#আমি পদ্মজা পর্ব ৬৪
# ইলমা বেহরোজ
___________
সময় নিজের গতিতে ছুটতে,ছুটতে মাঝরাত অবধি চলে এসেছে। সেই তখন থেকে আমির পাথরের মতো বসে আছে। কথাও বলছে না,যাচ্ছেও না। পদ্মজা হাজারটা প্রশ্ন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
তার গলা শুকিয়ে গেছে। আমির মাঝে শুধু একটা অনুরোধ রেখেছে পদ্মজার। পদ্মজা বলেছিল, সে যে আমিরের কাছে আছে সেটা যেন ফরিনাকে জানানো হয়। তিনি খুব অসুস্থ। চিন্তা করবেন। আমির পদ্মজার এই অনুরোধ রাখে। তবে ফরিনা এতো অসুস্থ শুনেও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। ঘন্টা দুয়েক পূর্বে আচমকা মেয়েগুলোর কান্না,আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েগুলোকে কেন এভাবে মারা হচ্ছে তাও আন্দাজ করতে পারছে না পদ্মজা। একবার মনে উঁকি দিয়েছিল, নারী পাচারের কথা। কিন্তু সেই সন্দেহ ধরে রাখতে পারলো না। কারণ, পাচার করার উদ্দেশ্যে থাকলে এভাবে মারতো না। পাশবিক নির্যাতন করতো না। এছাড়া সে এটাও আন্দাজ করতে পারছে না এতো রহস্যের উদ্দেশ্য কী? শুধু এতটুকু বুঝতে পারছে, তার দেখা সব খারাপের গুরু তার স্বামী! পদ্মজা তার ক্লান্ত ঘোলা চোখ দুটি আমিরের দিকে তাক করে দূর্বল কণ্ঠে বললো,’এভাবেই বেঁধে রাখবেন? মেরে ফেলার পরিকল্পনা থাকলে মেরে ফেলুন না।’
পদ্মজা ভেবেছিল আমির বোধহয় উত্তর দিবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে আমির বললো,’তোমার কেন মনে হচ্ছে তোমাকে মেরে ফেলা হবে?’
‘কেন? কখনো কাউকে খুন করেননি? অভিজ্ঞতা নেই?’ তাচ্ছিল্যের সাথে বললো পদ্মজা।
আমির শান্ত স্বরে বললো,’অন্যরা আর তোমার মধ্যে পার্থক্য আছে।’
পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,’মানে,অন্যদের খুন করেছেন?’
আমির জবাব দিল না। পদ্মজা উত্তেজিত হয়ে পড়লো,’কাকে করেছেন? কয়জনকে করেছেন? আবদুল ভাইকে কি আপনি মেরেছিলেন?’
আমির চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললো,’না।’
‘তাহলে কাকে?’
‘এতো কথা কেন বলছো?’
‘মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। কী লাভ ওদের মেরে,আটকে রেখে?’
আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে চলে গেল। পদ্মজার বুকের ভেতর হাহাকার লেগে যায়। বুকের আগুনটাকে চেপে ধরে ভাবে, তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। মেয়েগুলোকে নিয়ে কী হচ্ছে,কেন হচ্ছে,কী কাজ চলে এখানে সেটা জানতে হবে। তারপর তার স্বামীর সাথে বোঝাপড়া হবে। কথাগুলো ভেবে পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তখন একটা হুল্লোড় কানে আসে। অনেকগুলো মেয়ের আকুতি! আবার মারছে! না মারছে না। মেয়েগুলোর কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তারা বাম দিকে আছে। আর দশ-বারো জন একসাথে আছে! তবে কি এরা অন্য দল? এখানে আরো মেয়ে আছে? পদ্মজা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। আমিরের কণ্ঠ ভেসে আসছে। সে মেয়েগুলোকে খাওয়ার জন্য বলছে। তারপর একজনকে আদেশস্বরে বললো,’রাফেদ,দেখো এরা যেন ঠিক করে খায়। আর সবার বাঁধন একসাথে খুলে দিবে না। একজন একজন করে খুলবে। আর চেঁচামিচি যেন না করে। খাওয়া শেষ হতেই হাত,মুখ বেঁধে ফেলবে। আমি আরভিদকে পাঠাচ্ছি। আরভিদ কোথায়?’
