#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অভ্রের কক্ষে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল আরাভ। সমস্ত মুখশ্রীতে তার চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এই প্রথম আরাভ নিজ থেকে অভ্রের কক্ষে আসলো। ছেলেটাকে আগে কখনো এতটা অস্থির হতে দেখেনি সে। ভাইয়ের এমন অস্থিরতায় অবাক না হয়ে পারছে না অভ্র। হয়তো ছেলেটা বাহিরে কঠিন। ভেতরটা কুসুমের ন্যায় কোমল। সে হয়তো আমাকে আড়ালে থেকেই ভালোবাসে। কখনো জানতে দেয় নাই। এই হাহাকারের মাঝে-ও ভাইয়ের এমন ভালোবাসা, এক টুকরো মানসিক শান্তি এনে দিল। আরাভ অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলো,
–ভাইয়া এই দেখো এটা স্রুতি আপুর হবু স্বামী। আমেরিকায় থাকে। দু’টো বিয়েও করেছে। প্রথম বউ মারা গিয়েছে। দ্বিতীয় বউয়ের দু’টো বাচ্চা আছে। উনার দ্বিতীয় স্ত্রী জানেনই না। তার স্বামী বাংলাদেশে বিয়ে করতে এসেছে। এখনো সময় আছে। তুমি চাইলেই বিয়েটা ভেঙে দিতে পারো। আরাভের কথা শুনে বিস্ময় নয়নে আরাভের দিকে তাকালো অভ্র। কণ্ঠে গম্ভীরতা ভাব বজায় রেখে বলল,
–তুই এতকিছু জানিস কিভাবে? তুই যে কথা গুলো বলছিস? তার সত্য তা কতটুকু? আমি কিভাবে তোকে বিশ্বাস করবো? ভাইয়ের কথা শুনে আরাভ নিজের ফোনটা ভাইয়ের হাতে তুলে দিল। তারপরে বিষন্ন কণ্ঠে বলে উঠলো,
–এখানে সব প্রমাণ আছে। তুমি এটা নিয়ে যাও। আর একটা কথা। তুমি স্রুতি আপুকে বিয়ে করবে। এ কথা বলতে যেও না। একটা মেয়েকে পাওয়ার জন্য নিজেকে এতটা ছোট করে দিও না। যেখানে বাবাকে অসন্মান করা হয়েছে। আমি চাই তারা নিজ থেকে বলুক। স্রুতি আপুর সাথে তোমার বিয়ে দিবে। আপাতত স্রুতি আপুর বিয়েটা ভাঙা প্রয়োজন। অভ্র কিছু বলল না। নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।
স্রুতিদের বাসায় আনন্দের রেশ ঘিরে ধরেছে। বাচ্চারা চারিদিকে ছুটোছুটি করছে। লোকসংখ্যা খুবই কম। কাছের দু’চারজন ছাড়া কেউ নেই। স্রুতিকে একটা লাল রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। কি স্নিগ্ধ আর মনোমুগ্ধকর লাগছে স্রুতিকে।এ দু’নয়ন যেন থমকে যায়। সময় যেন থেমে যায়। এই মুহুর্ত সারাজীবনের থেকে যাক। অভ্রের বিষন্নতা মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল। অজানা কারণে অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। একটা সুদর্শন যুবকের পাশে স্রুতিকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। কথাটা খেয়াল হতেই বিষাক্ত হয়ে উঠলো হৃদয়। ধীরে পায়ে সবার দিকে এগিয়ে গেল অভ্র। অভ্রকে দেখে সবার মনে ভয়ের দানা বাঁধলো। অভ্র যদি কোনো ভুলভাল কিছু করে বসে। অভ্র সবাইকে অবাক করে দিয়ে, স্রুতির হবু স্বামী ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–ফাহিম আপনার স্ত্রী আপনার সাথে কথা বলতে চায়। কাল রাত থেকে আপনাদের ফোনে পাচ্ছে না। তিনি আপনাদের জন্য চিন্তিত। উনার সাথে কথা বলে, উনাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন। আপনি আরেকটা বিয়ে করতে এসেছেন? এটা আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী জানেন? যদি না জেনে থাকে, তাহলে তাকে বরন ডালা নিয়ে অপেক্ষা করতে বলবেন। যত্ন সহকারে নিজের সতীনকে বরন করে নিবে। অভ্রের কথায় পুরো পরিবেশ শীতল হয়ে উঠলো। সবাই অভ্ররের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহিম ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। অভ্রকে খু’ন’ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার। এই শুভ কাজে এসে বাঁধা না দিলেই নয়। আবিদ রহমান রাগান্বিত হয়ে, অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–সব জায়গায় বেয়াদবি একদম চলে না অভ্র। তুমি নিজে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে পারছো না বলে, অন্য কারো সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হতে দিবে না। এটা কেমন ধরনের ভদ্রতা। নির্ঘাত তোমার বাবা একজন ভালোমানুষ। তার কথা ভেবে এখনো তোমার সাথে কথা বলে যাচ্ছি। তুমি অন্য মেয়েকে ভালোবাসবে। সে কথা আবার আমার মেয়েকে ডেকে বলবে, এমন কথা শোনার পরে কোন মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে বলতো?
