#রহস্যময়_ঘোর (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
‘অস্তিত্বহীন মেয়ে’ শব্দটা মাথায় আসলে তুষার আচমকাই ফারিহার দিকে চেয়ে বলে উঠে,
“আচ্ছা আপনার হাতটা একটু ছুয়ে দেখতে পারি?”
বিপরীতে চোখ-মুখ কুঁচকালো ফারিহা। দেখে মনে হচ্ছে এমন কিছু শুনে ক্ষনিকটা অবাক হয়েছে সে। কিছু না বললে তুষার পূনরায় বলে উঠে,
“খারাপ কিছু ভাববেন না। যাস্ট একবার। কারণটা পরে বলছি আপনাকে।”
ফারিহার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো সে হয়তো কিছু বুঝতে পারেনি। তবুও তুষারের দিকে ডান হাতটা এগিয়ে দিলো। ক্ষনিকটা ঘাবড়ে গেলো তুষার। যদি নিবিড়ের কথা অনুযায়ী মেয়েটা সত্যিই অস্তিত্বহীন হয়, তাহলে এখন তার হাতটা ধরতেই কি সে গায়েব হয়ে যাবে? নাকি ছোঁয়া লাগলেই বৈদ্যুতিক শর্ক দিবে তাকে।
মনে একরাশ কৌতুহল নিয়ে কাঁপা হাতে ফারিহার হাতটা ছুঁয়ে দিল সে। না, এমন কিছুই হলো না। একদম স্বাভাবিক মানুষের মতোই সে। তাহলে স্বপ্ন এত গোছানো বাস্তবের মতো হয় কিভাবে?
আর কিছু ভাবতেই তার মুখের সামনে ফারিহা হাতের তুড়ি বাজিয়ে বলে,
“এই যে ভাইয়া। কোথায় হারিয়ে গেলেন?”
আচমকাই তুষারের ধ্যান ভাঙলে সে বলে,
“আপনি তাহলে সত্যি সত্যিই মানুষ?”
ফারিহা অবাকের সাথে মুখে কিছুটা হাস্যজ্বল ভাব রেখে বলে,
“কেন, আমাকে ভু’ত মনে হয়েছিল নাকি?”
বলেই হেসে দিল সে। মনে হচ্ছে তুষারের কথায় সে মজা পেয়েছে খুব। তুষার এখনো নিচেই বসে আছে। ফারিহা তাকে ধরে উঠিয়ে পাশের একটা ব্যাঞ্চ-এ বসালো। পাশে সে নিজেও বসে ক্ষনিকটা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“আপনার মনে কি চলছে বলুন তো। একে তো টিকিট ছাড়া ট্রেনে উঠেছিলেন। তারপর ট্রেন থেকে নেমেই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন। এখন আবার জেগে অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ করছেন।”
তুষার ক্ষনিকটা চুপ থেকে বলে,
“বললে আমাকে পাগল ভাববেন না তো?”
“না ভাববো না। বলুন আপনি।”
তুষার চার পাশে একবার চোখ বুলিয়ে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
“আমি এখন আমার স্বপ্নে অবস্থান করছি। মানে চার পাশে যা চলছে কোনো কিছুই বাস্তবে হচ্ছে না।”
এবার স্বাভাবিক ভাবেই হেসে উঠলো ফারিহা। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলো সে হাসি। হাসি থামিয়ে বলে,
“কিহ্! আপনি এখন স্বপ্নে অবস্থান করছেন?”
