#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।
মেহুল রুমে শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছিল। তখন তার মা সেই রুমে আসেন। তিনি গিয়ে মেহুলের পায়ের নিচে বসলেন। মা’কে দেখে মেহুল উঠে বসল। মায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কিছু বলবে?’
রামিনা বেগম তাকে আপাদমস্তক পরখ করে বললেন,
‘কালেকে রাতে কি চেঞ্জ করে এটাই পরেছিলে?’
মেহুল নিজের গায়ের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘কালকে রাতে চেঞ্জ করিনি। সকালে উঠে এটা পরেছি।’
‘জামাই দেখেছে?’
‘না।’
‘যা, তাহলে। এক্ষুণি গিয়ে গোসল করে একটা ভালো সেলোয়ার কামিজ পর।’
মেহুল কপাল কুঁচকে বলে,
‘এই গরমে সেলোয়ার কামিজ পরে থাকা যায় না। এই লং টি শার্ট গুলোতেই আরাম।’
‘আরাম পরে করতে পারবে। এখন যা বলেছি তাই করো। আমার কথার যেন কোনো হেরফের না হয়।’
রামিনা বেগম রুম থেকে চলে যাওয়ার পর মেহুল ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলে। এসবে সে চরম ভাবে বিরক্ত। না পারছে কিছু বলতে, আর না পারছে সইতে। সে ফোনটা ধপ করে বিছানায় রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় গোসল করতে।
মেহুলের খুব বাজে একটা অভ্যাস হলো, শাওয়ার ছেড়ে গলা ফাটিয়ে গান গাওয়া। এর জন্য সে ছোটবেলায় মায়ের অনেক বকাও খেয়েছে। কিন্তু, লাভের লাভ কিছুই হয়নি।।সে তার এই অভ্যাস বদলাতে পারেনি। আজও শাওয়ার ছেড়ে চেঁচিয়ে গান গাচ্ছে সে।
_____
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দরজা আটকে পেছনে ফিরতেই হকচকিয়ে উঠে সে। চেঁচিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে,
‘আপনি এখানে কী করছেন?’
রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘আমি এখানে থাকব না তো কে থাকবে?’
মেহুল ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘আশ্চর্য! আপনাকে আমার রুমেই কেন থাকতে হবে? আর কি কোনো রুম নেই? অন্য রুমে যান। দেখছেন না আমি গোসল করে মাত্র বেরিয়েছি। মানুষের প্রাইভেসি বলে কিছু নেই নাকি? এমন হুট হাট অন্যজনের রুমে ঢুকে বসে আছেন। যান, বের হন।’
মেহুলের এসব কথায় রাবীরের মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। মেহুল দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে শক্ত হয়ে দাঁড়াল। মেহুল ভ্রু কুঁচকে তার দিকে চেয়ে আছে। রাবীর ঠান্ডা স্বরে বলল,
‘আপনি বোধ হয় ভুলে গিয়েছেন, কাল যে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আপনি এখন আমার ওয়াইফ, মিসেস খান। আর তাই এখন থেকে আপনার আমি বাদে আর কোনো প্রাইভেসি নেই। তাই আমার সামনে কোনো প্রাইভেসি দেখাবেন না। বুঝতে পেরেছেন?’
মেহুল কোমরে হাত দিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
‘জি না, বুঝতে পারিনি। আর বুঝতে চাইও না। আর একদম আমাকে ওয়াইফ ওয়াইফ বলে চেঁচাবেন না। আমি আপনার ওয়াইফ না। আমি এই বিয়ে মানি না।’
রাবীর তাকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে গা থেকে ব্লেজারটা খুলে বিছানার উপর রাখল। তারপর শার্টের হাতা ভাঁজ করতে করতে বলল,
‘আপনার মানা বা না মানাতে আমার কিছুই যায় আসে না। বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আর আপনি আমার ওয়াইফ। এখন কেউ চাইলেও আর এই সত্যিটাকে বদলাতে পারবে না। তাই আপনার জন্য এটাই ভালো হয় যে, সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিন।’
মেহুল রেগে যায়। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘হ্যাঁ, তাই তো। আপনারা সবাই সবকিছু আমার উপর চাপিয়ে দিবেন, আর আমাকেও সবকিছু মেনে নিতে হবে। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। মানুষ না আমি? আমারও তো মত থাকতে পারে। আমারও তো…’
‘আপনার এই মত আপনার বিয়ের আগে বলা উচিত ছিল। এখন বলে কোনো লাভ নেই। বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন হাজার চেষ্টা করলেও কিছু করা সম্ভব না। বুঝতে পেরেছেন?’
