#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১১)
রকিং চেয়ার দুলছে। অন্ধকার ঘরটায় শুধুই অভিরাজের বাস। বাড়ির সকলের থেকে বেশ দূরে থাকে সে। পরিবার বলতে মা বাবা ছোট বোন আর লাবণ্য। কিছু বছর পূর্বেই লাবণ্য’র মা বাবা সহ তার ছোট ভাই আলাদা হয়ে গেছে। আলাদা হয়ে গেছে ছোট কাকাও। তাদের যৌথ পরিবারটা কেমন যেন হয়ে আছে। এসব ভাবলে লাবণ্য’র কষ্ট হয়। এ পরিবারটা বরাবরই হাসি খুশি ছিল। অথচ একটা ঝড় সব তছনছ করে দিল। অভি’র ঘুমে ভেজা মুখের পানে তাকিয়ে লাবণ্য’র ঠোঁট কম্পিত হলো। শুষ্ক মলিন হয়ে যাওয়া চেহারাটা বড়ো মন কাড়ছে। অথচ এই মানুষটাকে ছোঁয়ার সাধ্য নেই তার। এত আপন হয়েও ছেলেটা বড়ো পর হয়ে গেছে ওর। লাবণ্য নিজেকে অভাগা ভাবতে গিয়েও ভাবে না। অভিরাজের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগল। ছেলেটা ঘুম থেকে জেগে বলল,”সকাল হয়ে গেছে লাবন্য?”
“এখন তো সন্ধ্যা অভি।”
“অহ,কখন ঘুমালাম কে জানে।”
“উঠ। খাবার নিয়ে এসেছি।”
“তুই তো জানিস এই সময়ে আমি খাই না।”
“কোন সময়ে খাস অভি? পুরো দিন না খেয়েই তো থাকিস। মানুষ তুই, জড়বস্তু তো না যে ক্ষিধে পাবে না।”
“সত্যিই ক্ষিধে নেই লাবণ্য। খাবার গুলো নষ্ট হবে।”
“হা কর। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
“সবার মতো তুই ও কি ভাবিস উষশী আর কখনো আমার কাছে ফিরবে না?”
“দেখ অভি পাঁচটা বছর চলে গেছে। এতদিনেও যে আসে নি তার আসার কথা ভেবে লাভ আছে আদৌ?”
“হয়ত আছে কিংবা নেই।”
“উঠ। মুখ ধুয়ে আয়। খাইয়ে দিচ্ছি।”
প্রচন্ড ভার হয়ে যাওয়া শরীরটাকে নিয়ে উঠল অভিরাজ। তার কণ্ঠে আজকাল রুগ্নতার ভাব। শরীরে বয়সের ছাপ। অথচ এতদিন এমন ছিল না। ছেলেটা মুহূর্তেই কেমন হয়ে যাচ্ছে। অজানা এক ভয় লাবণ্য’র শরীরকে নাড়িয়ে দিল।
অতীত
উষশী নিজ বাড়ির সামনে এসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার দুটি নয়নে অশ্রুকণা চিকচিক করছে। ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করল সে। অভি আর লাবণ্য একে অপরের দিকে চাইল একবার। উষশী ভেতরে গিয়ে আম্মু আম্মু করে ডাকতে লাগল। কিন্তু সাড়া নেই। লাবণ্য এগিয়ে এসে জাপটে ধরল ছোট্ট মেয়েটিকে।
“বাবু শান্ত হও। তোমার আম্মুকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাব আমরা।”
উষশী’র ভেতরটা পাগলের মতো ছুটোছুটি করছে। মেয়েটির শরীর ঘামে সিক্ত হয়ে উঠেছে। অভিরাজ নিজের রুমাল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিল।
“সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আম্মু নেই কেন?”