উত্তরে আরেকটি পুরুষ কণ্ঠ কি বললো,পদ্মজা বুঝতে পারলো না। সেই পুরুষ কণ্ঠটি ছাপিয়ে একটি মেয়ের কণ্ঠ ভেসে আসে,’ভাই আমারে ছাইড়া দেন। আমার কয়দিন পর বিয়া। অনেক কষ্টে আমার বাপে আমার বিয়া ঠিক করছে।’
তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ আসেনি! ঘৃণায় পদ্মজার চোখ বুজে আসে। চোখ ছাপিয়ে জল নামে। তার কিছুক্ষণ পর আমির আসলো। পদ্মজা কান্না থামিয়ে চোখমুখ শক্ত করে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। আমির বললো,’খাবার আসছে। খেয়ে নাও।’
‘খাবো না।’পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ।
‘বিষ দিইনি। লতিফার রান্না। খেতে পারবে।’
পদ্মজা চমকে তাকাল। আবার চোখ সরিয়ে নিল। লতিফা যে এই বাড়ির রহস্যের সাথে যুক্ত সেটা পদ্মজা আন্দাজ করতে পেরেছিল। এবার বুঝেছে লতিফার কাজ কি! আমির বললো,’কি হলো?’
পদ্মজা বললো,’আমার একটা উত্তর দিন।’
‘তোমার তো প্রশ্নের অভাব নেই। ‘
‘এখানে আরো মেয়ে আছে? আপনার কি নারী ব্যবসা আছে?’
শেষ প্রশ্নটা করার সময় পদ্মজার কণ্ঠ কাঁপে। আমির শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,’খাবে নাকি সেটা বলো?’
‘আপনি আমাকে হারাম টাকায় রানি করেছিলেন?’
‘টাকা টাকাই হয়। হারাম,হালাল নেই।’
‘মুসলিম তো আপনি,নাকি?’
‘আমাদের কোনো ধর্ম নেই।’
‘কিসব বলছেন আপনি হ্যাঁ? মাথা ঠিক আছে?’ উত্তেজিত হয়ে পড়লো পদ্মজা।
‘এরকম ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদার স্বভাব তো তোমার ছিল না।’
‘মন আছে আপনার? পৃথিবীর বুকে এমন কোন নারী আছে যে ছয় বছর সংসার করার পর তার স্বামী নারী ব্যবসায়ী,খুনি,অত্যাচারী,নিকৃষ্ট জেনেও কষ্ট পাবে না,কাঁদবে না?’
‘এজন্যই তো জানাতে চাইনি। জানতে গেলে কেন?’
‘আপনি আপনার নষ্ট জীবনের সাথে আমাকে জড়ালেন কেন?’
‘নষ্ট জীবন চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম। তোমাকে তো ভালোটাই দেখিয়েছি। তুমি চাদর তুলতে গেলে কেন?’
‘এখন সব দোষ আমার তাই না? আপনি খোলস কেন পরলেন? শয়তান শয়তানের মতোই থাকতেন।’
‘নিজের জীবনকেও নরক বানালে,সাথে আমারও।’
‘মেয়েগুলোকে মেরে কী শান্তি পান? কেন মারেন? এসব করে কী লাভ? ছেড়ে দিন সবকিছু। আমরা একটা ছোট ঘরে সুখে থাকবো। আমাদের ভালোবাসাগুলো তো মিথ্যে না। আমরা তো আমাদের ভালোবাসা নিয়ে ভালো ছিলাম।’
‘মন থেকে এটা মানছো?’
‘কোনটা?’
