#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৩।
বেশ কয়টা দিন পার হয়ে গিয়েছে। মেহুলের বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। মেহুলও আজকাল বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সামনে পরীক্ষা তার, তাই এখন খুব চাপ। এই কিছু দিনে রাবীরের সাথেও বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। তবে মেহুলের ঝগড়া করার স্বভাব এখনো যায়নি। ছোট খাটো ব্যাপার নিয়েও রাবীরের সাথে তার ঝগড়া করতেই হবে। যদিও রাবীর কোনোবারই তাকে কিছু বলে না। আর তাই প্রতিবার মেহুল’ই তার তর্কে জয়ী হয়।
_______
ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় রিতা বলল, সে একটু মার্কেটে যাবে, কিছু একটা নাকি কেনার আছে তার। মেহুল তাই ড্রাইভার কে বলল, গাড়িটা শপিং মলের দিকে নিয়ে যেতে।
রিতা আর মেহুল শপিং মলে ঢোকার পথেই কেউ একজন মেহুলকে ডেকে উঠে। মেহুল পেছনে ফিরে তাকায়। লোকটাকে তার খুব পরিচিত লাগছে। তবে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারছে না। লোকটা তার চোখের সানগ্লাসটা খুলে মেহুলের সামনে এসে দাঁড়াল। মুখে চওড়া হাসি টেনে বলল,
‘কী হলো, চিনতে পারেননি?’
এবারের মেহুলের মনে পড়ল। হেসে বলল,
‘আপনি সাদরাজ?’
‘জি।’
‘কেমন আছেন?’
‘আমি তো আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আপনার কী খবর? আর আপনার বাবা কেমন আছেন?’
‘আমি আর বাবা দুজনেই ভালো আছি।’
‘আপনাকে তো বলেছিলাম আপনার বাবার জ্ঞান ফিরলে আমাকে একবার জানানোর জন্য। কিন্তু, আপনি তো আর জানালেনই না।’
মেহুল অপ্রস্তুত হেসে বলে,
‘আসলে দুঃখিত, আমার না একদম খেয়াল ছিল না। স্যরি, প্লিজ কিছু মনে করব না।’
‘উম্ম, স্যরি টা এক্সেপ্ট করা যায় যদি আমার একটা কথা রাখুন।’
‘কী কথা?’
‘একসাথে বসে কি দু কাপ কফি খাওয়া যাবে?’
মেহুল রিতার দিকে চায়। রিতার চোখ মুখ কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। মেহুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। মুখের উপর না বলে দেওয়াটাও খারাপ দেখায়। সে ইতস্তত স্বরে বলল,
‘আসলে আমি আমার ফ্রেন্ড এর সাথে একটু শপিং এ এসেছিলাম। এখন কফি কী করে…’
‘সমস্যা নেই, আপনার ফ্রেন্ডকেও নিয়ে চলুন।’
মেহুল রিতার দিকে চেয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল সে রাজি কিনা। রিতা জবাব না দিয়ে আগের মতোই মুখ করে চেয়ে আছে। সাদরাজ আবারও প্রশ্ন করল,
‘কী হলো, কিছু বলছেন না যে?’
মেহুল উপায়ান্তর না পেয়ে বলল,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। চলুন।’
সাদরাজ হাসল। এই তো পাখি ধীরে ধীরে তার খাঁচায় পা দিচ্ছে। সে বলল,
‘ঠিক আছে। এখানেই দোতলায় একটা কফি শপ আছে; চলুন, সেটাতেই বসি।’
সাদরাজ হাঁটা ধরল। তার পেছন পেছন মেহুল আর রিতাও হাঁটছে। রিতা মেহুলকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এই লোকটা কে?’
‘ঐ যে বলেছিলাম না, একটা লোক বাবাকে রক্ত দিয়েছিলেন। উনিই তিনি।’
‘ওহহ।’
_______
কফি খেতে খেতে সাদরাজ বলল,
‘আন্টি ভালো আছেন?’
‘জি।’
‘আচ্ছা।’
সাদরাজ তারপর রিতার দিকে একবার চেয়ে মেহুলকে বলল,
‘আপনার ফ্রেন্ড এর সাথে তো পরিচয় করালেন না।’
মেহুল হেসে বলল,
‘ও রিতা, আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। আর রিতার কাছে আমি আপনার কথা আগেই বলেছিলাম।’
‘তাই! তা আপনার পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘ঐ তো চলছে কোনোরকম। সামনে আবার সেমিস্টার ফাইনাল, এখন তাই খুব চাপ চাচ্ছে।’
‘কোন ইয়ারে এখন আপনি?’
‘থার্ড ইয়ারে আছি। এবার এক্সামের পর ফোর্থ ইয়ারে উঠব।’
‘আচ্ছা। অনার্স শেষ করার পর কী করার ইচ্ছা?’
‘আপাতত, আমার গান নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা আছে। আর তারপর বাকিটা ভাগ্য।’
‘তাই? আপনি কি গান করেন?’
‘ঐ একটু আধটু ভার্সিটির ফাংশনে গাই আরকি।’
‘তাহলে তো আপনার গান একদিন শুনতে হয়।’
‘আমাদের পরীক্ষার পর ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম আছে, আমি সেখানে গান গাইব। আপনার আমন্ত্রণ রইল। এসে আমাদের ভার্সিটিও ঘুরে যাবেন আর আমার গানও শুনে যাবেন।’
‘তা তো অবশ্যই।’
সাদরাজ তারপর কফিটা শেষ করল। কিছুটা বিরতি নিয়ে বলল,
‘বিয়ে নিয়ে কী ভাবছেন?’