“হুম। একটু আগে যখন সেন্সলেস হয়েছিলাম, তখন আমি কিছু সময়ের জন্য বাস্তবে ফিরে গিয়েছিলাম।”
আবারও হাসলো ফারিহা। মনে হচ্ছে বসে বসে কোনো জোক্স শুনছে সে। অতঃপর সেই জোক্স এর সাথে তাল মিলিয়ে সেও বলে,
“তাহলে এক কাজ করি। আমি আপনাকে একটা চর দিই? তাহলে আপনার স্বপ্ন ভেঙে আপনি আবার বাস্তবে ফিরে যেতে পারবেন। যদি আবারও ঘুমানোর পর স্বপ্নে এসে আমার সাথে দেখা হয় তাহলে আমাকে জানাবেন কিন্তু বাস্তবে তখন আমি কি করছিলাম।”
বলেই আবারও হাসতে লাগলো ফারিহা। তুষার কিছুটা হতাশ হয়ে তার দিকে তাকালো। কারণ সে বুঝতে পারছে ফারিহা তার কথা বিশ্বাস করেনি। কিছুটা হতাশার দৃষ্টিতে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
“বিষয়টা নিয়ে মজা করছেন আমার সাথে? তবে আপনার বিশ্বাস না হলেও এটাই সত্য।”
ফারিহার মাঝে এখনো হাস্যজ্জল ভাবটা রয়ে গেলো। কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“আচ্ছা, তাহলে যখন বাস্তবে ফিরে যাবেন তখন আমাকে খুঁজে জেনে নিবেন কিন্তু। দেখি আপনার সেই বাস্তবে আমি কি করছি।”
“সেখানে আপনাকে আমি কি করে খুঁজে পাবো?”কৌতুহল বসত জিজ্ঞেস করে তুষার।
ফারিহা আবারও হেসে বলে,
” আচ্ছা আমার নাম্বার টা মুখস্থ করে রাখুন। যেন বাস্তবে ফিরে গেলে খুঁজে নিতে পারেন আমাকে।”
ফারিহা নাম্বারটা বললে সেটা বারংবার আওরিয়ে মুখস্ত করতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো তুষার। এর মাঝে পাশ থেকে ফারিহা বলে,
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ক্ষুদার্ত। তাই একটু আগে জ্ঞান হারিয়েছিলেন। আর এখন এসব বলছেন। আচ্ছা, আপনি এখানে একটু বসুন। আমি দেখি কোনো খাবার পাওয়া যায় কি না। আর এই ব্যাগ গুলো দেখে রাখবেন।”
বলেই বড়ো ব্যাগটা থেকে একটা ছোট পার্স বের করে সেখান থেকে কিছু টাকা নিলো ফারিহা। অতঃপর ব্যাগটা তুষারের পাশে টেবিলে রেখে সামনের দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলো।
এই বিকেলের শেষ সময়ে স্টেশনে আপাতত কলা আর রুটি ছাড়া কিছু মিলছে না। তাই কলা আর রুটি সাথে এক বোতল পানি নিয়েই দোকানদারকে টাকা দিয়ে বাকি টাকা ফেরত নেওয়ার অপেক্ষা করছে।
ঐ সময়েই একজন হ্যান্ডসাম ছেলে এসে দাড়ালো তার পাশে। কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
“আরে ফারিহা! তুমি এখানে এসব কি নিচ্ছো? ওদিকে আমি কতক্ষণ ধরে খুঁজে চলছি তোমায়। আগে আমার সাথে দেখা করতে। ক্ষুদা লাগলে নাহয় কিছুটা সামনে গেলেই ভালো রেস্টুরেন্টে আছে, ওখানে বসতে পারতাম।”
ফারিহা তার দিকে চেয়ে দেখে, তৌহিদ। যার জন্য বাসা থেকে পালিয়ে এই খুলনা অব্দি আশা। ফেসবুকে রিলেশন তাদের। এর আগে তৌহিদ ঢাকা গেলে তখন একবার দেখা হয়েছিল তাদের। তাই দুজন দুজনকে চিনতে অসুবিধা হয়নি একটুও।
তৌহিদ তার দিকে চেয়ে বলে,
“কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি তোমায়?”
“স্যরি ফোন ব্যাগে রেখেছিলাম। আর বের করা হয়নি। হয়তো সাইরেন করা ছিল দেখে বুঝতে পারিনি।”
তৌহিদ এই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না। ফারিহার দিকে চেয়ে কিছুটা তাড়া দিয়ে বলে,
“আচ্ছা চলো তাড়াতাড়ি, সন্ধা হয়ে আসছে। আর এসব কলা পাওরুটি রাখো। কিচুটা সামনে গেলেই ভালো রেস্টুরেন্টে পাবে ওখানে খেয়ে নিবে।”
ফারিহা বাম দিকে ফিরে তুষারের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমার খিদে লাগেনি। এগুলো ঐ ভাইয়াটার জন্য। তাহলে এক কাজ করি। তাকেও আমাদের সাথে নিয়ে যাই।”
ফারিহার কথায় তৌহিদ ক্ষনিকটা অবাক হয়ে বলে,
“পা’গল নাকি তুমি? পালিয়ে বিয়ে করছি আমরা। এখন একটা অপরিচিত ছেলেকে আমাদের সাথে নিয়ে নতুন কোনো বিপদ টানতে চাইছো নাকি?”