“হয়ত তোমাকে খুঁজে চলেছে।”
গুমোট কান্নাটা গিলে ফেলল উষশী। এই মুহূর্তে সে কান্না করতে চায়। অথচ একটা সংকোচ বোধ হচ্ছে। তার উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া পেল অভি। হাত সরিয়ে নীল নরম তুলতুলে গাল থেকে।
“আমাদের যেতে হবে। এখানে থাকলে ও আরো ভেঙে পড়বে।”
যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়িটা দেখা যায় তাকিয়ে রইল উষশী। দৃষ্টি সীমানার বাইরে আসতেই সিটে মাথা এলিয়ে দিল সে। কোকো একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে। তার লোমশ শরীরে হাত বুলিয়ে দিল লাবণ্য। উষশী’র মস্তিষ্ক রিক্ত হতে শুরু করেছে। কি থেকে কি হয়ে গেল।
রাতের খাবার খেল না উষশী। কেউ তাকে জোর অবধি করল না। ওরা বুঝতে পারছিল মেয়েটার একা থাকা প্রয়োজন। তাই কোকো কে সাথে নিয়ে এসেছে অভি। খাবার খাচ্ছে ছোট্ট প্রানীটা। লাবণ্য কখন রুমে এসে দাঁড়িয়েছে জানা নেই। অভির দৃষ্টি জানালা গলিয়ে বিশাল অন্তরিক্ষে।
“একটা কথা বলার ছিল।”
“বল।”
“বড়ো আব্বু কিছুদিনের মধ্যেই এখানে আসবেন।”
“কেন?”
“তোকে নিয়ে যেতে।”
“বলে দে যাব না। এসে লাভ নেই।”
“তবু আসবে।”
“আসুক।”
“কিন্তু উষশী, ওর বিষয়ে কি বলবি?”
“জানি না।”
“অভি, এভাবে ছন্নছাড়া উত্তর কেন দিচ্ছিস?”
“ভালো লাগছে না লাবণ্য। মেয়েটার ভেঙে যাওয়া মুখ দেখলেই আমার কেমন লাগে। কোথায় হারিয়ে গেল ওর পরিবার?”
“বুঝতে পারছি না আমিও। পাসপোর্টের ইনফর্মেশন দিয়েও বিশেষ লাভ হচ্ছে না। এদিকে পুলিশেও ইনফর্ম করা যাচ্ছে না। মেয়েটার কোনো শত্রু থেকে থাকলে ক্ষতি হতে পারে। নানান ঝামেলা।”
একদমই শান্ত হয়ে গেল অভিরাজ। তার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে শীতল ঘামের রেখা। সে আসলেই বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ। উষশী’র ব্যাপারে কিছু ভাবতে গেলেই মস্তিষ্ক উলোট পালোট হয়ে যায়। মেয়েটাকে ছাড়ার কথা দু দন্ড ভাবতে পারে না। সে খুব করে বুঝতে পারল সামনের দিন গুলোতে বেশ ভুগতে হবে।
অদ্ভুতভাবে অভিরাজের বাবা আসাদ সিনহা দুদিন পরই হাজির হলেন। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। অভি বাড়ি নেই। হসপিটালে গিয়েছে। এদিকে ঘুমিয়ে আছে উষশী। সে কি করে সামাল দিবে বুঝতে পারছে না।
“ভালো আছিস মা?”
“জী বড়ো আব্বু। তুমি আজই এলে যে।”
“বাঁদর ছেলের বাবা হলে বড়ো যন্ত্রণা। সেই জন্যেই দুদিন আগে চলে এসেছি।”
“গত রাতে আমাকে তো কেউ বলল না।”
“বাড়িতেও জানাই নি। সরাসরি এখানে চলে এসেছি।”
“তুমি বসো,আমি শরবত করে দিচ্ছি।”
“বুয়া আসে নি এখনো?”
“না বড়ো আব্বু। সে অসুস্থ। দারোয়ান কাকার বউ ই রান্না করে দেন।”
আসাদ আরাম করে সোফায় বসলেন। এসির পাওয়ার আগে থেকেই বাড়ানো ছিল। লাবণ্য ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল। ভদ্রলোক বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেললেন। এই বাড়িটা ওনার বেশ পছন্দের। বেশ টাকা খরচ করেছেন তিনি।
“নাস্তা করবে তো?”
