#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪)
এই পৃথিবীতে যার বৃষ্টি ভালো লাগে না তার মতো অভাগা আর কেউ নেই।
“অভি।”
লাবণ্যের ডাকে ঘোর ভাঙল অভিরাজের। মেয়েটার চোখ দুটি সিক্ত। সাদা রঙের শাড়িতে তাকে বেশ সুন্দর লাগছে। অভিরাজ একই ভঙ্গিতে বসে রইল। লাবণ্য’র বুকটা ক্ষণে ক্ষণে পু ড়ে যাচ্ছে। জ্বালা করছে গলার কাছটা।
“আর কতদিন নিজেকে কষ্ট দিবি তুই?”
“জানি না।”
“তুই তো বলতি কারো জন্য কখনো জীবন থেমে থাকে না। তবে তুই কেন থেমে গেলি অভি?”
এই প্রশ্নের উত্তর নেই অভিরাজের। তার দৃষ্টিতে শূন্যতা। বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করছে। লাবণ্য ডুকরে কেঁদে উঠল। তবু নড়ল না অভিরাজ। এসবে অভ্যস্ত সে। ভীষণ ভাবে অভ্যস্ত।
অতীত…..
“সরি,উষশী। আমি একটু বদমেজাজি, হয়ত হুট করেই রেগে যাই। প্লিজ মাফ করে দাও।”
“মাফ করব না।”
গোমড়া হয়ে এল অভিরাজের মুখটা। সে কখনো কারো কাছে মাফ চায়নি। অথচ এই বাচ্চা মেয়েটি তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অভির রাগ হলো। পরমুহূর্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”তাহলে কি করব বল?”
“কিছু না। চলে যান।”
“উষশী।”
“কথা বলব না।”
“হায়রে বাচ্চা।”
“আমি বাচ্চা নই।”
“তাহলে বুড়ি?”
“সেটাও নই।”
“তাহলে?”
“জানি না। আপনি আমাকে বিব্রত করছেন।”
খিটমিটে হাসল অভিরাজ। উষশী পুরো নজর দিল এবার। কোকোকে কোল থেকে নামিয়ে বলল,”ক্ষিধে পেয়েছে।”
“আসো।”
সকালে তেমন খেতে পারে নি উষশী। তার পূর্বেই অভিরাজ তাকে বেশ বকাঝকা করেছিল। তাই এখন ক্ষিধেটা একটু বেশি। রকমারি খাবার দেখে উষশীর ইচ্ছে হলো লাফিয়ে যেতে। স্বভাবতই সে তেমনটা করতে পারল না। ধীরে ধীরে বসল টেবিলে। লাবণ্য চোখের ইশারায় কিছু একটা বলছে। অভিরাজ বোঝাল অভিমান কমেছে। লাবণ্য হেসে ফেলল।
“বাবু, মাছ দেই?”
“মাছ খেতে পারি না।”
“সেকি,কেন?”
“কাঁটা বাছতে পারি না।”
লাবণ্য এতে অবাক হলো না। বরং অভি’র দিকে তাকাল। অভিরাজ হতাশ হয়ে বলল,
“বোস,দুজনকেই বেছে দিচ্ছি।”
লাবণ্য খুশি হয়ে বসল। ছোট থেকেই অভি তাকে মাছের কাঁটা বেছে দেয়। আর লাবণ্য আয়েশ করে খায়। একটা পুরো মাছ বেছে নিয়ে উষশী’র প্লেটে দিল অভিরাজ। উষশী একবার তাকিয়ে বলল,”কাঁটা নেই তো?”
“না।”
উষশী বিশ্বাস করল। মাছ নিয়ে খেতে খেতে বলল,”এটা কি মাছ?”
