#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৩
” ফুপি! ও ফুপি! তুমি এসব কি করছো? যেয়ো না প্লিজ। ফুপি! ”
দুয়া’র অনুনয় উপেক্ষা করে লাগেজ হাতে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন সাজেদা। লিভিং রুমে পরিবারের সদস্যরা সকলে উপস্থিত। তাসলিমা এবং আনোয়ারা বেগম এক কোণে মলিন বদনে দাঁড়িয়ে। সাজ্জাদ সাহেব থমথমে মুখে দু হাত পিঠের ওপর বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। দুয়া ফুপির বাম হাত আঁকড়ে ধরলো। উনি দাঁড়িয়ে পড়তেই দুয়া ভেজা কণ্ঠে বললো,
” ও ফুপি! তুমি এমন করছো কেন? আব্বুর সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছো! যেয়ো না। প্লিজ ফুপি। ”
সাজেদা মায়া মায়া চোখে ওর দিকে তাকালেন। ললাটে চুমু এঁকে বললেন,
” আমাকে যেতে হবে মা। এত অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”
” ফুপি! ”
ছোট্ট জাহিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মায়ের কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহমিদার চোখে নোনাজল। সাজেদা দুয়া’র থেকে সরে গিয়ে মেয়ে তানুর দিকে তাকালেন।
” চল। ”
তানু মায়ের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো,
” আমি যাবো না আম্মু। তুমি দয়া করে মামার সাথে রাগ.. ”
আর বলা হলো না। কিশোরী মেয়েটা বাঁ গালে হাত রেখে হতবিহ্বল নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বাকি সকলে স্তব্ধ! সাজেদা এ কি করছে! সাজেদা মেয়ের দিকে র’ক্তিম চাহনিতে তাকিয়ে থেকে গটাগট কদম ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। কেউ বাঁধা প্রদান করার সুযোগ অবধি পেল না। সাজ্জাদ সাহেব চোখের জল লুকিয়ে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ালেন। তাসলিমা এবং তাহমিদা মলিন চোখে একে অপরের দিকে তাকালো। আর জাহিরাহ্ দুয়া! সে তো হতবাক! অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইলো দরজায়।
•
আঁধার রজনী। বিছানায় মুখোমুখি বসে নিজাম সাহেব এবং তাসলিমা। অবাক কণ্ঠে নিজাম সাহেব বললেন,
” তুমি এসব কি বলছো? ”
” আমি ঠিকই বলছি। সাজেদা এই সম্পর্কে রাজি নয় বোধহয়। এজন্যই আমাদের প্রতি পুষে রাখা রাগ ভাই ভাবিকে দেখালো। অশান্তি করে একাকী বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। ”
” এ তো অবিশ্বাস্য কাণ্ড! সে আমাদের এমন ভাবে! এতটাই অপছন্দ করে! ”
তাসলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” সাজেদা আমাদের পছন্দ করে না এটা বহু আগেই বুঝতে পেরেছি। তবুও কখনো কোনো বাজে রিয়েক্ট করিনি। দেখাসাক্ষাৎ হলে সবসময় চেষ্টা করেছি মিলেমিশে থাকার। তারপরও যে সে আমাদের এতটা অপছন্দ করে ভাবতে পারিনি। ”
” আমি তো কখনো সেভাবে অনুধাবন ই করিনি যে সাজেদা আমাদের… ”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তাসলিমা বললেন,
” ওসব ছাড়ো। এবার এটা বলো আমরা কি করতে পারি? সাজ্জাদ ভাই এসবের রেশ ধরে তূর্ণ দুয়ার সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করবেন না তো? ওদের দু’জনের মধ্যে এসবের বাজে প্রভাব পড়বে কি? ”
” কিছুই বুঝতে পারছি না তাসলিমা। সে সাজ্জাদের ছোট বোন হয়। স্বাভাবিক ভাবেই… ”
” আমি ওসব বুঝি না। দুয়া আমার পুত্রবধূ হবে। লাল টুকটুকে বউ সেজে আমাদের বাড়িতে আসবে। এটাই শেষ কথা। এরমধ্যে আমি কোনোরূপ বাঁধা চাই না। বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাচ্ছি? ”
নিজাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে বসলেন। আনমনে বললেন,
” হুঁ। দেখা যাক কি হয়। ”
দু’জনেই চিন্তিত ভবিষ্যত নিয়ে। ওনারা টেরও পেলেন না দরজার বাহিরে দন্ডায়মান কেউ একজন ওনাদের কথোপকথন শুনে ফেলেছে। কি হতে চলেছে এবার?