“পেট ভরা। একে বারে বাসায় ফিরে লাঞ্চ করব। অভি কোথায়?”
“ও তো হসপিটালে আছে।”
“তোর ইন্টার্নশিপ নেই আজ?”
“সন্ধ্যা থেকে বড়ো আব্বু।”
“কিন্তু এমন তো টাইম ছিল না। বিকেলের আগেই তোর ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার কথা।”
লাবণ্য শুকনো ঢোক গিলল। মেয়েটার শ্বাস কেমন ভারী হয়ে এল। তীক্ষ্ণ চোখের আসাদ সাহেব মুহূর্তেই যেন বুঝতে পারলেন।
“কিছু সমস্যা হয়েছে?”
“না বড়ো আব্বু।”
“এভাবে ঘামছিস কেন?”
“না মানে।”
“লুকানোর মতো কিছু তো নেই মা। এত অস্বস্তির কি আছে?”
লাবণ্য’র হৃদয় কম্পিত হচ্ছে। এরই মাঝে উষশী উঠে গেছে। মেয়েটি নজরে আসতেই আসাদ সাহেবের ভ্রু দ্বয় কুচকে গেল। তিনি প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে লাবণ্য’র দিকে তাকালেন। সমানে ঘামছে লাবণ্য।
“আপু,কোকোর ক্ষিধে পেয়েছে।”
লাবণ্য কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। সে কিছু বলছে না দেখে পাশে তাকাল উষশী। লম্বা চওড়া ফর্সা দেহের মানুষটা অনেকটাই অভিরাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সে তখনো কিছু বুঝতে পারছে না। আসাদ সাহেব শান্ত,ধীর কণ্ঠে বললেন, “ও কে?”
“বড়ো আব্বু ও হচ্ছে।”
“কেমন আছ আব্বু?”
ঠিক সময়ে এসেছে অভিরাজ। লাবণ্য যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ছেলেটা ম্যাসেজ পেয়ে এক সেকেন্ড লেট করেনি। মাঝ রাস্তা থেকেই ইউ টার্ন নিয়ে চলে এসেছে।
“উষশী,তুমি ঘরে যাও। কোকোর জন্য খাবার পাঠাচ্ছি।”
ভদ্র বাচ্চার মতো চলে গেল উষশী। লাবণ্য ইশারায় কিছু বলে যাচ্ছে। অভি সামলাতে পারবে বলে জানাল।
“মেয়েটা কে অভি?”
আগে থেকেই সব ভেবে রেখেছিল অভিরাজ। সে পুরো ঘটনাটা বলতেই আসাদ সাহেব বললেন, “তোমরা পুলিশে কেন ইনফর্ম করলে না?”
“আব্বু ও ভীনদেশী। নিজের বিষয়ে খুব একটা বলতেও পারল না। যদি কোনো শত্রু থেকে থাকে।”
“পুলিশকে ইনফর্ম করা উচিৎ ছিল। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ হয় নি। যদি মেয়েটা কোনো দূর্ঘটনার কারণ হয়।”
“উষশী এমন নয় বাবা। পনেরো বছর বয়সী একটা বাচ্চা। ও কি করে আততায়ী হয়?”
আসাদ ছেলের পানে তাকালেন। অভি’র দৃষ্টিতে বিরক্তি। তিনি বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না।
“শোনো,ছোঁয়াকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। খুব দ্রুতই বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে। তাই আজই আমার সাথে ফিরবে তোমরা।”
“আমি এখন ফিরতে পারব না আব্বু।”
“ফিরতে হবে।”
“জোর করলেই সব হয়না আব্বু। যাব না মানে যাব না।”
“তোমার সমস্যা কোথায় অভি?”
“জানি না। তবে এটাই ফাইনাল।”
ছেলের হনহনিয়ে চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ভদ্রলোক। বরাবরই তার ছেলে জেদি প্রকৃতির। তবে লাবণ্য এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে এল। বলল,”তুমি বসো। আমি ওকে বোঝাচ্ছি বড়ো আব্বু।”
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি