বেনেবউ #পর্ব_৩

0
395

#বেনেবউ
#পর্ব_৩
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– ‘মা একটু বসো তোমার সাথে আমার ছেলের পরিচয় করিয়ে দিই।’

ইপ্সিতা না করতে পারল না, চুপ করে বসে রইল। নিভ্রের মা নিভ্রকে ডেকে আনলেন,

– ‘বাবু চল একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো।’
– ‘কে?’
– ‘একটা মেয়ে, দেখতে পুরো পরীর মতো।’
– ‘আমি দেখে কি করবো? তুমিই দ্যাখো না।’
– ‘চল না।’

মায়ের জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিভ্র বসার ঘরে আসলো, সোফায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে নিভ্রের চোখ চকচক করে উঠল। এই তো সেই মেয়ে যাকে একপলক দেখার জন্য বারবার নীচে তলায় ঘোরাঘুরি করছে, বারবার কারন ছাড়াই ছাদে গিয়েছে কিন্তু দেখা পাইনি। আজকে নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে দেখা পাবে সেই আশা করেনি।

– ‘ইপ্সিতা মা এইটা আমার ছেলে নিভ্র।’

ইপ্সিতা চোখ তুলে তাকাল। ওর ধারনটাই সঠিক, সেইদিনের সেই ছাদের ছেলেটি। সেইদিন ছাদে ছেলেটির মুগ্ধ ভরা দৃষ্টি ইপ্সিতার চোখ এড়িয়ে যায়নি, তাই তো ছেলেটার মুখোমুখি হতে চাইনি কিন্তু আবারো মুখোমুখি হতে হলো। ইপ্সিতা চাই না ওর এই কলংকিত জীবনের সাথে কারোর জীবন জড়াতে। হ্যাঁ ইপ্সিতা যথেষ্ট সুন্দরী, একপলকের একটু দেখাতেই যে কারোর নজর কাড়তে সক্ষম কিন্তু ইপ্সিতা এই রূপকে ঘৃ’না করে এই রূপই ওর সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে। ইপ্সিতা যদি পারত এই রূপকে ঝলসে দিতে তবেই মনের রাগ মিটতো কিন্তু পারেনি সমাজের মানুষদের হাজারো কুকথা শুনে নিজেকে শেষ করে দিতে। অনেকবার চেষ্টা করেছিল সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে কিন্তু পরকাল আর বাবা মায়ের কথা চিন্তা করে বারবার পিছিয়ে এসেছে। শক্ত হয়েছে, মনে সাহস জুগিয়েছে, ওহ তো কোনো অপরাধ করেনি তাহলে কেন শা’স্তি পাবে। যারা অন্যায় করেছে শা’স্তি তো তাদের পাওয়া উচিত।

নিভ্র আবারো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ইপ্সিতার পরনের লাইট পিংক সালোয়ার কামিজটা ওর সৌন্দর্যকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, নিভ্র চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। ইপ্সিতার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে, সেই ঘটনার পর থেকে কোনো পুরুষ দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না ভয় করে প্রচন্ড।

– ‘আন্টি আমি আসছি, পরে আসবো একদিন।’

ইপ্সিতা হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায়। নিভ্রের মা বললেন,
– ‘যা মেয়েটা চলে গেল। দেখেছিস বাবা মেয়েটা কি মিষ্টি দেখতে।’

নিভ্রের মায়ের ইপ্সিতাকে প্রচন্ড রকমের পছন্দ হয়েছে। মেয়েটার কথাবার্তাও খুব ভালো, দেখতেও সুন্দরী এইরকম একটা মেয়েই নিভ্রের জন্য খুঁজ ছিলেন।

রাতে,

ইপ্সিতা অনেকদিন পর ফেসবুকে অন হলো, কয়েকদিন বাড়ি বদলের জন্য ফোনেই হাত দেওয়া হয়ে উঠেনি। মেসেঞ্জার অন করতেই একটা মানুষের মেসেজ দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল, এই ভার্চুয়াল জগতের ইপ্সিতার সবথেকে কাছের মানুষ। উনি ইপ্সিতার জীবনের মোটামুটি সবকিছুই ওনার জানা। সত্যি বলতে গেলে ওনার কারনেই ইপ্সিতা ঘুরে দাঁড়াতে সাহস পেয়েছে।

ইপ্সিতা সালাম দিয়ে মেসেজ দিলো,
– ‘কেমন আছেন।’

সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ সিন হলো, রিপ্লাই ওহ আসলো,
– ‘এই তো ভালোই আছি, আপনি কেমন আছেন।’
– ‘আছি ভালোই।’
– ‘দুইদিন কোথায় ছিলেন?’
– ‘একটু কাজ ছিল তাই।’
– ‘আচ্ছা বুঝতেই পারছি বিজি মানুষ।’
– ‘না সেইরকম কিছুই না।’

কথপোকথন চলতেই থাকল। ইপ্সিতার ভারাক্রান্ত মনটা নিমিষেই ভালো হয়ে গেল, অপর প্রান্তের মানুষটি একজন ছেলে জানা সত্ত্বেও তার সাথে কথা বলতে ইপ্সিতার বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ হয় না। গত এক বছরে মানুষটির সাথে সমস্ত কিছু শেয়ার করেছে, মানুষটি সমস্ত কিছুতেই ইপ্সিতাকে সার্পোট দিয়েছে।

– ‘আপনি খুব ভালো নয়ন। আপনার লাইফ পার্টনার খুব লাকি।’
– ‘তাই বুঝি।’
– ‘হুমম।’

মেসেজ করতে করতে ইপ্সিতা ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

পরেরদিন,

ইপ্সিতা দুইদিন বাড়ির বাইরে বের না হলেও আজ থেকে বের হতে হবে। কিছু কাজ আছে সেইগুলো তো করতে হবে।

– ‘মা আমি বের হচ্ছি।’
– ‘কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
– ‘একটু কাজ আছে। আসছি।’

ইপ্সিতা বেড়িয়ে যায়। পরনে সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়না দেওয়া আর মুখে মাস্ক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয় তারপরেই মেনরাস্তা আর ওইখান থেকে গাড়ি ধরতে হয়।

ইপ্সিতা হাঁটছে তখনি একজন মহিলা আরেকজন মহিলাকে বলল
– ‘ওই দ্যাখো সেই মেয়েটা যাচ্ছে‌। বলি হারি মেয়ের সাহস।’

ইপ্সিতা কথাগুলো কান না দিয়ে নিজের মতো হেঁটে চলেছে। আরেকজন মহিলা বলল,
– ‘এতবড়ো একটা ঘটনা ঘটলো তবুও মেয়ের দেমাগ কমলো না।’

ইপ্সিতা দাঁড়িয়ে গেল। পিছন ফিরে কিছুটা এগিয়ে এসে মহিলা দুটোর সামনে দাঁড়িয়ে মাস্কটা খুলে বলল,
– ‘বলছি আন্টি আঙ্কেল কি জানে আপনি সারাদিন কূটনামী করে বেড়ান।’
– ‘এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বলুন।’
– ‘অনেক তো চুপ করে থাকলাম এইবার তো কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। কি বলছিলেন আমার দেমাগ কমেনি সত্যিই আমার দেমাগ কমেনি কেন জানেন? কারন আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমি ইচ্ছা করে নিজের সর্বনাশ করিনি।’
– ‘করো আর না করো সত্যি তো এটাই তুমি ধ’র্ষি’তা।’
– ‘আমাদের সমাজটা কি অদ্ভুত তাই না। একটা মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করলেই সেটা ধর্ষন সমাজের চোখে সে খারাপ। অথচ সেই মেয়েটাই যদি নিজের ইচ্ছায় কোনো ছেলের সাথে বিছানা শেয়ার করে কই তখন তো আমরা মেয়েটাকে কিছু বলিনা। আন্টি অন্যের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকটা একটু ভালো করে দেখে নেবেন, আপনার ছেলেমেয়েরা বাইরে পড়াশোনা করার নাম করে কি করে বেড়াচ্ছে সেটা কারোরই অজানা নয়। আপনি যেমন আমাকে কথা শোনাচ্ছেন, আমার নামে লোকের কাছে বদনাম করে বেড়াচ্ছেন ঠিক তেমনি আরেকজনও আপনার নামে আপনার সন্তানদের নামে বদনাম করে বেড়াচ্ছে। তাই কারোর নিন্দা না করে নিজের সংসার, সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখুন ভবিষ্যতে আপনারই লাভ হবে। আসি কেমন।’

ইপ্সিতা মুখে মাস্ক পড়তে পড়তে চলে যায়। ভদ্রমহিলাটির চোখে পানি চলে এসেছে, ইপ্সিতার একটা কথাও মিথ্যা নয়। আমরা সবাই জানি অন্যের নিন্দা করা কতটা খারাপ জিনিস তারপরেও আমরা সঙ্গদোষে করে ফেলি।

ইপ্সিতা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে, নিভ্র ওর পাশে দাঁড়ালো। তখনও দুজন দুজনকে খেয়াল করেনি। নিভ্র বিরক্ত হয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছে, বাইকটা সার্ভিসে দিয়েছে নাহলে রাস্তায় এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।

ইপ্সিতা রোদে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘেমে লাল হয়ে যাচ্ছে, বিরক্ত হয়ে মুখের মাস্কটা খুলে ফেলল। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে অনেকক্ষণ থেকেই ইপ্সিতার দিকে তাকিয়ে ছিল মুখটা খুলতেই বলল,

– ‘দেখেছিস পাখি আমাদের দেখানোর মাস্কটা খূলে দিয়েছে। জোস্ দেখতে কিন্তু বস।’

ছেলেগুলোর এইরকম মন্তব্য শুনে নিভ্র পাশে মেয়েটির দিকে তাকায়, ইপ্সিতার ফর্সা মুখটা রাগ না রোদের তাপে লাল হয়ে আছে সেটা বুঝতে পারল না। ছেলেগুলো রাস্তা বেড়িয়ে এসে ইপ্সিতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

– ‘কি মামনি একরাত কাটাবে নাকি?’

কথাটা শুনে নিভ্রের রাগ আকাশ ছোঁয়া, হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে ছেলেগুলোকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই,

#চলবে…

সকলে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

আসসালামু আলাইকুম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here