল বরকে দেখতে। সবাই যাওয়ার পর তোহা ও রিয়া ছিল। তোহা ইভানাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘তুই এখানেই চুপটি করে বসে থাক। একদম কোথাও যাবি না কেমন? আমি আসছি।’
‘আচ্ছা আপাই।’
তোহা চলে যাওয়ার পর কিছু সময় রিয়া চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। রিয়ার উপস্থিতি ইভানাকে অস্বস্তির মধ্যে রেখেছিল। কারণ ইভানা খুব ভালো করেই জানে রিয়া কি ধরণের মেয়ে। সে খুবই হিংসুটে আর কুটিল।
রিয়া আচমকা ইভানার সামনে এসে বলে,
‘সবকিছু কত পার্ফেক্ট তাইনা? তুই কত সুন্দর বউ সেজে বসে আছিস। আবার তোর ম্যাজিস্ট্রেট বরও এসে গেছে। এখন শুধু বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হলেই হয়। আচ্ছা বিয়েটা হবে তো?’
‘এটা তুমি কি বলছ রিয়া আপু? বিয়ে হবে না কেন?’
‘না মানে, অনেক সময়ই তো এমন হয় যে বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙে যায়।’
‘এমন কিছুই হবে না। তুমি এরকম অশুভ কথা বলো না। যা হবে ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।’
রিয়া তখন মনে মনে বলে,
‘কিচ্ছু ভালো হবে না ইভানা। সবকিছু খারাপ করার ব্যবস্থা যে আমি অলরেডি করেই রেখেছি। এবার তুই শুধু দেখ কি হয়। আজ সেইরকম একটা সিনক্রিয়েট হবে। তোর অপমান দাড়িয়ে উপভোগ করার জন্য আমি প্রস্তুত।’
১২.
ফারহান ও তার পরিবারের সদস্যরা সবাই এসে গেছে৷ তাদের সবার বসার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ফারহানের পড়নে নীল কালারের শেরওয়ানি। যেটাতে অনেক সুন্দর লাগছে তাকে। ফারহান একটি রুমাল দিয়ে তার মুখ ঢেকে রেখেছে। ফারহানকে ঘিরে রেখেছে তার খুব কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধব এবং ফাহিম।
ফারহান এই বিয়েতে নিজের কিছু নিকটাত্মীয় ও বন্ধু ছাড়া কাউকেও দাওয়াত দেয় নি। কারণ এতে তার মান সম্মানের উপর প্রভাব পড়তে পারে।
তবুও ফারহানের এক বন্ধু রিফাত আচমকা বলে ওঠে,
‘শুনলাম তোর বউয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা নাকি খুব কম। এটা কেমন হলো দোস্ত? তুই একটা ম্যাজিস্ট্রেট মানুষ। আমরা কত আশায় ছিলাম তোর সাথে যার বিয়ে হবে সে উচ্চশিক্ষিত হবে কিন্তু এটা কি হলো? তুই একটু ভালো মেয়ে খুজে পেলি না? মেয়ের বয়সও তো খুব কম মনে হচ্ছে।’
ফারহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম বলে ওঠে,
‘থাক না এসব কথা। বিয়েবাড়িতে এসেছেন যখন দেখুন কোন ভালো মেয়ে নজরে পড়ে নাকি। আশেপাশে তো অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। বন্ধুর বিয়েতে এসে কাউকে পটাতে না পারলে কেমন হয়।’
‘হ্যা, এটা তো একদম ঠিক বলেছ। আমিও এমনটাই ভাবছিলাম।’
ফারহান মনে মনে ফাহিমকে অনেক ধন্যবাদ জানায়। কারণ সে সুকৌশলে ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। ফাহিম এমনি যেমনই হোক, সে নিজের ভাই বা পরিবারের অসম্মান কখনো হতে দিবে না।
সবকিছু তখনো অব্দি ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু রিয়া যেই আগুন লাগিয়েছিল তা খুব শীঘ্রই দাবানলে পরিণত হওয়ার অপেক্ষা করছিল। ছেলেপক্ষ এবং মেয়েপক্ষের অনেক আত্মীয় স্বজন একে অপরের সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠে। এর মাঝেই ইভানার যোগ্যতা নিয়ে প্রসঙ্গ আসতেই সবার মধ্যে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।
যার ফলস্বরূপ সবার মাঝে এই কথা রটিয়ে যায় যে, হয়তো ইভানা ও ফারহান কোন আ’কাম-কু’কাম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তাই এই অবস্থা। কথাটা ঝড়ের বেগে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই নানারকম সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে কাহিনি তৈরি করতে থাকে।
এসবের মধ্যে ইভানাকে বিয়ের আসরে নিয়ে আসা হয়। ইভানা ফারহানের দিকে একপলক তাকিয়েই লজ্জায় নুইয়ে যায়।
ফারহানের বন্ধুদের কানেও ইতিমধ্যে কথাগুলো এসেছে। রিফাত একটু ঠোটকাটা স্বভাবের। তাই সে কোন চিন্তা না করেই ফারহানের কাছে এসে তার কানে কানে বলে,
‘এসব কি শুনছি দোস্ত? তুই নাকি এই মেয়েটার সাথে বিয়ের আগে আ’কাম কু’কাম করতে গিয়ে ধরা পড়ে বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছিস?’
ফারহান রাগান্বিত স্বরে বললো,
‘এসব কে বলেছে তোকে?’
‘বিয়েবাড়ির সবাই তো এটা নিয়েই কথা বলছে।’
ফারহানের রাগ হলো খুব। এই ভয়টাই সে পাচ্ছিল তাই চাচ্ছিল না এভাবে বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে করতে। এখন যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সেটা ফারহানের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। ফারহান আর স্থির থাকতে পারল না।
বিয়ের আসরে এসে সবাইকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো,
‘আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।’
কথাটা চাওড় হতেই রীতিমতো ছোটখাটো ভূমিকম্প হয়ে গেল!
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