#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১৩ (শেষ)
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
ঘরের সকলে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে ক্লিওপেট্রার কথা শুনছে।
ক্লিওপেট্রা বলতে লাগল, ‘মাত্র ছয়দিন হল অ্যানি বিড়াল থেকে মানুষরূপে ফিরেছে। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আহান মানুষরূপে ফেরার পর বিড়াল জীবনের কথা ওর কিছু মনে থাকবে না? এটা সঠিক ছিল। ওর কিছুই মনে ছিল না সেসব কথা। ও যেদিন প্রথম মনুষ্য রূপে ফেরে সেদিন তুমি অফিসে ছিলে। অহনা কলেজে ছিল। একমাত্র মা বাসায় ছিল। ক্বাহাফ অনেক কান্নাকাটি করছিল বলে মা আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যায় ঘুম পারানোর জন্য। আমি নিজের ঘরে কাপড়চোপড় ভাজ করছিলাম। হঠাৎ বিড়াল মিথি দৌড়ে এসে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে। বের হয় মনুষ্যরূপে অ্যানি হয়ে। আমাকে দেখে ও একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। ও কোথায়, এ বাড়িতে কীভাবে এল, আমি এখানে কী করছি।
আমেরিকা থাকতে আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার পর অ্যানি শওকত চৌধুরীর পরিবারের লোকদের খুঁজতে থাকে। ওই লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং সে ঘরের দুই ছেলেকে অ্যানি মেরে ফেলে। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি জানলে ওকে আটকাবার চেষ্টা করব বলে ও আমাকে কিছুই জানায় নি। অ্যানি কীভাবে যেন জানতে পেরে যায় শওকত চৌধুরীর অতীতে আরেক স্ত্রী ছিল এবং সে ঘরে সন্তানও আছে। তাই ও প্রতিশোধ নেবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে। ভাগ্য ভালো ছিল আমি জানতে পেরে যাই অ্যানি নিষ্পাপ মানুষদের খুন করছে। আমি অ্যানিকে বোঝানোর চেষ্টা করি শওকত চৌধুরী, এলেক্সা আমাদের ক্ষতি করেছে। ওদের পরিবারের কেউ তো করেনি তাহলে আমরা তাঁদের কেন ক্ষতি করব!
কিন্তু অ্যানি আমার কোনো কথা শোনে না। তুমি যখন আমেরিকা এলে ও তোমাকে কয়েকবার মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারে নি। আমি ওর প্ল্যান সফল হতে দেই নি। আমিই যে ওর সব পরিকল্পনা নষ্টকারী ও অবশ্য তা জানে না।
কিন্তু একপর্যায়ে কোনোভাবেই আটকাতে পারছিলাম না অ্যানিকে। তাই ওকে আটকানোর জন্য গুরু তান্ত্রিকের সাহায্যে জাদু বিদ্যা দ্বারা ওকে বিড়াল বানিয়ে দেই।
তোমাকে যেদিন আমি মিথ্যে বলি যে আমিই মিথি সেদিন ভোরে চলে যাবার সময় ওকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। অন্য এক বাড়িতে রেখে এসেছিলাম ওকে। কিন্তু কিছুদিন পর ও কীভাবে যেন সে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। হয়তো তোমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। এটা বিড়ালজাতদের সাধারণ প্রবৃত্তি বলে। কারণ ও তখন অন্যসব বিড়ালদের মতোই সাধারণ একটা বিড়াল হয়ে ছিল। আর তুমি ওকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে আশ্রয় দিয়েছিলে।
একসময় তুমি পুনরায় ওকে খুঁজে পাও।
এসব কিছু তো আর ওকে বলা সম্ভব নয়। তাই ওকে মিথ্যে বলি। ওকে বলি, প্রতিশোধ নিতে আমরা এ বাড়িতে এসেছি। ওর সাময়িক স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেয়েছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও সেটাই বিশ্বাস করে নেয়। আমাকে বলে কতদিন ধরে আমরা এখানে আছি। আমি উত্তর দেই, এক বছর।
