#রহস্যময়_ঘোর (পর্ব ৭)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আজ দিনটা খুব অস্থিরতায় পার হচ্ছে তুষারের। এই নিয়ে তিনবার ঘুমালো। এখনো একবারও সেই স্বপ্নের দেশে যাওয়া হলো না। অবাক করার বিষয় হলো এখন জোর করে ঘুমাতে চাইলেও সহজে ঘুম আসতে চাইছে না।
ঘোরের মাঝে মেয়েটার সাথে কাটানো গত ৭ টা দিন যেন ৭ মাসের সমান মনে হয়েছে তার। হুট করেই সব কিছু বদলে যাওয়াটা যেন মেনেই নিতে পারছে না সে।
তাহলে মেয়েটাকে কি সে আর দেখতে পাবে না? মনে এমন প্রশ্ন জাগতেই বুকটা কেঁপে উঠে তার।তাহলে এখানেই কি সব কিছুর সমাপ্তি হতে চলছে?
ভাবতেই যেন দু’চোখ ঝাপশা হয়ে এলো তার। ইমোশনাল মানুষদের এই একটাই সমস্যা। একটু আঘাত পেলেই ইচ্ছে করে কাঁন্না করে সব কষ্টের অবসান ঘটাতে।
দিনটা খুব বাজে ভাবেই কাটলো তার। ফারিহার কথা যেন মাথা থেকে সরছেই না। নিজের ঘুমের উপর বিরক্ত হয়ে পর দিন বিকেলে বের হয়ে যায় বাসা থেকে।
আজ তুষারকে ঘরে না দেখে অনেকটাই অবাক হলো নিবিড় ও ফারিদা আন্টি সবাই। নিবিড় বারবার ফোন দিলেও ফোন ধরলো না সে। ফারিহার কথা ভেবে এমনিতেই মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তার।
রাস্তার পাশ ধরে হাটতে হাটতে হটাৎই থমকে গেলো সে। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল পার্ক এর পাশে একটা ফুচকার দোকানের সামনে বসা একটা মেয়ের উপর।
দ্রুত পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিবিড়ের নাম্বারে কল দিল। একবার কল হতেই নিবিড় রিসিভ করে বলে,
“কোথায় তুই?”
তুষার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,
“নিবিড় সত্য করে একটা কথা বল তো। আমি এখন স্বপ্নে আছি নাকি বাস্তবে?”
নিবিড় কিছুটা ভেবে বলে,
“সেম প্রশ্ন তো আমারও। তোকে আজ হটাৎ বাইরে যেতে দেখে আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেলাম, আমি কি বাস্তব দেখছি না স্বপ্ন দেখছি।”
“মজা না করে সিরিয়াসলি বল।”
“আমার মনে হচ্ছে তোর সেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। আর তুই এখন বাস্তবেই আছিস।”
“আচ্ছা বন্ধু ধন্যবাদ।”
বলেই ফোন কেটে দিল তুষার। নিবিড় আরো কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তুষার চুপচাপ সেই মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটা বসে ফুচকা খাচ্ছে। একটা শেষ করে আরেকটা ফুচকা মুখে তুলতেই তুষার তার পাশে দাড়িয়ে বলে,
“আপনি ফারিহা, রাইট?”
“হুম বসুন।”
“আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
“চিনবো না কেন? গত এক সাপ্তাহ্ তো আপনার সাথেই কাটালাম।”
তুষার তার পাশে বসে কন্ঠে উত্তেজনা নিয়ে বলে,
“সত্যিই কি আপনি সে?”
“হুম।”
তুষার হাসলো। হাসতে হাসতে ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
“ও মাই গড! আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে বুঝি হারিয়েই ফেলেছি। বাস্তবে খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই সারপ্রাইজ এর মতো ছিল আমার কাছে।”
“হয়তো মন থেকেই চেয়েছেন আমি থেকে যাই। তাই হয়তো আমিও হারাই নি।”
তুষার হেসে বলে,
“এটা সত্যি বলেছেন। আমি মন থেকেই চেয়েচিলাম, আপনি থেকে যান।”
কিছুটা হাসলো ফারিহা। তুষার ফুচকা ওয়ালা মামার দিকে চেয়ে বলে,
“মামা আমাকেও এক প্লেট দিন।”
ফুচকা হাতে তুষার ফারিহার দিকে চেয়ে বলে,
“আপনাকে বলেছিলাম না বাস্তবের কথা। আপনি তো বিশ্বাস করেন নি। এখন নিজ চোখে দেখেন এটাই বাস্তব। আর আমি স্বপ্নে গিয়ে এটার কথাই বলতাম আপনাকে। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায়?”