ফারিহা এক পলক তুষারের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“তাহলে একটু দাড়াও তুমি। এগুলো তাকে দিয়ে একবারে তার থেকে বিদায় নিয়ে আসি আমি।”
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি করো।”
তুষারের সামনে এসে দাড়ালো ফারিহা। কিছুটা দুরে দাড়িয়ে আছে তৌহিদ। তার ফোনটা বেজে উঠতেই সে তা রিসিভ করে বলে,
“মেয়েটাকে আমি একাই নিয়ে আসছি। ওর পাশে থাকা ছেলেটা তার কাজিন বা তেমন কেউ না। কোনো সমস্যা করবে না সে। তোরা সবাই বসের কাছে চলে যা। আর বলবি, মেয়েটাকে নিয়ে সন্ধার পরই সেখানে পৌছে যাবো আমি।”
তুষার কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“ছেলেটা কি আপনার পরিচিত?”
“হুম আমার বয়ফ্রেন্ড। আপনাকে একটা মিথ্যা বলেছি। আমার বাসা খুলনায় না, ঢাকায়।”
তুষার ক্ষনিকটা অবাক হয়ে বলে,
“তার মানে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন!”
কিছুটা হাসলো ফারিহা। এর মাঝে তৌহিদ নামের ছেলেটা ডাক দিল তাকে। আর কিছু না বলে কলা পাউরুটি ও পানির বোতলটা তুষারকে দিয়ে বলে,
“এগুলো খেয়ে নিন। শরিরে কিছুটা শক্তি পাবেন। আল্লাহ হাফেজ। আর হ্যাঁ, দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
বলেই তৌহিদের দিকে চেয়ে আসছি বলে বেঞ্চের উপর রাখা ব্যাগটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে গেলো সে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে যে তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা ফেলে গেছে তা হয়তো খেয়ালই করেনি ফারিহা। তুষারও আপাতত সেদিকে খেয়াল না করে তাকিয়ে আছে তার চলে যাওয়ার দিকে।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর কেমন যেন একা মনে হচ্ছে তুষারের। এতক্ষণ সে ছিল বলে নিজের পাশে একটা সঙ্গি অনুভব করেছিল সে। এখন সেটাও গেলো। আচ্ছা আবারও কি দেখা হবে তার সাথে? এটা কি ফেলে গেলো সে? চোখে পড়তেই সেদিকে ভালো ভাবে দৃষ্টি রাখলো তুষার।
———————————
“তুষার কোথায়?”
নিবিড়কে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে ফরিদা আন্টি জিজ্ঞেস করলো কথাটা। নিবিড় তার দিকে চেয়ে বলে,
“আর বলবেন না আন্টি। আজ সারাদিন ধরে ঘুমের মাঝে কাটাচ্ছে। কিসব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছে আর ওসব বাস্তব ভাবছে আর নিজের মতো বকছে। এখনো হয়তো ঘুমিয়েই আছে।”
“এই অবেলায় কিসের ঘুম? তাকে জাগিয়ে দিয়ে বলবে, আমি ডেকেছি।”
চোখে মুখে পানির ছিটা পড়তেই জেগে উঠে তুষার। চোখ খুলে দেখে নিবিড় হাতে গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তুষার জেগে উঠতেই সে বলে,
“নতুন করে কি স্বপ্নে দেখলি?”
তুষার চোখ কচলে জবাব দেয়,
“সে চলে গেছে।”
তুষার ঘুমের ঘোরে বকছে ভেবে নিবিড় হেসে বলে,
“কে চলে গেছে?”
নিবিড়ের হাসি দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো সে। তুষারের বিরক্তিমাখা মুখ দেখে আবারও হাসলো নিবিড়। হাসি থামিয়ে বলে,
“উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যা। ফরিদা আন্টি ডেকেছে তোকে।”
“কেন?”
“আমাকে বলেছে নাকি? গেলেই দেখতে পাবি।”
উঠে ফরিদা আন্টির কাছে চলে গেগো সে। সেই সময়টা আর ঘুমায়নি। সন্ধার পর ছাদে গেলো। ফোনটা বের করে স্বপ্নে দেওয়া মেয়েটার নাম্বারটা মনে করার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। তখন খুব ভালো ভাবেই মুখস্থ করেছিল। কারণ আবার স্বপ্নে যদি সে মেয়েটার সাথে দেখা হয়, তখন নিশ্চই সে তার বাস্তবের অবস্থা জানতে চাইবে। যাওয়ার আগে এমনটাই বলেছিল সে।
কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে পড়লো সেটা। কল দিল সেই নাম্বারে। সত্যিই কি বাস্তবে এই নাম্বারে ফারিহা নামক কোনো মেয়ে আছে?
একবার কল করতেই রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভেসে আসতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তুষারের। নাম্বার টা কি সঠিক ছিল? তাহলে কি মেয়েটা সত্যিই বাস্তবের ফারিহা? নাকি অন্য কেউ? কোনো এক অজানা ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক বেড়েই ছলছে ক্রমশ।
To be continue………………