“রূপচাঁদা। এটায় এমনিতেই কাঁটার পরিমাণ কম।”
“খুবই মজা। আমি আরেকটা খাব।”
লাবণ্য নিজের জন্য বাছা মাছটা দিয়ে দিল। অভিরাজ পুনরায় মাছ বাছতে লাগল। অল্প সময়েই খাবার খেয়ে নিয়েছে উষশী। ছোট্ট পাতলা গড়নের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল অভিরাজ। মনে হলো এই মেয়ে পুতুলকেও হার মানাবে।
বিকেলটা মজা করে পার করেছে উষশী। কোকো আর সে বড়ো ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে একটুও খেয়াল নেই। লাবণ্য পুনরায় হসপিটালে যায় নি আর। অভিরাজ সবকিছুর দেখা শোনা করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল। এসে দেখল সোফায় ঘুমিয়ে আছে বাচ্চাটি। তার হাঁটুসম ফ্রকটা আরেকটু উঁচু হয়ে গেছে। সুন্দর ফর্সা কোমল পা যুগল যে কোনো পুরুষের হৃদয় খান খান করতে পারলেও অভিরাজের ক্ষেত্রে তেমনটা হলো না। তার কাছে মনে হলো মেয়েটি যেন এক ফালি সাদা মেঘ। যাকে ছুঁয়ে দিলেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে। এসির পাওয়ার কমানো থাকলেও শীতে জুবুথুবু হয়ে আছে উষশী। অভি চাদর এনে শরীরে দিয়ে দিল। চাদরের উষ্ণতায় ঘুমের মধ্যেই ভালো লাগা ফুটে উঠল চোখে মুখে। সোনালি চুল গুলো কপালের কাছে এসে আন্দোলন শুরু করেছে। অভি খুব সাবধানে বুড়ো আঙুলের সাহায্যে তা সরিয়ে দিল। মেয়েটার মায়াবী মুখ বার বার আকর্ষণ করলেও নিজেকে থামাতে সক্ষম হলো সে। কিচেন থেকে কফি বানিয়ে লাবণ্য’র রুমে এসে নক করল। লাবণ্য ঘুমে তলিয়ে আছে। অভি কল করতেই উঠে এল। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলল, “সন্ধ্যা হতেই যে চলে এলি।”
“কাজ শেষ। বাকিটা ম্যানেজার সামলে নিবে। তুই কফি খাবি তো?”
“হুম। শরীরটা মেজমেজ করছে।”
“দেখলাম ড্রয়িং এ উষশী ঘুমিয়ে আছে। ওকে ডেকে তোল।”
“হুম।”
হাত মুখ ধুয়ে এসে উষশীকে ডেকে নিল লাবণ্য। মেয়েটা বেশ চঞ্চল। কোকো মিউ মিউ করে ছুটছে। উষশীও পিছু নিল।
“পড়ে যাবে। এভাবে ছুটো না।”
“কোকো বড়ো দুষ্টুমি করছে।”
“তুমি থেমে যাও তাহলে কোকোও আর ছুটবে না।”
লাবণ্য’র কথা মতো থেমে গেল উষশী। কফি নিয়ে বলল,”ঐ লোকটা কোথায়?”
“ঐ লোক বলতে?”
“মিস্টার রাগী।”
“অভি’র কথা বলছ?”
দু দিকে মাথা কাত করে হ্যাঁ বোঝাল উষশী। লাবণ্য না হেসে পারল না। তার উচ্চ শব্দের হাসিতে অভিরাজ প্রশ্ন করল,”পাগল হয়ে গেলি?”
“আরে শোন না, উষশী কি বলল।”
উষশীর কথা উঠাতে সরু দৃষ্টি ফেলল অভিরাজ। কোকোর সাথে খেলছে সে। লাবণ্য কাছে এসে বলল,”তোকে মিস্টার রাগী বলেছে।”
“হোয়াট!”
“হুম। ভালোই হয়েছে নামটা।”
“লাবণ্য!”
“আচ্ছা,রাগ করিস না। এখন বল উষশীর বাড়ির লোকের কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
“ওর নামে কোনো মিসিং রিপোর্ট আসে নি।”
“এখন কি করবি ভাবছিস?”