ও তোমাদের মেরে ফেলতে চাইলে আমি ওকে বলি, আমি নিজের হাতে তোমাদের মারব। ওর এসবে জড়ানোর দরকার নেই। ওকে মিথ্যে বলেছি এ কারণে যাতে আমি কিছু সময় পাই ওকে তোমাদের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখতে। আর কোনো বুদ্ধি বের করতে পারি ওকে আটকানোর।
বিড়াল থেকে মানুষরূপে ফিরলেও ওর ওপর থেকে জাদুবিদ্যার প্রভাব পুরোটা কাটেনি। তাই ছয়দিনের মধ্যে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ও মানুষরূপে ফিরতে পারত। আর বাকি সময় বিড়াল রূপেই কাঁটাত। তবে বিড়াল হয়ে গেলে তখনকার কিছুই ওর মনে থাকত না। এমনকি এটাও মনে থাকত না ও যে বিড়াল হয়ে গিয়েছিল।
গুরু তান্ত্রিকের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। আমি ওনাকে ফোন করে সবকিছু জানাই। উনি বলেন, অ্যানিকে আটকানোর কোনো উপায় নেই। ও তোমাদের মেরে ফেলবে খুব শীঘ্রই। আমি ওকে আটকাতে পারব না। শুধু তোমাদের নয় ও অকারণে আরো নিষ্পাপ মানুষদের হত্যা করবে। কারণ ও একজন শয়তানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোনো সাধারণ ডাকিনী নেই আর।
অ্যানিকে আটকানোর একটা উপায়ই আছে কেবল। ওকে মেরে ফেলতে হবে। তবে যখন ও বিড়াল রূপে থাকবে তখন। ‘
কথা শেষ করে ক্লিওপেট্রা আমার দিকে তাকাল। এরপর বলল, ‘আর সে কাজটা তুমিই নিজের হাতে একটু আগে সম্পন্ন করেছ আহান!’
আমার মাথা থেকে এটা সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছিল যে আমি কিছুক্ষণ আগেই মিথি রূপে অ্যানিকে মেরে ফেলেছি। ক্লিওপেট্রা স্মরণ করিয়ে দিল। আমি আমার টি-শার্টের দিকে তাকালাম। এ কি! একটু আগেই তো এখানে রক্ত লেপ্টে ছিল। কোথায় চলে গেল! ক্লিওপেট্রা হয়তো বুঝতে পারল আমার ভাবনা।
বলল, ‘রক্ত কোথায় চলে গেল ভাবছ? হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কারণ প্রকৃতি কখনো মৃত ডাকিনীদের কোনো অস্তিত্ব রাখে না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে মৃতদেহ?’
ক্লিওপেট্রা উত্তর দিল, ‘সেটাও মিলিয়ে গেছে। চলো দেখবে।’
আমরা সবাই কৌতুহল নিয়ে ক্লিওপেট্রার পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে গেলাম। সেখানে রক্ত তো দূরের কথা লাশেরও ছিটেফোঁটা নেই! এমনকি ঘরে ছিটিয়ে পরা রক্তও বিন্দুমাত্র নেই!
আমি ক্লিওপেট্রাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আমাকে সব বলে দিলে পারতে। তাহলে আজ এতো বড় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো না।’
ক্লিওপেট্রা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তাহলে যে তোমার বাবা শওকত চৌধুরীর কথাও বলতে হতো!’
আমি বুঝতে পারলাম ক্লিওপেট্রা আমাকে এগুলো আগে কেন বলেনি। ও যদি এগুলো সব বুঝিয়ে আমাকে বলতোও তাহলেও আমার মনে এ ভাবনাটা আসতো, ও প্রতিশোধ নিতে আসে নি তো!
শুধু আমি কেন আমার স্থানে অন্য কেউ থাকলেও তাদের মনেও এ প্রশ্নের অস্তিত্ব ঘটতো। এখানে ক্লিওপেট্রার কোনোই দোষ নেই। বেচারী তো শুধুমাত্র আমার ভালোবাসার জন্যে এসব করেছে।
মা আচমকা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হয়েছে? তুই তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছিস? এবার ওকে ঘরে নিয়ে যাই? বেল্টের আঘাতে ঘা হয়ে গেছে পিঠে। মলম লাগাতে হবে।’
আমি বললাম, ‘ মা, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। চলো ক্লিওপেট্রা। ঘরে চলো। ‘
মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘একদম না! কোন অধিকারে তুই ওকে তোর সাথে যেতে বলছিস? কোনো অধিকার নেই তোর ওর ওপর।’
‘কী বলছ মা ক্লিওপেট্রা আমার বউ!’