‘আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে ছিল না।’
পদ্মজা কি বলবে ভেবে পায় না! যে মানুষটার মনে অন্যদের জন্য মায়াদয়া নেই। পশুর মতো যার আচরণ সে কী করে কাউকে ভালোবাসতে পারে? এই সমীকরণটা কিছুতেই মানাতে পারছে না সে।
পদ্মজা ভেজাকণ্ঠে বললো,’আপনাকে ক্ষমা করা ঠিক না। আপনাকে কোনো ভালো মানুষ ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি। আপনি সবকিছু ছেড়ে দিন। মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। তওবা করুন। আমরা দূরে চলে যাব। সুখে-শান্তিতে থাকবো।’
অনেক আশা নিয়ে উন্মাদের মতো কথাগুলো বললো পদ্মজা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া পদ্মজার মুখে এহেন কথা আশা করেনি আমির। তবুও সে পদ্মজার মনের মতো উত্তর দিতে পারলো না। সে পদ্মজার আশায় বালি ঢেলে দিয়ে বললো,’তুমি সব ভুলে যাও।’
পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই মানুষটার সর্বস্ব জুড়ে সে নেই। যদি থাকতো,সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে তাকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো। পদ্মজার বুকের ক্লান্ত সূক্ষ্ম ব্যথাটা আবার বড় আকার ধারণ করে। আমির পদ্মজার বাঁধন খুলে দিলো। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,’খুলে দিলেন যে?’
‘খাবে,চলো।’.
‘যদি এখন পালিয়ে যাই?’
‘কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?’
‘জানেনই যখন আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই। আপনিই আমার শেষ আশ্রয়। তাহলে ফিরে আসুন না আমার কাছে!’
‘আবার কাঁদছো।’
পদ্মজা লম্বায় আমিরের কাঁধ অবধি। সে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে আমিরের দিকে। রক্ত জবা ঠোঁট দুটি চোখের জলে ভিজে ছপছপ করছে। আমিরের চোখের দৃষ্টিতে যেন প্রাণ নেই,নিষ্প্রাণ। শীতল। পদ্মজা আচমকা আমিরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমির দুই পা পিছিয়ে যায়। পদ্মজা জোরে,জোরে কাঁদতে, কাঁদতে বললো,’আপনি এভাবে অচেনা হয়ে যাবেন না। আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো। আমার ভালোবাসাকে এভাবে পর করে দিবেন না। আপনার মনে আছে, একবার আমি রাগ করে দুই দিন কথা বলিনি। তখন আপনি বলেছিলেন, আমাকে এভাবে অচেনা হতে দেখে আপনার কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের অচেনা রূপের মতো ভয়ানক কষ্ট দুটো নেই। এখন আমার সেই ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছেন? আমি সব ভুলে যাবো। আপনি ভালো হয়ে যান। মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন। ধ্বংস করে দিন আপনার সব পাপের চিহ্ন।’
আমির এক হাত রাখে পদ্মজার মাথার উপর। পদ্মজা অশ্রুভরা চোখে তাকায়। আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো,’গালে ব্যথা পেয়েছো কী করে?’
‘এতক্ষণে দেখেছেন?’
‘না।’
‘সেদিন জঙ্গলে এসেছিলাম। কাঁটা লেগেছিল। তারপর…’
‘রিদওয়ান মেরেছিল?’
‘হু।’
‘কেন আসতে গেলে? সাধারণ দুনিয়ার বাইরেও মানুষের বানানো আরেক জগত থাকে। সেই জগতে পবিত্র মানুষদের ঢুকতে নেই।’
‘ভেঙে ফেলুন সব।’
‘নিজের হাতে যত্ন করে করা সাম্রাজ্য ভাঙা যায় না।’
‘পাপের সাম্রাজ্য ধরে রেখে কেন পাপ বাড়াবেন? আমাদের ভালোবাসাকে কেন বলি দিবেন?’
‘আমার রক্ত ভালো না। কেউ আমাকে পশু বললে,আমার আনন্দ হয়।’
‘তাহলে আপনি ছাড়বেন না কিছু?’
‘না।’
পদ্মজা নিরাশ হয়ে বসে পড়ে চেয়ারে। আমির বললো,’খাবে নাকি খাবে না?’
‘আমি এখানে খেতে আসিনি!’