•
আঁধার রাত্রির ন্যায় কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী মেয়েটার মনেও আঁধার নেমেছে। স্টাডি টেবিলে ম্লান বদনে বসে রয়েছে দুয়া। বিছানায় বসে তানজিনা এবং তানু। তানজিনা আদুরে হাতে ক্রন্দনরত তানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। খানিক বাদে দুয়া চেয়ার টেনে পিছু ঘুরে বসলো। ক্ষীণ স্বরে শুধালো,
” বড়াপু! ফুপি সত্যিই চলে গেল? ফিরবে না? ”
তানজিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” জানি না রে বোন। কি থেকে কি হলো! সবটাই জটিল। কিছু বুঝেও যেন বুঝতে পারলাম না। ”
দুয়া মন খারাপ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এসে বসলো বিছানায়। তানুর পাশে। ওর বাঁ কাঁধ ডান হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে মুখখানি ফিরিয়ে নিলো। মেয়েটার আদুরে মুখটা কেমন র’ক্তিম আভায় ছেয়ে গেছে! কপোলে পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ! দেখতেই কোমল হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে। দুয়া আদুরে হাতে ওর ছোট বোনটির নোনাজল মুছে দিলো। আশ্বস্ত করতে বললো,
” কাঁদিস না তানু। ফুপি ঠিক চলে আসবে। তোকে ছাড়া, আমাদের ছাড়া সে একা একা থাকতে পারবে? পারবে না তো। ঠিক চলে আসবে। কাঁদিস না বোন। ”
” আপু! ”
মেয়েটা দুয়া’র বুকে মাথা এলিয়ে পুনরায় কাঁদতে লাগলো। তানজিনা ও দুয়া এই দৃশ্য অবলোকন করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লো। তানজিনা কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ নজর পড়লো দরজায়। ছোট ভাইটা দাঁড়িয়ে। মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। ভয় পাচ্ছে কি? তানজিনা হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো। কিন্তু জাহিন এলো না। দৌড়ে চলে গেল সেথা হতে। বড় করে শ্বাস ফেললো তানজিনা। এসব কি হচ্ছে? কবে হবে এসবের সমাধান?
•
দু’টো দিন অতিবাহিত হলো। মনে হচ্ছিল সময় বুঝি থমকে গিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির এক জায়গায়। নড়তে নারাজ। প্রতিটা মিনিট, ঘন্টা অস্বস্তিতে পাড় হলো। অবশেষে স্বস্তি মিললো দু’দিন পর। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় বাড়ির ল্যান্ডলাইনে কল এলো। কল রিসিভ করলেন তাহমিদা। ওপাশ থেকে ননদের কথাবার্তা শুনে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন উনি। ফোনালাপ শেষে খুশি খুশি সকলকে জানালেন সুসংবাদ।
” আপা ফিরে আসছে। ওনার অভিমান কেটে গিয়েছে।”
খুশিতে ভরে উঠল সকলের হৃদয়। তবে আসলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে? নাকি আসন্ন নতুন কোনো মুসিবত?
•
তমসায় আচ্ছাদিত রজনী। আনন্দে মুখরিত শুভ্র রঙা
‘ ছায়াবিথী ‘ নামক ডুপ্লেক্স বাড়িটির লিভিংরুম। তাহমিদা কিচেনে হাতে হাতে সহায়তা করছেন বড় বোনকে। লিভিং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে সাজেদা এবং আনোয়ারা বেগম। ছেলে-মেয়েরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুনসুটিতে মত্ত। সাজেদা অনুতপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে আনোয়ারা বেগমের বাম হাতটি দু হাতের আঁজলায় ভরে নিলো। মোলায়েম স্বরে বললো,
” মাওই মা! কি বলে ক্ষমা চাইবো বুঝতে পারছি না। এমন ভুল আমি কি করে করতে পারলাম? বড়ছোট ভুলে গিয়ে যা নয় তাই বললাম! আমি সত্যিই লজ্জিত মাওই মা। কি বলে ক্ষমা চাইবো জানি না। আপনি দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিজের মেয়ে মনে করে ভুলটা মাফ করে দিন মাওই মা। নাহলে আমি যে.. ”
বৃদ্ধা মুচকি হেসে ডান হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
” ক্ষমা চাইতে হবে না সাজেদা। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমি কিছু মনে করিনি। তোমার যদি নিতান্তই ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয় ওপর ওয়ালার কাছে করো। সে নিশ্চয়ই মহান! সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল। ”
সাজেদা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
” আপনি সত্যিই কিছু মনে করেননি তো মাওই মা? আমার যে খুব অনুশোচনা হচ্ছে। গত দু রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। অনবরত অনুশোচনায় দ গ্ধ হচ্ছিলাম। আমায় দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমি কি থেকে কি বলে ফেলেছি। নিজেই বুঝতে পারছি না। ”
আনোয়ারা বেগম অতি সুন্দর কায়দায় সবটা সামলিয়ে নিলেন। মিলমিশ হয়ে গেল দু’জনের।
.
দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল জাবির। হঠাৎ পেছন থেকে ‘ ভাউ ‘ শব্দ করে ভয় দেখানোর প্রয়াস চালালো কেউ একজন। তড়িৎ পিছু ঘুরে তাকালো জাবির। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো ছোট বোনের হাসিখুশি মুখখানি। তা লক্ষ্য করে গম্ভীর মুখশ্রীতে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জাবির বাঁ হাতে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
” কি রে বুড়ি! ভাইকে ভয় দেখানো হচ্ছে? ”
” হুঁ। কিন্তু ভাই আমার ভূতেরও সর্দার। তাই তো কাউকে ভয় পায় না। ”
নিঃশব্দে হাসলো জাবির। বোনের গাল টিপে দিয়ে শুধালো,
” আমি ভূতের সর্দার? ”
মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানালো তানু। ভাইয়ের বুকে লেপ্টে আদুরে গলায় বললো,
” উঁহু। আমার ভাইয়া ওয়ার্ল্ড’স্ বেস্ট ব্রাদার। ”
” বাব্বাহ! এতবড় কমপ্লিমেন্ট? ”
” হাঁ। ”
হেসে উঠলো দুই ভাই-বোন। তানু এবার ভাইয়ের বুক থেকে মাথা তুললো। তাড়া দেখিয়ে বললো,
” ভাইয়া চলো চলো। আমার সাথে ছাদে চলো। আমরা ছোটরা সবাই ছাদে আড্ডা দিচ্ছি। ”
” হাঁ তো? তুই যা। তুই ছোট। যা। আমাকে কি দরকার? আমি তোর মতো পুঁচকে নাকি? ”
তানু গাল ফুলিয়ে বললো,
” ভাইয়া! তুমি যাবে কি না? ”
হাসলো জাবির।
” চল। ”
খুশিমনে তানু ভাইয়ের হাত ধরে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
.
আঁধার রজনী। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুয়া। পড়নে তার ডিপ রেড লং টপস এবং প্লাজো। দীঘল কালো কেশ খোঁপা বন্দী হয়ে ওড়নার অন্তরালে লুকায়িত। দু কানের পাশ হতে ছোট ছোট কিছু চুল কপোলের কোমল আবরণ ছুঁয়ে রয়েছে। দৃষ্টি নিবদ্ধ চন্দ্রিমায়। স্বল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মানব সম্মোহনী চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে হৃদয়ে লুকানো ললনার পানে! চন্দ্রের মোহনীয় দ্যুতিতে উজ্জ্বল মুখশ্রী। মায়ায় পূর্ণ জাদুময়ী আঁখি যুগল! অধর কোণে চিকন হাসির রেখা! ফোলা ফোলা দু কপোল। সম্মোহিত মানবের অপলক চাহনি ঘুরে বেড়াচ্ছে মায়াবী মুখখানি জুড়ে। বেড়ে চলেছে হৃদয়ের অস্থিরতা। ধুকপুক ধুকপুক কলরব ভেসে আসছে বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্র হতে। একটুখানি নৈকট্য, ছুঁয়ে দেয়ার তৃষ্ণায় পীড়িত হয়ে চলেছে পৌরুষ চিত্ত। ছোট বোনের ডাকে মোহাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেল। বিরক্ত হয়ে ‘ চ ‘ সূচক শব্দ নির্গত হলো কণ্ঠনালী হতে।
ছাদে জমে উঠলো আড্ডা। তরুণ তরুণীরা বসে ফ্লোর ম্যাটে। বহুদিন পর একসাথে এতজন জমায়েত হয়েছে। হাসিখুশিতে অতিবাহিত হতে লাগলো প্রহর। তাসলিমার একান্ত অনুরোধ রক্ষার্থে এখানে এসে মন্দ হয়নি কিন্তু। দুর্দান্ত সময় কাটছে।
•
” ছিঃ ছিঃ ছিঃ! শেষমেষ এই চলছিল তোমাদের মধ্যে? মা-বাবার দেয়া শিক্ষা ভুলে গিয়ে শেষমেষ যি*না ব্য*ভিচারে লিপ্ত হলে? ছিঃ! ”
হতবিহ্বল দুই মানব মানবী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সম্মুখে তাকালো।
” তুমি এসব কি বলছো? বিশ্বাস করো আমরা কোনো অন্যায় করছিলাম না। আমরা তো…! ”
” চুপ। আর একটাও কথা নয়। এই ছিল পেটে পেটে? আর আমি ভাবছিলাম..! এটা কি করে করতে পারলে তোমরা? ”
মানবী সাফাই দেয়ার চেষ্টা করলো। তবে লাভ হলো না। না চাইতেও ঘটে গেল অভাবনীয় সে কাণ্ড!
চলবে.
[ আসসালামু আলাইকুম পাঠক বন্ধুরা। পর্বটি একটু ছোট হয়েছে? শেষের দৃশ্য বোধগম্য হয়নি! আগামী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন। ধামাকা হতে চলেছে। ধামাকা। ধামাকা পড়তে নিমন্ত্রণ রইলো কিন্তু। ]