মেহুল ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘কার? আমার বিয়ে?’
‘জি।’
‘আমার বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে।’
সাদরাজ এমন একটা ভাব করল যেন সে কিছুই জানে না। সে অবাক হয়ে বলল,
‘ওমা! আপনি বিবাহিত?’
‘জি।’
‘আপনার হাজবেন্ড কী করেন?’
‘রাজনীতি।’
‘বাবা তাই! নাম কী উনার?’
‘আরিয়ান খান রাবীর।’
‘ওহহো, আপনি রাবীর খানের ওয়াইফ। আগে বলবেন না। আপনার হাজবেন্ড তো আমাদের এলাকার প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। আপনি তার ওয়াইফ, সেটা আগে জানলে তো আরো বেশি করে সমাদর করতে পারতাম।’
মেহুল বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। হালকা হেসে বলে,
‘না না, এভাবে ভাবার কিছু নেই। আমার হাজবেন্ড রাজনীতিবিদ বলে আমাকে আলাদা করে সমাদর দেখানোর কোনো দরকার নেই। আমি এসবে অভ্যস্ত না।’
‘সেটা অবশ্য আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি। আপনার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে তো এতক্ষণে অহংকারে মাটিতে পা’ই পড়তো না। আপনি অন্যরকম। রাবীর খানের কিন্তু খুব সৌভাগ্য, উনি আপনার মতো একজন মেয়েকে ওয়াইফ হিসেবে পেয়েছেন।’
‘আপনি কিন্তু এবার আমাকে অস্বস্তিতে ফেলছেন।’
সাদরাজ হাসে। বলে,
‘একদিন আপনার হাজবেন্ডের সাথেও বসে কফি খাওয়ার সুযোগ করে দিয়েন।’
‘অবশ্যই। আপনি বললে আমি এখনই কল দেই উনাকে।’
‘না না, উনি ব্যস্ত মানুষ। এমন হুট হাট করে কল দিয়ে উনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং অন্য
আরেকদিন কফি খাওয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে, ভাইয়া। আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। আজ আমরা উঠি, নয়তো বাসায় ফিরতে লেইট হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা, আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।’
মেহুল আর রিতা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। রিতা বাইরে এসে হেসে বলে,
‘আমার কি মনে হয় জানিস, লোকটা বোধ হয় কষ্ট পেয়েছেন।’
‘কেন?’
‘তুই যখন বললি, তুই বিবাহিত। তখন উনার চেহারাটা দেখার মতো ছিল। ইশ, বেচারা বোধ হয় তোকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছিলেন। আর তুই এক নিমিষেই উনার হৃদয়টাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিলি।’
‘বেশি বুঝিস না? একদিনের পরিচয়ে উনি আমাকে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছেন? সবাই তো তোর মতো, তাই না? আর তোর যদি উনার জন্য এতই মায়া হয়, তবে যা তুই’ই উনার গলায় ঝুলে পড়। তোদেরকে কিন্তু বেশ ভালো মানাবে।’
‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। ছেলেটা দেখতেও হেব্বি। কথা বলার স্টাইল ও সুন্দর। কী বলিস, একবার চান্স মেরে দেখব?’
মেহুল মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
‘আগে সামনে পরীক্ষায় কীভাবে পাস করবি সেই চিন্তা কর, বাকি সবকিছু পড়ে দেখা যাবে।’
________
মেহুল খাবার খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। রামিনা বেগম এসে তার পাশে বসেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করেন,
‘কালকে কি তোর কোনো ইম্পোরটেন্ট ক্লাস আছে?’
মেহুল টিভির দিকে চেয়েই জবাবে বলল,
‘হ্যাঁ মা, পরীক্ষার আগে সব ক্লাসই ইম্পোরটেন্ট।’
‘কালকে ক্লাস না করলে হয় না?’
মাত্রই মুখে লোকমা পুরেছিল মেহুল। সে ভরা মুখে মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
‘কেন?’
‘রাবীরদের বাড়ি থেকে আমাদের কালকে দুপুরে দাওয়াত দিয়েছে। তাই বলছিলাম, কালকে আর ক্লাস করার দরকার নেই।’
মেহুল মুখের খাবারটা শেষ করে বলল,
‘কিন্তু মা, এখন ক্লাস মিস করলে আমি অনেক সাজেশন পাবো না। তাছাড়া উনারা হঠাৎ করে আমাদের দাওয়াত কেন দিল?’
‘কালকে নাকি রাবীরের বাবার মৃত্যু বার্ষিকী। সেই উছিলায় উনাদের কিছু আত্মীয়স্বজন আসবেন। তাই সাথে আমাদেরও ডেকেছেন আরকি। আর তুই এত চিন্তা করছিস কেন? রিতা তো ক্লাস করবেই, ওর থেকে না হয় সব সাজেশন নিয়ে নিবি। তাহলেই তো হয়।’
‘তাও যেতে হবে আমাকে?’
‘হ্যাঁ, তুই ঐ বাড়ির বউ। তুই না গেলে কী করে হবে?’
মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। যাব।’
চলবে …