‘তাহলে না খেয়েই থাকো।’
পদ্মজা চুপ থাকে। নিজের মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা করে। খেয়েদেয়ে সুস্থ থাকতে হবে। মেয়েগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। এখন নিজেকে এভাবে ভেঙে যেতে দেওয়া যাবে না। সে লম্বা করে বার কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল। তারপর বললো,’খাবো।’
আমির বের হয়ে যায় সেদিন রাতে আর ফিরে আসেনি। মেয়েদের মতো সিল্কি লম্বা চুলের লোকটি খাবার নিয়ে আসে। তার নাম রাফেদ। পদ্মজা যতক্ষণ খায়,দাঁড়িয়ে থাকে। পদ্মজার খাওয়া শেষ হতেই রাফেদ পদ্মজাকে বাঁধতে চাইলো,তখন পদ্মজা প্রশ্ন করলো,’উনি কোথায়? আপনি কেন বাঁধছেন?’
‘বাইরে গিয়েছেন। আমাকে বলেছেন,আপনার খাওয়া শেষ হলে বেঁধে রাখতে। ‘
‘কী করতে গিয়েছে?’
‘এতসব বলতে পারব না। স্যার অনেক রাগী। স্যারকে রাগাবেন না। যা বলবে মেনে নিবেন।’
‘আপনার স্যার তো আমাকে ভয় পায়। আমার কথায় সারাক্ষণ এই ঘরে ছিল। ভয়ে কেঁপেছেনও। বিশ্বাস করুন।’
রাফেদ হাসলো। এই হাসিকেই বোধহয় বলে শয়তানের মতো হাসা।
‘মজা করছেন?’
‘আচ্ছা, ওই সাদা খরগোশটা কোথায়?’
‘খরগোশ?’
‘ওইযে,সাদা দেখতে। আরদিদ বা এরকম কোনো নাম।’
‘তা জেনে আপনি কী করবেন? ‘ রাফেদ এগিয়ে আসে বাঁধার জন্য। পদ্মজা আড়চোখে কিছু একটা খুঁজে। কিন্তু রাফেদকে আক্রমণ করার মতো কিছু পেল না। ঘরে কিছু বলতে দুটো চেয়ারই আছে। চেয়ার গুলো কি খুব ভারী? একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত। পদ্মজা দুই পা পিছিয়ে যেয়ে বললো,’আপনাদের বাড়িটা অনেক সুন্দর। পাতালে বাড়ি আমি কখনো দেখিনি। একটু ঘুরে দেখি? আমার উনি বানিয়েছেন তাই না?’
‘এটা স্যারের বানানো না।’
‘তাহলে কার?’
রাফেদ পদ্মজার ন্যাকামি বুঝে যায়। সে তেড়ে আসে। পর পুরুষের সাথে ধস্তাধস্তিতে পদ্মজার মন সায় দিচ্ছে না। এখান থেকে পালালেও বাইরে আরেক শয়তান আছে। পালিয়েও লাভ নেই। তার চেয়ে এখানে থেকেই পরিস্থিতি বোঝা উচিত। পদ্মজা দ্রুত চেয়ারে বসে পড়ে বললো,’ধস্তাধস্তি করবেন না। আমি বসে পড়েছি। আপনি বাঁধুন।’
রাফেদ পদ্মজাকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে চলে যায়। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। ঘরের ছাদ অনেক উঁচুতে! মনে মনে আন্দাজ করার চেষ্টা করে মাটির কতোটা নিচে আছে সে। বেশ অনেকক্ষণ পার হওয়ার পর পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। পদ্মজা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমির প্রবেশ করে। তার হাতে মলম জাতীয় কিছু। পদ্মজা কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকে। আমির পদ্মজার দিকে মলম এগিয়ে দিয়ে বললো,’ঔষধপত্র নিয়ে আসা উচিত ছিল।’
‘আমি কি জানতাম নাকি, এখানে আমার বর শয়তানের রাজত্ব নিয়ে বসে আছে?’
‘খুব কথা বলছো।’
‘মেয়েগুলোকে ছেড়ে দিন।’
‘এক কথা বার বার বলো না।’
‘আমাকে ভালোবাসেন না?”