–আংকেল আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি আমার করা ভুলের জন্য আপনার মেয়ের কাছে হাজার বার মাফ চেয়েছি। আপনি তার থেকে শুনুন? তার পা দু’টি ধরা বাকি রেখেছি। আমাকে এতটাও খারাপ ভাববেন না আংকেল। আমি নিজ থেকে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। তাই বলে আপনার মেয়ের খারাপ চাইবো। এতটা নিকৃষ্ট মনের মানুষ আমি না। আমি সত্যি কথা বলছি। আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস না করেন। তাহলে আমি ফাহিমের স্ত্রীর সাথে, আপনাদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবো। অভ্ররের কথায় জ্বলে উঠলো স্রুতি। বজ্রকণ্ঠে বলে উঠলো,
–আপনি যদি ভেবে থাকেন। এসব করলে আমি গলে যাব। নৃত্য করতে করতে আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব। এটা যদি ভেবে থাকেন। তাহলে আপনার ধারনা ভুল। আমি বিয়ে করলে ফাহিমকেই করবো। তাই ফাহিমের নামে মিথ্যা কথা বলে লাভ নেই। বিয়ে বাড়িতে এসেছেন। পেট ভরে খেয়ে যাবেন। স্রুতির কথায় অভ্র তাচ্ছিল্য করে বলল,
–তোমাকে কে বলেছে? আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য বিয়ে ভাঙতে এসেছি। নিজেকে কি মনে করো? নিজেকে কখনো আয়নায় দেখেছো? এই বিয়ে ভেঙে গেলে-ও আমি তোমাকে বিয়ে করবো না। আমি একটা মেয়ের সংসার বাঁচাতে এসেছি। একটা বোনের আর্তনাদ আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাই ছুটে এসেছি। ফাহিমের বাচ্চা দু’টোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। মায়ায় পড়ে যাবে। এত সুন্দর বউ বাচ্চা রেখে, তোমার মতো ক্যাঙ্গারুকে কেনো বিয়ে করেছে? সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। তোমার বিয়ে করার এত তাড়া আগে বললেই পারতে? আমি নিজে তোমার জন্য ভালো ছেলে দেখে দিতাম। শুধু শুধু একটা মেয়ের সংসার ভাঙছো কেনো? তুমি যদি সতীন নিয়ে সংসার করতে পারো। তাহলে আমারও কোনো আপত্তি নেই। তোমাদের দুই সতীনের চুল ছেঁড়াছিঁড়ি দেখতে। অভ্রের কথায় স্রুতির মুখশ্রী অপমানে, লজ্জায় চুপসে গেল। অভ্র নিজের ফোনটা বের করে আবিদ রহমানের সাথে ধরলো। সাথে সাথে ফোনের স্ক্রীনে একটি সুন্দরী রমণীর ও দু’টি ফুটফুটে বাচ্চার ছবি ভেসে উঠলো। স্রুতির বাবা মেয়েকে যা যা বলল। মেয়েটি নিষ্ঠার সাথে জবাব দিল। চিন্তায় মেয়েটির মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আঁখি জোড়া বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। ফাহিমকে নিয়ে সে খুবই সিরিয়াস। তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটির সাথে কথা বলে আবিদ রহমানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো। ধীর পায়ে ফাহিমের দিকে এগিয়ে গেল। মুখশ্রীতে কাঠিন্যতা বজায় রেখে, বজ্রকণ্ঠ বলে উঠলো,
–তোমার যে ঘরে বউ আছে? সে কথা আমাদের জানাওনি কেনো? দ্বিতীয় বিয়ে করার আগে, বাচ্চা দু’টোর মুখ তোমার সাথে ভেসে উঠলো না। আমাদের সাথে কেনো বেইমানি করলে? আমার প্রশ্নের জবাব না দেওয়া পর্যন্ত, এক পা এখানে থেকে নড়তে পারবে না। এবার ফাহিম চুপ থাকতে পারলো না। সোজাসাপটা উত্তর দিল,
–কেনো স্রুতির মামা আপনাদের সবকিছু জানায়নি? উনি তো সবকিছু জানেন? আমার প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছে। আমার দ্বিতীয় স্ত্রীকে আমি অনেক ভালোবাসি। তাকে দেখাশোনা করার জন্যই আমাদের একটা কাজের লোকের প্রয়োজন। আপনার মেয়েকে এমনি এমনি নিয়ে যেতে পারবো না। তাই বিয়ে করে নিয়ে যেতে চেয়ে ছিলাম। এখানে আমার কোনো দোষ নেই। ফাহিমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে, ফাহিমের গালে সজোরে ক’ষে’ প্রহার করল স্রুতির বাবা। ক্রোধে শরীরের শিরা-উপশিরা কাঁপছে তার। তার এত আদরের প্রান প্রিয় মেয়েকে কাজের জন্য বিয়ে করছে। ভাবতেই পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হাসোজ্জল পরিবেশটা মুহুর্তের মধ্যে বিষাদের স্বাদ গ্রহণ করল। অভ্র কিছু না বলে, নিঃশব্দে স্রুতিদের বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়েছে। স্রুতির মামা আগেই পালিয়েছে। ফাহিমদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবিদ রহমান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। এবার মনে হয় তিনি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণই করে ফেলবে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না। স্রুতি