“কেন এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন নাকি?”
কিছুটা লজ্জা পেলো তুষার। আচমকাই এমন কথা শুনে প্রতি উত্তরে কিছু বলতে পারলো না সে। এই প্রসঙ্গে আর জিজ্ঞেসও করেনি। খাওয়া শেষে তুষার দুই প্লেট ফুচকার দাম দিতেই ফুচকাওয়ালা বলে,
“আপনি তো এক প্লেট নিয়েছেন।”
তুষার ফারিহার দিকে ইশারা করে বলে,
“ওনারটাও আমি দিয়ে দিলাম। ওনার একটা আমার একটা। মোট দুই প্লেট।”
ফুচকাওয়ালা ওদিকে একবার চেয়ে বলে,
“ওনি টা কে?”
“যেই হোক, আপনি এত কথা না বলে আমাদের দুজনের বিল রাখেন তো।”
বলেই টাকা গুলো লোকটার হাতে দিয়ে ফারিহাকে নিয়ে প্রস্থান করল সেখান থেকে। ফুচকা ওয়ালা হা করে চেয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,
“পাগল নাকি?”
রাস্তার পাশ ধরে হেটে চলছে দুজন। বাস্তবে এই প্রথম কোনো মেয়ের সাথে একাকি হাটছে দেখে কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে তুষার। হাটতে হাটতে ফারিহা আচমকাই তুষারের হাতের আঙুলের ভাজে আঙুল দিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে নিল। হটাৎই থেমে গেলো তুষার। অবাক হয়ে আবদ্ধ হয়ে থাকা হাত গুলোর দিকে তাকালো সে।
ফারিহা স্বাভাবিক ভাবেই হাতটা ধরে রেখে বলে,
“কি হলো, থেমে গেলে কেন? চলো।”
এবার তুষারও কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে পূনরায় হাটতে শুরু করলো। হাটতে হাটতে বলে,
“প্রথম কেউ এমন করে প্রকাশ্যে হাত ধরলো। তাই চমকে গিয়েছিলাম।”
কিছুটা হাসলো ফারিহা। স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
“এখন ঠিক আছো? হাটতে পারবে তো, নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।”
তুষার কিছুটা লজ্জা পায় এমন কথায়। তা কিছুটা চেপে রেখে বলে,
“হুম ঠিক আছি। চলুন।”
“আপনি আপনি করছো কেন? দেখছো না আমি তুমি করে বলছি? এভাবে তুমি করেই বলবে।”
আশপাশ দিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। মানুষ গুলোর এমন চাহুনির মানে বুঝলো না তুষার। ওসব নিয়ে খুব একটা ভাবলোও না।
রাত তখন নয়টা। তুষার এখনো বাসায় ফিরছে না দেখে একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে নিবিড়। তুষার বিরক্ত হয়ে ফোনে এয়ারপ্লেন মুড অন করে দিল।
রেস্টুরেন্টে বসে ডিনার করছে তারা। সেখানেও সবাই অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। এবার কিছুটা বিরক্ত হলো তুষার। আশে পাশে এতো ক্যাপল থাকতে সবাই তাদের দিকেই কেন তাকাচ্ছে? কি আজব!
“রাত হয়ে গেছে দেখে বাসায় কিছু বলবে না তোমাকে?”
কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল তুষার। ফারিহা মুচকি হেসে বলে,
“সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে নিব।”
দুজনের বিল দিয়ে তারা বের হয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। বিল নেওয়ার সময় এরাও সেই ফুচকাওয়ালার মতোই অবাক হয়েছিল তুষারের মুখে দুজনের কথা শুনে। তখন বিরক্ত হয়ে টাকা গুলো রেখেই ফারিহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
সেদিন বাসায় ফিরে এই ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি তুষার। কারন সে এখনো স্বপ্নে না বাস্তবে এটা নিয়ে কনফিউজড। পুরোপুরি শিউর না হওয়া ছারা কারো কাছে হাসির পাত্র হতে চাইছে না সে।
এভাবে কেটে গেলো দুই- তিন দিন। এখন পুরোটা সময়ই বাইরে কাটায় সে। যাওয়ার সময় কাউকে কিছু বলেও যায় না। সারাদিন বাইরে সেই ফারিহার সাথেই পার করে দেয় সে।
আজ গেলো শপিং মলে। দুজন হেটে হেটে জামা টি-শার্ট এসব পছন্দ করে নিচ্ছে এখানেও সবাই শুধু তাদের দিকেই তাকাচ্ছে। আজব! সবাই কি তাদেরকে জোকার পেয়েছে নাকি? নাকি ভিনগ্রহের কোনো প্রানি?
আজ বাসায় ফেরার সময় হাতে করে মিষ্টি নিয়ে ফিরল তুষার। সবািকে মিষ্টি মুখ করিয়ে সেই মেয়েটির কথা বলে। স্বপ্নের সেই মেয়েটিকে বাস্তবে খুঁজে পেয়েছে সে।
সবাই অবাক হলো এমনটা শুনে। ফরিদা আন্টি বলে,
“তাহলে আগামিকাল তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসো৷ আমরাও দেখি তোমার সেই স্বপ্নের পরীকে।”
,
,
আজ পনেরো তম দিন চলছে। নিবিড় ও ফরিদা আন্টির সাথে যারই দেখা হচ্ছে সবাই একই কথাই বলছে, তুষারকে নিয়ে। তুষার নাকি ইদানিং পা’গলের মতো আচরণ করছে। একা একা হাটে আর কার সাথে যেন কথা বলে। আর খুব হাসাহাসি করে। তারা অনেকটাই অবাক হলো এসব শুনে।
রেজোয়ান অবাক হলো না। তার এত বছরের চেষ্টা অবশেষে সাক্সেস। হাতে সেই তরল পদার্থ টা নিয়ে একটা হাসি দিল সে। এটা এমন এক ইনজেকশন, যা নিয়ে মানুষ তাদের কল্পনাকে অনুভব করতে পারবে। মানে মানুষ যা যা ভাবে, কল্পনা করে, সবই এই ইনজেকশন নেওয়ার পর বাস্তবে অনুভব করতে পারবে। সহজ ভাসায় বলতে গেলে মানুষ তার অনুভূতিকে বাস্তবে অনুভব করবে। যার মেয়াদ কাল হবে পনেরো দিন। প্রথম সাপ্তাহ স্বপ্নে। আর দ্বিতীয় সাপ্তাহ বাস্তবে। তারপর মেয়াদ শেষে মানুষ প্রতিশেধক নিয়ে আবারও তার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে। আর এই ইনজেকশনের নাম দেওয়া হয়েছে, Realization of feelings,,,,,
হয়তো তুষার কল্পনায় এসব সময় এমন কেউ ছিল। সে হয়তো ভাবতো, তার একজন ভালোবাসার মানুষ থাকবে। যার সাথে কথা বলবে, অনুভূতির আদান-প্রদান হবে, তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হবে। এক কথায় তার ভাবনায় হয়তো এমন একজন মানুষ ছিল, যাকে সে এখন অনুভব করছে। হয়তো একজন ভালোবাসার মানুষ থাকবে, এটা বেশি ভাবতো দেখে ঐ মেয়েটা সেই ভাবনার বাস্তবিক রুপ হয়ে তার কাছে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে ঐ মেয়েটার কোনো অস্তিত্ব নেই।
সন্ধার পর বৃষ্টি শুরু হলো। রেজোয়ান একটা ছাতা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাসায় প্রবেশ করে। তখন সন্ধা সাড়ে সাত টা। নিবিড়ের কাছে জিজ্ঞেস করে তুষারের কথা। জানতে পারে, তুষার এখনো বাসায় ফিরেনি। অস্তিরতা বেড়ে যায় রেজোয়ানের। যা দেখে নিবিড় কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বলে,
“এতো অস্থির হয়ে তুষারকে খুঁজছেন কেন?”