পদ্মজা তার মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে আবিষ্কার করে আমিরের চোখে প্রাণ এসেছে! সঙ্গে,সঙ্গে পদ্মজার মনের জানালার পাল্লা খুলে গিয়ে মুঠো,মুঠো বাতাস প্রবেশ করে। অশান্তিতে অবশ হয়ে যাওয়া মন,মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমির পদ্মজার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললো না। হাতের বস্তুটি পদ্মজার পায়ের কাছে রাখলো। তারপর পদ্মজার বাঁধন খুলে দিয়ে বললো,’গালে,পায়ে লাগিয়ে নিও। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করো না।’
বলেই সে বেরিয়ে যায়। দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে দেয়। পদ্মজার চাঙ্গা হয়ে যাওয়া মনে আবার মেঘ জমে। সে মেঝেতে ‘দ’ ভঙ্গিতে বসে পড়ে।
__________________
বর্তমান।
পদ্মজার কান্না যেন থেমে থেমে চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তুষার কথা বলতে গেল, কিন্তু ফুটল না। পদ্মজার বিষাদভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্মজা দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলো। মেয়েটার কান্না রোগ বোধহয় সেদিন থেকেই হয়! যেদিন জানলো তার স্বামীর আসল পরিচয়। তুষার থামতে বললো না। পদ্মজাকে কাঁদতে দিল। অনেকক্ষণ কাঁদার পর পদ্মজা পানি খেতে চাইলো। তাকে পানি দেওয়া হলো। তারপর চুপ হয়ে যায়। নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। যতক্ষণ না তুষার আর প্রশ্ন করবে পদ্মজা কিছু বলবে না। তাই তুষার নিরবতা ভেঙে বললো,’তার অন্যায় জেনেও তাকে মাফ করতে চেয়েছিলেন। রাতের এইটুকু শুনে তো মনে হচ্ছে না, আপনি আমির হাওলাদারকে কখনো খুন করতে পারেন। পাগলের মতো ভালোবেসেও তার বুকে ছুরি চালানোর সাহস হলো কী করে?’
পদ্মজা তুষারের উৎসুক মুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। ফিসফিসিয়ে বললো,’মুক্তি দিয়েছি,মুক্তি!’
‘আপনার বর্ণনা অনুযায়ী আপনার প্রতি আমির হাওলাদারের ব্যবহার নরম ছিল। তিনি আপনার প্রতি দূর্বল ছিলেন।’
পদ্মজা উদাসীন হয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বললো,’দূর্বল ছিল নাকি!’
‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে।’
‘আমি উনাকে খুব ভালোবাসি স্যার।’ পদ্মজার কণ্ঠটা কেমন শোনায়! সে তার স্বামীকে খুন করে এসে জেলে বসে তার জন্যই কাঁদছে। কি অবাক কাণ্ড! তুষার বললো,’আপনার ভাষ্যমতে তিনি একজন শয়তান ছিলেন। শয়তানকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজেকে পাপী মনে হয়নি?’
‘হয়েছে।’
‘তাহলে সেটা কী করে ভালোবাসা হলো?’
পদ্মজা কাঁদতে থাকলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,’যখন কাউকে ভালোবাসবেন তখন বুঝবেন। ভালবাসায় দোষ-গুণের স্থান নেই। ভালবাসা শুধুই ভালবাসা। ভালোবাসা গুণী-খুনী,পাপ-পুণ্যের ভেদাভেদ করে না।’
তুষারের মনে হচ্ছে তার বুকে যেন একটা বড়সড় পাথর। আমিরের প্রতি পদ্মজার ভালোবাসার তীব্রতা তাকে কাতর করে তুলেছে। বার বার মনে হচ্ছে, সেই মানুষটাও বোধহয় পদ্মজাকে ভালোবাসতো। কিন্তু পাপ তাকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সে কি কখনো পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিল? প্রশ্নটা তুষারের মনে আসতেই তার উত্তেজনা বেড়ে যায়। পদ্মজাকে প্রশ্ন করে,’তিনি কি পাপ থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেছিলেন? তারপর আর ভালোবেসেছিলেন আপনাকে?’
তুষারের প্রশ্নে পদ্মজা থম মেরে গেল। শূন্যে দৃষ্টি রেখে আওড়াল,’চেষ্টা কি করেছিলেন? করেছিলেন কি?’
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