বাকরুদ্ধ হয়ে সোফায় বসে আছে। সবাই কানাঘুঁষা শুরু করে দিয়েছে। এসব যেন স্রুতি নিতে পারছে না। স্রুতিকে নিয়ে কেউ কিছু বললে, স্মৃতি তাকে কড়া কথা শুনিয়ে দিচ্ছে। স্রুতির বাবা কোনো কথা না বলে, বাসা থেকে বের হয়ে গেল। স্মৃতি ভয়ে বাবার পিছু পিছু গেল। চিন্তিত হয়ে বাবা যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। কিন্তু স্মৃতি যা দেখলো? তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। স্রুতির বাবা রহমান শেখের বাসায় প্রবেশ করল। আবিদ রহমানকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে, রহমান শেখ অস্থির হয়ে আবিদ রহমানের দিকে এগিয়ে আসলো। অস্থির কণ্ঠে বলল,
–ভাই আপনার কি হয়েছে? আপনাকে এমন বিধস্ত দেখাচ্ছে কেনো? আবিদ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
–আপনাদের দীর্ঘশ্বাস লেগেছে ভাই। আপনাদের কষ্ট দিয়ে, মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আল্লাহ আমাকে তার শাস্তি দিয়েছে। আমি আপনাদের কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি। তবে আজকে কথা রাখতে এসেছি। যদি বলেন আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙেছে বলে, আপনার কাছে এসেছি। তাহলে আপনার ধারনা ভুল। আপনার ছেলে আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। আপনার ছেলেকেই আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। আপনার ছেলে কোথায়? ডাকুন তাকে। আমার মেয়েকে বিয়ের করার জন্য এতকিছু করল। এখন বিয়ে ভেঙে দিয়ে এসে, পালিয়ে আছে কেনো? খুব তো সবার সামনে বলে আসলো। ভালো ছেলে খুঁজে দিবে। আবিদ রহমানের কথায় রহমান শেখের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। তার মনে হচ্ছে এই প্রথম তার ছেলে একটা ভালো কাজ করেছে। সে অভ্রের কক্ষে গিয়ে অভ্রকে ডেকে দিয়ে আসলো। আবিদ রহমানকে দেখে মাথা নুইয়ে নিল। আবিদ রহমান কোনো কথা না বলে, অভ্রের হাত ধরে দরজার দিকে যেতে লাগলো। অভ্র শান্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আংকেল?
–শশুর বাড়ি। যাবে?
–হ্যাঁ যাব। কিন্তু আমার তো বিয়ে হয় নাই? কথা গুলো বলেই জিভে কামড় দিল অভ্র। আবিদ রহমান গম্ভীর মুখ করে আছেন। অভ্রকে স্রুতিদের বাসায় নিয়ে আসা হলো। রোকেয়া বেগম ঘুৃমিয়ে ছিল। ড্রয়িং রুমে এসে, স্বামীকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল তার। সে ঘুম জাড়ানো কণ্ঠে বলে উঠলো,
–তুমি এভাবে হাসছো কেনো? বুড়ো বয়সে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। রোকেয়া বেগমের কথা শুনে উচ্চ স্বরে হেসে দিলেন রহমান শেখ। হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বললেন,
–তোমার ছেলের বউ আসছে। সুন্দর করে বাসাটা সাজিয়ে ফেলো। কথা গুলো বলেই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। বাবার মুখে প্রশান্তির হাসে দেখে, পর্দার আড়ালে কারো হৃদয় হয়ে উঠলো শীতল। সে দূর থেকেই বাবা-মায়ের হাসোজ্জল মুখখানা দেখতে চায়। বাহিরে আসার প্রয়োজন বোধ করল না সে। দরজার আড়াল থেকেই নিজের কক্ষের মধ্যে চলে গেল।
আবিদ রহমানের পাশে অভ্র বসে আছে। স্রুতি আঁড়চোখে অভ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করল। অভ্র ভুল করলে-ও স্রুতির দিকে দৃষ্টিপাত করেনি। আবিদ রহমান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো। অভ্রের সাথে স্রুতির বিয়ে হবে। স্রুতির কেন জানি কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। সে এই অল্প বয়সে বড্ড ক্লান্ত। নিজের সুখের কথা ভেবে বাবার মুখের ওপরে কথা বলা উচিৎ হবে না। তাই সে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। স্মৃতির মুখে তৃপ্তির হাসি। অভ্র আর স্মৃতি দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসলো। স্রুতি ভ্রু কুঁচকে স্মৃতি দিকে তাকালো। অভ্র নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আবিদ রহমানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–শুনেন আংকেল আপনি আমাকে শশুর বাড়ি নিয়ে এসেছেন। তাই আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। না হলে আপনার মেয়ের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। অভ্রের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। স্রুতি রাগান্বিত হয়ে অভ্রের দিকে তাকালো।
চলবে…..