মা উচ্চস্বরে বলল, ‘সেটা বেল্ট দিয়ে জলহস্তীর মতোন মারার সময় মনে ছিল না?’
আমি কানে ধরে বললাম, ‘স্যরি, মা। এবারের মতো প্লিজ ক্ষমা করে দাও!’
মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ‘আমার কাছে ক্ষমা চাইছিস কেন! যার ওপর অন্যায় করেছিস তার কাছে চা।’
আমি ক্লিওপেট্রার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালাম। ক্লিওপেট্রা আমাকে পাত্তা না দিয়ে অহনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সবকিছু জানার পর ভাবিকে তোমার খুব ঘৃণা লাগছে তাই না অহনা?’
অহনা দৌড়ে এসে ক্লিওপেট্রাকে জড়িয়ে ধরল। ‘কী বলো এগুলো ভাবি! যা ঘটেছে তাতে তো তোমার কোনো দোষ নেই! তুমি কতো লক্ষী একটা মেয়ে! ভাইয়া কত লাকি তোমার মতো একটা মেয়েকে বউ করে ঘরে আনতে পেরেছে। আমার তো মাঝে মাঝে ভাইয়াকে হিংসা হয়।’
বলেই অহনা আওয়াজ করে হাসতে লাগল। ক্লিওপেট্রাও ওর হাসিতে তাল মেলালো।
আমি ক্লিওপেট্রার হাত ধরে বললাম, ‘ননদ-ভাবী মিলে পরে সারাদিন হেসো। এখন চলো। ঘা ছড়িয়ে যাবে!’
ক্লিওপেট্রার পিঠময় বেল্টের আঘাতে তৈরি হওয়া কালশিটে দাগ। আমি সেখানে আলতো করে মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। ব্যাথায় ও বারবার আমার হাত খামচে ধরছে। এতক্ষণ ধরে এ যন্ত্রণা ও মুখ বুজে কীভাবে সহ্য করে ছিল কে জানে! আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা যন্ত্রণা বুকের বাম পাশ থেকে তৈরি হয়ে সারা বুকে ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই সেগুলো কান্না হয়ে ঝরে পরতে লাগল। আমি ক্লিওপেট্রার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। ও আচমকা আমার দিকে ঘুরে আমার বুকের ওপর ঝাপিয়ে পরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। আমি আরো শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
_____________
পাঁচ বছর পর…
আজ অহনার গায়ে হলুদ। সকাল থেকে ক্লিওপেট্রার দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। ঘরে তো আসছেই না। যখনই আসছে কিছু একটা নিয়ে আবার তৎক্ষনাৎ দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, বাসায় কি কাজ করার মতো আর কেউ নেই না-কি! ও একাই যে সব করে যাচ্ছে!
আমি আর মা কাজের ফাঁকে নিজেদের ঘরে এসে জিরোচ্ছি। আর ও রোবটের মতো একটানা দৌড়াদৌড়ি করেই যাচ্ছে।
অবশেষে সন্ধ্যায় তাকে পাওয়া গেল। ঘরে ঢুকে দেখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। কোমড় ছাড়িয়েছে চুলগুলো। আমি ওর সামনে গিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ আমার চোখ পরল আয়নার ওপর।
ক্লিওপেট্রার পড়নে গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি। ঠোটে গোলাপী লিপস্টিক। আমার চোখ আটকে গেল আয়নার ওপর ওর প্রতিচ্ছবিতে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
আচ্ছা, মিশরের অতি রূপবতী রানী ক্লিওপেট্রা কি এর চাইতেও বেশি সুন্দর ছিল?
“সমাপ্ত”
(আজকে অন্তত সাইলেন্ট পাঠকরা নিজেদের মতামত জানিয়ে যাবেন।
প্রিয় পাঠকেরা, আপনাদের যদি গল্পটা ভালো লেগে থাকে ইচ্ছে হলে বিভিন্ন গ্রুপে এর রিভিউ দিতে পারেন।🙃
যারা যারা এতদিন রোজ অপেক্ষা করতেন আমার এই কাঁচা হাতের লেখা গল্পটার জন্য তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। সবাই ভালোবাসা নেবেন। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন এবং অপরকে ভালো রাখবেন।❤️)