রেজোয়ানের মাঝে কিছুটা ভয়ার্ত ভাব লক্ষ করা যায়। অস্থিরতা নিয়ে বলে,
“তাড়াতাড়ি আমাদের তুষারকে খুঁজে বের করতে হবে। নয়তো তুষার দেড় ঘন্টা পরই মা’রা যাবে।”
“মানে?”
রেজোয়ান এবার সত্যটা নিবিড়কে বলে,
“পনেরো দিন আগে আপনারা সন্ধায় কোথা থেকে এসে খুব ক্লান্ত ছিলেন মনে আছে?”
“হুম। যার্নি করে এসেছিলাম দেখে ক্লান্ত ছিলাম। কেন কি হয়েছে।”
“সেদিন তুষার ক্লান্তিতে সন্ধা কালেই ঘুমিয়ে দিয়েছিল। আর নয়টার সময় আমি আমার তৈরি একটা ইনজেকশন তার শরিরে পুশ করেছিলাম। যার কারণেই তুষারের সাথে এসব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা গুলো ঘটেছিল। আজ পনেরো তম দিন। সেই ইনজেকশনের মেয়াদের শেষ দিন। আজ নয়টার আগেই আবার তার শরিরে তার প্রতিশেধক পুশ করতে হবে। নাহলে নয়টা পার হলেই সেই পনেরো দিনের আগে দেওয়া ইনজেকশন তার শরিরে বিষক্রিয়া তৈরি করে তার মৃ’ত্যু ঘটাবে।”
হটাৎ নিবিড় আক্রমনাত্মক ভাবে রেজোয়ানের কলার চেয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে,
“কি করেছেন আপনি তুষারের সাথে? কেনই বা এসব করেছেন?”
রেজোয়ান সবটা বললো নিবিড়কে। তারপর বলে,
“এখন রাগ না দেখিয়ে নয়টার আগে তুষারকে খুঁজে বের করে প্রতিশেধক দিতে হবে। নয়তো তুষার বাচবে না। এই পনেরো দিনের ঘোরই তার মৃ’ত্যুর কারণ হবে।”
নিবিড় তাকে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে বলে,
“এখন আপাতত তুষারের কথা ভেবে আপনাকে কিছু বলছি না আমি। রাজ ও রুশান ফিরে আসার পর আপনাকে এর জন্য তাদের কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। এসব কিছুর জন্য হিসেব চুকাতে হবে আপনার।”
বলেই বৃষ্টির মাঝে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। তার পেছন পেছন রেজোয়ানও বের হলো। হাতে সময় আছে মাত্র দেড় ঘন্টার মতো। এর মাঝেই তুষারকে খুঁজে বের করতে হবে।
,
,
বৃষ্টির মাঝে ফারিহার সামনে এক হাটু ভাজ করে বসলো তুষার। আজ অনেক সাহস সঞ্চয় করে ফারিহাকে প্রপোজ করে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে সে।
নিবিড় একটা ছাউনির নিচে দাড়িয়ে হাত দিয়ে ভেজা ফোনের স্কিন মুছে তুষারকে কল দিল। ফোন বাজতেই তুষার পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে নিবিড়ের কল। কাটতে গিয়েও ব্যার্থ হলো। কারণ ফোনে পানি পরায় স্কিন কাজ করছে না। দেখতে দেখতে কল কেটে গেলো। আবার কল দিল। নিবিড় তীব্র উত্তেজিত গলায় বলে, শুধু একবার ফোনটা ধর তুষার।
তুষার কোনো মতে ফোনের গ্লাস হালকা মুছে কল কেটে আগের মতো এয়ারপ্লেন মুড অন করে দিল। যাতে নিবিড় আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করতে না পারে।
ফারিহা তা দেখে বলে,
“ফোনটা ধরো। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে।”
তুষার হাসি মুখে তার দিকে চেয়ে বলে,
“আমার কাছে এই মুহুর্তে তোমার চেয়ে আর কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ না।”
To be continue……………