কিছুটা রাগ দেখিয়েই কথাগুলো বলে রাবীর। মেহুল পুরো চুপ হয়ে যায়। রাগ হলেও কিছু বলতে পারে না। রাবীর তাকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে সে মেহুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে যায়, “বাই দ্যা ওয়ে, গানটা কিন্তু ভালোই গান।”
মেহুলের এখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। লোকটা তার উপর চেঁচাল? এত সাহস? মেহুল রাগে ছুটতে ছুটতে তার মা বাবার রুমে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে তার মা বাবাকে ঔষধ খাওয়াচ্ছেন। বাবা তার খুব অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। এই বাবার মন রাখতেই তাকে আজ এতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে।
মেহুল রুমে গিয়ে সোজা মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘মা, আমি এই ছেলের সাথে থাকতে পারব না।’
তার মা বাবা দুজনেই তার দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইলেন। রামিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে ফিচেল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আবার কী করেছিস তুই?’
‘আমি কিছু করিনি। উনি করেছেন। উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন।’
রামিনা বেগম দুই ভ্রু’র মাঝে কুঁচকানো অংশটা সোজা করলেন। তারপর ঔষধগুলো সব গুছিয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘আমি আমার মেয়েকে চিনি। আর আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে যে, সে কাউকে ছোট করার জন্য তার উপর মিথ্যা কোনো অপবাদ দিবে না।’
মেহুল অসহায় সুরে বলে,
‘মা, আমি…’
রামিনা বেগম তাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন,
‘জামাই এসেছে। কী লাগবে না লাগবে গিয়ে দেখো। আমি ডাইনিং এ খাবার বাড়ছি।’
এই বলে তিনি চলে গেলেন। মেহুল এবার অসহায় চোখে তার বাবার দিকে চাইল। বাবার চোখে তার থেকেও বেশি অসহায়ত্ব দেখল সে। তার বাবা মৃদু সুরে বললেন,
‘এমন করে না, মা। রাবীর ভালো ছেলে। ও তোমাকে ভালো রাখবে। মা বাবার উপর বিশ্বাস রাখো।’
মেহুল জবাবে আর কিছু বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
_____
রামিনা বেগম ডাইনিং এ খাবার বেড়ে মেহুলকে ডাকেন। মেহুল ডাইনিং রুমে এসে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে?’
রামিনা বেগম বললেন,
‘যা, রাবীরকে ডেকে নিয়ে আয়।’
‘আমি কেন?’
রামিনা বেগম ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
‘তো তোর জামাইকে কি আমি গিয়ে ডাকব? যা।’
মেহুল বড়ো বড়ো পা ফেলে নিজের রুমে যায়। রাবীর তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। মেহুল বারান্দার দরজার সামনে চোখ মুখ কুঁচকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকে। রাবীর ফোন রেখে তার দিকে ফিরতেই সে বলে,
‘মা খাবারের জন্য ডাকছেন। খেয়ে দেয়ে বাড়ি চলে যান।’
‘আর যদি না যাই?’
মেহুল তখন ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বিদ্রুপের সুরে বলে,
‘ঘরজামাই হওয়ার ইচ্ছা নিশ্চয় আপনার নেই। আর যদি থেকে থাকে, তবে এই বাড়িতে আজীবনের জন্য থেকে যেতে পারেন।’
মেহুল তার কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রাবীরও আলতো হেসে তার পেছন পেছন আসে।
_____
রাবীর ডাইনিং এ বসে বলল,
‘কী ব্যাপার, মা; আপনারা কেউ বসছেন না কেন?’
রামিনা বেগম হালকা হেসে বললেন,
‘আমরা পরে খাব। তুমি আগে খাও, বাবা।’
‘বাবা খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, খেয়েছেন। তুমি খাওয়া শুরু করো।’
রাবীর তখন মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি বসে পড়ুন।’
মেহুল অন্যদিকে চেয়ে বলল,
‘না, আমি মা আর চাচির সাথে খাব।’
রামিনা বেগম তখন বললেন,
‘না মেহুল, তোমার আমাদের সাথে খেতে হবে না। জামাইয়ের সাথে বসে পড়ো।’
মেহুল বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে না। বাধ্য হয়ে রাবীর এর পাশের চেয়ারেই বসে।
খাওয়ার মাঝেই রামিনা বেগম বললেন,
‘খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিকেলের দিকে জামাইকে নিয়ে একটু বাগানে ঘুরে আসিস।’
মেহুলের চোখ মুখ কুঁচকে বলে,
‘না মা, আমি খেয়ে ঘুমাব। আমার ঘুম পাচ্ছে।’
রামিনা বেগম তখন কপাল কুঁচকে বললেন,
‘এমনিতে তো ঘুমাস না, আজই তোর বিকেলে ঘুম পেয়ে গেল?’
তার চাচি তখন পাশ থেকে বলে উঠলেন,
‘থাক না ভাবি, ঘুমাক। রাতে মনে হয় ঠিক ঠিক মতো ঘুম হয়নি। থাক এখন একটু ঘুমাক।’
এই বলে চাচি ওড়ানা দিয়ে মুখ চেপে হাসলেন। মেহুলের এই মুহুর্তে বিরক্ত আর অস্বস্তি দুটোই লাগছে। সে আড়চোখে রাবীরের দিকে চেয়ে দেখে সেও ঠোঁট চেপে হাসছে। মেহুল রাগে তখন চোখ মুখ গুঁজে লোকমার পর লোকমা দিয়ে খেতে থাকে।
চলবে…