#কুড়িয়ে_পাওয়া_ধন
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী
রাজিয়া খানমের গলা দিয়ে খাবার নামছেনা। বারবার শুধু গতরাতের কথা মাথায় উঁকিঝুঁকি মারছে। আরমান বিসিএস-এ টিকে গেছে! এত চেষ্টা করেও কোন লাভ হলনা!
” কি দাদিমা, চিন্তায় বুঝি খেতে পারছনা? আচ্ছা, রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়েছিল তো? ” শ্রীজা ব্যাঙ্গ করে রাজিয়া খানমকে বলল।
” শ্রীজা, তুমি আজকাল দেখছি লাগামছাড়া কথা বলছ! চরিত্রহীনা, অপয়ার ঐ বেয়াদব ছেলেটার সাথে মিশে নিজেও বেয়াদব হয়েছ?
একেই বলে সঙ্গ দোষে, লোহা ভাসে। ”
” তোমার সব কথাই নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমার কথারও উত্তর দাও। চিন্তায় চিন্তায় রাতটা জেগে কাটিয়েছ, আবার খেতেও পারছনা! অনেক চেষ্টা করেও ভাইয়াকে আটকাতে পারলেনা! প্রথম দুইবার ভাইয়ার পরীক্ষার দিন অসুস্থতার ভান ধরলে। ভাইয়াকে পরীক্ষায় এ্যাটেন্ড করতে দিলেনা। অবশেষে তোমার সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হল। ” শ্রীজার কথা শুনে রাজিয়া খানম ঘামছে।
শহিদ আহমেদ মেয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
” এ..এসব কি বলছ তুমি? আজেবাজে কথা বলতে তোমার একটুও লজ্জা করছেনা? যা ইচ্ছে তাই বলছ। ”
” আম্মা, তুমি একটু চুপ করবে? আমাকে শ্রীজার সাথে কথা বলতে দাও। তোমাদের এমন কথাবার্তায় আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। ” শহিদ আহমেদের ধমকে রাজিয়া খানম চুপ করে।
এরপর শ্রীজা ধীরেসুস্থে বাবাকে সব খুলে বলে। শহিদ আহমেদ ঘৃ”ণা’ভ’রে মায়ের দিকে তাকান।
” তুমি আমার মা বলে আজ বেঁচে গেলে। তবে আগের মত সম্মান আমি তোমাকে করতে পারবনা। তবে চিন্তা করোনা তোমার প্রয়োজনীয় সকল কিছুই তুমি পাবে, এতে কোন কমতি হবেনা। শেষ বয়সে এসে মানুষ চিনছি। ” আফসোস করছেন শহিদ আহমেদ।
ডাইনিং রুমের পরিস্থিতি থমথমে। খাদিজা এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিল।
” খালা, ভাইয়া তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। সে চায় তুমি তার কাছে যেয়ে থাক। ভাইয়ার ট্রেনিং শুরু হলে ভাবি একা হয়ে যাবে। ভাইয়ার সাথে কথা বল, আমি ফোন দিয়েছি। ” শ্রীজা ওর ফোন খাদিজার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
খাদিজা খালা ফোন নিয়ে রান্নাঘরে যায়। বেশ কিছুক্ষণ আরমানের সাথে কথা বলে, শ্রীজাকে ফোন ফেরৎ দেয়।
” খাদিজা, আরমান কি বলল? ও কেমন আছে? ” শহিদ আহমেদ আকুল গলায় জিজ্ঞেস করে।
” বাপজান ভালো আছে। হেয় আমারে তার কাছে নিবার চায়। আমি এহন কি করতাম, ভাইজান? বাপজান, আমারে এমনভাবে কইল, না কওনের ক্ষেমতা আমার নাই। এহন আপ্নে যদি হুকুম দেন, তয় আমি তার কাছে যাইবার পারি। ”
” এখন তো যাবেই। যখন তোমার পায়ের নিচে মাটি ছিলনা, তখন এই মানুষটা তোমাকে ঠাঁই দিয়েছিল। আজ যখন তোমার পায়ের নিচের মাটি মজবুত হয়েছে, তখন তুমি তোমার রূপ দেখালে। এজন্য আমি গরীবদের পছন্দ করিনা। গরীবেরা এমন স্বার্থপরই হয়। ” আকলিমা খানমের গলা দিয়ে যেন আ’গু’ন বের হচ্ছে।
” কথা হচ্ছে আমার আর খাদিজার মধ্যে। এর ভেতর তুমি কেন কথা বলছ? আমি ওকে এই বাসায় এনেছি, এখন ও কোথায় যাবে সেটাও আমিই বুঝব। তোমার এখানে মাতব্বরি না করলেও চলবে। ” শহিদ আহমেদ ধমকে চুপ করান আকলিমাকে।
” খাদিজা, তুমি চাইলে যেতে পার। আমি তোমাকে জোড় করবনা। আমি জানি তুমি ছেলেটাকে খুব ভালোবাসো। সে-ও তোমাকে ভালোবাসে। আমি এটাও জানি, ওর কাছে তোমার কোন অসম্মান হবেনা। আর এই বাসার দরজা তোমার জন্য সব সময়ই খোলা থাকবে। তোমার যখন খুশি, তুমি এখানে আসবে। তোমার কাছে শুধু একটাই চাওয়া, ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখ। ”
খাদিজা তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।
” খালা, তুমি রাজি থাকলে, ভাইয়া তোমাকে আজ-কালের মধ্যেই নিয়ে যেতে বলেছে। তুমি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও। আর আমাকে বিকেলের মধ্যে জানাও। ”
” শ্রীজা, তোমার ভাই কোথায় বাসা নিয়েছে? সেদিন কতবার জিজ্ঞেস করলাম, ওর বাসা কোথায়, কিন্তু একবারও বললনা কোথায় থাকে। ”
” সরি বাবা। ভাইয়া কোথায় থাকে, তা আমি কাউকেই বলতে পারবনা। যদি বলে দেই, তবে ভাইয়া আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে। সে চায়না তার জীবনে আর তোমাদের আবির্ভাব হোক। ”
” ঠিক আছে। ও যা চাইবে, তাই হবে। তুমি শুধু ওর সাথে যোগাযোগ রাখ। আর ওর খবর মাঝেমধ্যে আমাকে জানিও। আমি তার যোগ্য বাবা কখনোই ছিলামনা। তাই তার বাড়ির খবর জানার অধিকারও আমার নেই। খাদিজা যদি রাজি হয়, তবে তাকে কালই সেখানে রেখে এস। ”
এতক্ষণ ওদের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিল রাজিয়া। এসব কথা শুনে রা’গে তার শরীর জ্ব’ল’ছে। কিন্তু ছেলের ধমকের ভয়ে কিছু বলতে পারছেনা। আকলিমার অবস্থাও তাই।
বিকেলে খাদিজা তার সিদ্ধান্ত শ্রীজাকে জানায়। শ্রীজা খালার সিদ্ধান্ত শুনে ভিষণ খুশি হয়। সে সাথে সাথেই আরমানকে ফোন করে।
পরদিন বিকেলে শ্রীজা খাদিজা খালাকে নিয়ে ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ও সকালেই খালাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু খালা সেদিনের রান্না না করে বাসা থেকে বের হতে চায়নি। তাই শ্রীজা ভার্সিটি গেছিল । সেখান থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে খালাকে নিয়ে বেরিয়েছে।
আরমান ওদের কোচিং-এ আসতে বলেছে। সেখান থেকে একসাথে ওরা বাসায় যাবে।
কোচিং-এ এসে আরমান সেখানে জানায়, আজকের পর থেকে ও আর কোচিং-এ আসবেনা।
আরমানকে দেখেই খালা তাকে জড়িয়ে ধরে। কতদিন ছেলেটাকে দেখেনি। আরমানও খালাকে জড়িয়ে নেয়। দুজনের চোখেই পানি।
ওদের কাঁদতে দেখে শ্রীজাও কেঁদে ফেলে।
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেছে। কান্তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। শেষ পরীক্ষার দিনেই আরমান নাটোর যায়। সেদিন সন্ধ্যার গাড়িতে ওরা ঢাকা রওনা দেয়।
আসার আগে আরমান কান্তার ফুপা-ফুপুকে ঢাকায় যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে। আরমান তাদেরকে বেশ পছন্দ করেছে। তারা যথেষ্ট ভালো মানসিকতার মানুষ। আরমান বেশ বুঝতে পারছে, তাদের সাথে আত্মীয়তা জমবে।
কান্তা ফিরে আসার সাতদিন পর আরমান ট্রেনিং-এ যায়।
কান্তা ও খালা ওকে চোখের পানিতে বিদায় জানায়।
আরমান যাওয়ার আগে কান্তাকে অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং-এ ভর্তি করিয়েছে। অনেকগুলো বই কিনে দিয়েছে। বারবার বলে দিয়েছে, পড়াশোনায় যেন কোন কমতি না হয়। খালাকেও বলেছে, কান্তার দিকে নজর রাখতে।
সময় সময়ের গতিতেই বয়ে চলেছে।
আরমান নিয়ম করে কান্তার সাথে যোগাযোগ করে।
কান্তাও মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে।
শ্রীজা সপ্তাহে তিনদিন কান্তার বাসায় আসে। সেই তিনদিন ও ভার্সিটিতে যায়না। সারাদিন কান্তা ও খালার সাথে গল্প করে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে।
শ্রীজার এভাবে বাইরে ঘোরাঘুরি আকলিমা খানম পছন্দ করেনা। এসব নিয়ে সে শ্রীজার সাথে রা’গা’রা’গি করে। শ্রীজা তাকে সত্যি কথা বললে সে রে’গে যায়। সে সাফ জানিয়ে দেয়, ওর আর ঐ বাসায় যাওয়া চলবেনা।
কিন্তু শ্রীজা তার কথা শুনলেতো। মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে সে দিব্যি কান্তার কাছে যাতায়াত করে। ও অবশ্য বাবার কাছে থেকে আগেই হুকুম নিয়ে রেখেছে।
আরমান ট্রেনিং শেষ করে, কর্মস্থলে যোগদান করে বাসায় ফিরেছে। কান্তা ওকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে। বেচারা একদম শুকিয়ে গেছে। ভাইয়ের আসার কথা শুনে শ্রীজা এসে তার সাথে দেখা করেছে।
কয়েকজন মিলে অনেকদিন পর ওরা আড্ডায় মাতে।
” এইযে ঝগরুটে বুড়ি, পড়াশোনার কি খবর? এতদিন কেমন ফাঁকি দিয়েছ? ” রাতে বিছানায় শুয়ে আরমান কান্তাকে জিজ্ঞেস করে।
” আমি বুঝি আপনার সাথে শুধু ঝগড়া করি! আপনি জীবনেও ভালো হবেননা। শুধু আমাকে খোঁ’চা’নো’র তালে থাকেন। শুনুন, আমি আর যাই করি, পড়াশোনায় ফাঁকি দেইনা। এবার এসব আজাইরা প্যাচাল বাদ দিয়ে, আগে বলুন কয়দিনের ছুটিতে এসেছেন? পোস্টিং কোথায় হয়েছে? ”
” পোস্টিং হয়েছে চিটাগং। আপাতত দুই দিনের জন্য এসেছি। সামনের মাসে কয়েকদিন ছুটি পাব। ”
আরমানের কথা শুনে কান্তার মুখ ছোট হয়ে যায়। আরমান সেটা লক্ষ্য করে মৃদু হেসে ওকে কাছে টেনে নেয়।
” শোন মেয়ে, আমি আমার অস্তিত্ব, স্বপ্ন, ভালোবাসা, আত্মার আত্মীয়, সুখের স্মৃতি, প্রেমের পরশ সব এখানেই রেখে গেছি। ছুটি না পেলেও আমাকে সেই আত্মার খোঁজে এখানেই বারবার ছুটে আসতে হবে। এখন মন খারাপ করে সময় নষ্ট করোনা। তোমার অ্যাডমিশন হয়ে যাক। এরপর আমার কাছে নিয়ে যাব। যেখানেই চান্স পাও, থাকবেতো তুমি আমার কাছে। মাসে একদিন ক্লাসে অ্যাটেন্ড করবে। এবার ঘুমাও। আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। এত বকবক করতে পার। ” এক ঝটকায় কান্তাকে ওর বালিশে ঠেলে দেয় আরমান।
ওর এমন কান্ডে কান্তা চোখ বড় বড় করে তাকায়। নিমেষেই কালো মেঘ ছেয়ে যায় ফর্সা মুখে। যা আরমানের নজর এড়ায়না।
” এমন কেন আপনি? কেন এমন করেন! ” অনেক কষ্টে কান্তা কান্না সংবরণ করে।
” আমি যেমনই হইনা কেন, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আগে এইচএসসি-তে ভালো রেজাল্ট করে, পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে দেখাও। তবেই আমার ভালোবাসা পাবে। আমার কথার কোন নড়চড় হবেনা। তাই এভাবে মুখ কালো না করে নিজের ভবিষ্যতের দিকে নজর দাও। ”
” লাগবেনা আপনার ভালোবাসা। আপনার ভালোবাসা আপনিই ভর্তা করে খান। কথা শুনলে মনে হয় খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক। আমার কাছে দার্শনিকগিরি না দেখিয়ে অধিনস্থ কনস্টেবলদেরকে দেখান। আর আপনার ভালোবাসাও তাদের মাঝেই বিলিয়ে দেন। ”
” এবার যদি মুখ বন্ধ না কর, তবে তোমার মুখ সেলাই করে দিব। চুপচাপ ঘুমাও। ”
কান্তা মনে মনে আরমানকে হাজারটা গা’লি দেয়।এই কাটখোট্টা মানুষটার জন্য ও কিনা চাতকীর ন্যায় চেয়ে ছিল!
চলবে…