“বুঝতে পারছি না। ও যে পরিমাণে অভিমানী, একটু কিছু বললেই না বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।”
“সেটাই ভয়। তবে দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। আমাদের কাছে তো সময় নেই।”
“হুম। দেখি,কি করা যায়।”
বলের আ ঘা তে ঘুরে তাকাল অভিরাজ। একদম বাহুতে এসে লেগেছে তার। উষশী এবার ভয় পেয়ে গেল। সে ইচ্ছে করে এমনটা করেনি। বাচ্চাটি ভেবেছিল অভিরাজ তাকে ধমকে দিবে কিন্তু তেমন হলো না বরং বলটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,”ভলিবল খেলতে পারো?”
“পারি।”
“খেলবে?”
“এখানে?”
“না ছাদে কোর্ট করা আছে।”
এ বাড়ির ছাদে আসা হয়নি উষশীর। বাড়িটা মোটামুটি বড়ো বুঝেছিল তবে এত সুন্দর ছাদ জানা ছিল না। চারপাশ জুড়ে ফুলের গাছ লাগানো। একপাশে ছোট একটা সুইমিং পুল ও রয়েছে। আর অপর পাশে ভলিবল কোর্ট। কোকো লাফিয়ে উঠল। সে এই পরিবেশ পেয়ে বেশ আনন্দিত।
“পানিতে নামবে না কোকো।”
উষশীকে অগ্রাহ্য করে জলে নেমে গেল বিড়ালটি। যদিও বিড়ালটিকে সবে সাঁতার শেখানো হয়েছে তবু ভয় হতে লাগল মেয়েটির। সে পুলের কাছে এসে ডাকতে লাগল, “কোকো উঠে এসো সোনা। আমার ভয় হচ্ছে। প্লিজ উঠে এসো।”
কোকো আরো কিছুসময় থেকে উঠে এল। উষশী’র কোলে এসে পুরো শরীর ঝাড়া দিতেই পানি এসে লাগল কিশোরীর চোখে মুখে। ছোট করে তাকাল উষশী।
“কোকো। তুমি আমায় এত চিন্তায় ফেলে দাও যে…”
“উষশী।”
কোকো কে কোলে নিয়ে ছুটে এল উষশী। অভিরাজ ইতোমধ্যেই বল নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। কিন্তু লম্বাটে দেহের অভিরাজের থেকে বল নিতে পারছে না ছোট্ট দেহের উষশী। সে তবুও আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আবার আকাশ ডেকে উঠল। বৃষ্টি শুরু হবে।
“ফিরে চলো উষশী।”
“না,না আমি খেলব।”
“বৃষ্টি নেমে যাচ্ছে।”
“নামুক।”
“জেদ করছ কেন?”
“আমি একবার ও বল নিতে পারি নি।”
কথার মাঝেই বৃষ্টি নেমে এল। কোকো দারুণ আনন্দে লাফাচ্ছে। বরাবরই বৃষ্টি ভালোবাসে সে। মৃদু হাওয়ার কোলে নিজেকে মেলে ধরেছে ছাদে থাকা গাছগুলো। উষশীর কাঁধ অবধি বাদামি চুল গুলো বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার। কিছু চুল দলা পাকিয়ে লেপ্টে আছে কাঁধে। শ্বেত রঙা মুখটায় বিন্দু বিন্দু জল লেগে আছে। ভোরের প্রথম আলোতে কলি থেকে জাগা শিশির ভেজা সদ্য ফুলটিকে যেমন লাগে এখন উষশীকেও তেমনি লাগছে। অভিরাজ এতটাই অন্যমনস্ক ছিল যে বল ছিনিয়ে নিতে ভুল হলো না মেয়েটির। পরের সময় টুকু উষশী একচ্ছত্র অধিকার দেখাল ভলিবল কোর্টে। আর অভিরাজ অনিমেষ তাকিয়ে রইল মুগ্ধতা নিয়ে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি