#মায়াবন_বিহারিনী পর্ব ৯

0
435

#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ৯
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)

– “শুনলাম শহর থাইকা আইছেন আর এগারো দিন পরেই নাকি চইলা যাইবেন?”
নিচু কন্ঠে বলে উঠা উপমার কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই উপমার বিক্ষিপ্ত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। চাঁদের মৃদু আলোয় যেন উপমার মুখশ্রী আরো আলোকিত হয়ে উঠেছে। ভাসা ভাসা চোখ, ঘন নেত্রপল্লব‌ বিশিষ্ট চোখ জোড়ায় এক অসীম মায়া লুকিয়ে রয়েছে।

– “এই যে বিড়াল‌চোখী মানব! ডাক্তার মানুষদের এমন আনমোনা‌ হয়ে থাকা মানায় না বুঝেছেন? তাদের তো হইতে হয় সবসময় প্রখর শ্রোতা!”
উপমার এমন কথায় কিয়ৎক্ষণ সময়ের জন্য ভ্রু কুঁচকে নেয় আবেগ। এ আবার কেমন প্রসঙ্গ? নিজেদের তৈরি কোনো নিজস্ব কল্পনার জগত থাকতে পারে না নাকি? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে সত্যিই তো! দিন দিন আবেগ মেয়েটার ভাবনার প্রতি একটু বেশিই অন্যমনস্ক হয়ে চলেছে। কিন্তু এমনটা হলে তো চলবে না। সে তো একজন ডাক্তার। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে,

– “হুম কিন্তু এই খবর তুমি পেলে কি করে? আমার অগোচরে আবার কাউকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাখো নি তো?”
আবেগের প্রশ্নে উপমা ফিক করে হেসে দেয়।

– “আপনি তো দেখি বড়ই রসিক মানুষ। শুনেন এই গ্রাম এলাকায় কোনো গুপ্তচর নিয়োগ করতে হয় না। খবর সবার আগেই বাতাসে বাতাসে সবার কানে পৌঁছায় যায়। আর রইলো আপনার শহরে যাওয়ার কথা? সে তো পরশুদিন ই আব্বার মুখে শুনছিলাম। আইজ হঠাৎ দেখা হইলো তা জিজ্ঞেস করলাম।”

আবেগ উত্তরে আর কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ নদীর ধারে বসে নীরবতা পালন করে। রাত গভীর হচ্ছে ক্রমশ। চারপাশে মৃদু বাতাসের শব্দের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কর্ণপাত হচ্ছে। রাতের শীতলতা বাড়তেই নীরবতা কাটিয়ে উপমা বলে উঠে,
– “রাইত গভীর হইতাছে ডাক্তার মশাই। আপনার এইখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হইবো না। পরে পথ ভুইলা গেলে সে আরেক বিপদ। তাই বলি পুরো রাত এইখানে না কাটাইয়া নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়ান।”

– “কেন রাতটা তো বেশ ভালোই; এখানেই তো হাজার বছর কাটিয়ে দেয়া যাবে কবির ভাবনায়। তবে হ্যাঁ ঠিক; গভীর রাত্রি। আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিত।”

আবেগের প্রস্তাবে উপমাও উঠে দাঁড়ায়। আবেগ বিনিময়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। তখনই পেছন থেকে উপমার আগ্রাসী কন্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে,
– “কাল যদি কেউ ক্যাম্পে যায় তাহলে কি তারে সেদিনের মতো আবারও তাড়াইয়া দেয়া হবে?”
থমকে দাঁড়ায় আবেগ। উপমার বাচ্চামো প্রশ্নে তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
– “না অবশ্যই না। তবে রোগী ব্যাতীত অন্য কাউকে চিকিৎসা করা কিন্তু মোটেও এলাউ না মিস উপমা।”
বলেই ইশারায় বিদায় জানিয়ে সোজা রাস্তায় পা বাড়ায় আবেগ। আবেগের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাসে উপমা। আজকের রাতটা একটু বেশিই অদ্ভুত ও সুন্দর!

২৪.
সূর্যের কিরণ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে বিস্তৃত ভাবে। চৈত্র মাসের প্রথম দিন। তাতেই কেমন যেন ভ্যাপসা গরম ছুটেছে চারপাশে। আমেনা বেগম পাশের বাড়ির রুমা বেগমের সাথে মিলে উঠোনে বসে আয়োজন বসিয়েছে। বাড়ি থেকে একটু দূরে অবস্থিত ধানক্ষেত থেকে আজ পরিপক্ক ধান আনা হবে। সেগুলো মাড়াই থেকে শুরু করে চাল বানানো অবধি পুরোটাই ব্যস্ততার কাজে কাটবে। উপমাও সকাল থেকেই বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে সবার নজরের আড়ালেই আবার ঘরে প্রবেশ করেছিল সে। ইফতেখার সাহেব সূর্যের আলো ফোটার পূর্বেই দুজন লোকের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। এভাবে চুপিচুপি হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে এমন অদ্ভুত ভাবে গা ঢাকা দেয়ার বিষয়টির মর্মার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না উপমা। কেন যেন মনে হয় ইফতেখার চরিত্রটা বেশ জটিল এবং রহস্যময়।
বাদ খানিকটা সময় পরই উৎফুল্ল মন নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে হৈমন্তী। খুশিতে বেশ উৎফুল্ল হয়ে আমেনা বেগমকে সালাম দিতেই তিনি সামান্য ভ্রু কুঁচকে সালামের উত্তর নেন এবং পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমেনা বেগমকে টপকিয়ে‌ হৈমন্তী চলে যায় বাড়ির ভেতরে। ভেতরে গিয়ে দেখে উপমা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি হচ্ছে। লম্বা এলোকেশী‌ চুলগুলো গিট দিয়ে বেনী পাকাতেই পেছনে এসে হাজির হয় হৈমন্তী। আয়নার পিঠে হৈমন্তীর মুখশ্রী চোখে পড়তেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উপমা। প্রত্যুত্তরে হৈমন্তী পেছন থেকে একটা সাদা খাম সামনে তুলে ধরতেই অবাক হয় সে। কেননা এমন ধরনের খাম খুব একটা বিশেষ দিন ছাড়া হৈমন্তী নিয়ে আসে না।
খাম সম্পর্কে জানতে সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ঘুরে হৈমন্তীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় উপমা। প্রত্যুত্তরে যা আসে তাতে চোখ হতে দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে।

বিগত কয়েকদিন বেশ ভালোই কেটেছে আবেগের। নির্মল পরিবেশে থেকে নিজের স্বপ্নের দিকে প্রতিদিন একধাপ এগিয়ে যাওয়াটা বেশ আনন্দের তার কাছে। এখান থেকে যেতে পারলে নিশ্চয়ই বড় কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য। চেয়ারের উপর বসে রোগীকে চেকআপ করে প্রেসক্রিপশন লিখতে ব্যস্ত ছিল সে। তখনই রোগীদের সারি ডিঙিয়ে চুপিচুপি প্রবেশ করে হৈমন্তী আর উপমা। আজ সকাল থেকেই ডক্টর সায়ানের ডিউটি অপর পাশের ক্যাম্পে পড়েছে। তাই আর এপাশে বেশ খানিক রোগীকে আবেগের একাই সামাল দিতে হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় পর সারি ধীরে ধীরে কমে আসতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। দুপুরের দিকে বেশিরভাগ সময়ই কেউ আসে না আর। তখনই সামনে থাকা চেয়ারে একজন এসে বসে পড়ে। কলমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিচু কন্ঠে সামনে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যে আবেগ বলে উঠে,

– “জি বলুন? রোগীর নাম আর কি সমস্যা?”

– “অনিন্দিতা নওরিন উপমা। রোগ তো অনেকই আছে তয় ঠিক কোনটা থেকে শুরু করব ঠিক বুঝতে পারতেছি না।”
চঞ্চল কন্ঠস্বর। সামনে থাকা কিশোরী রমণীর কথায় নিচ থেকে মাথা তুলে তাকায়‌ আবেগ। এতক্ষণ শরীরে জমে থাকা ক্লান্তি যেন কিশোরীর মুখশ্রী দর্শন হতেই উধাও হয়ে যায়। অপরদিকে আবেগকে এভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে খিলখিলিয়ে হেসে দেয় উপমা।

২৫.
– “এখানে রোগী ব্যাতীত অন্য কাউকে চিকিৎসা প্রদান করা হয় না মিস উপমা।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে দেখতে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে আবেগ।
– “হইতেও তো পারে ডাক্তার মশাই। হইতেও তো পারে যে আমার বিশাল বড় রোগ হইছে; মনের রোগ।
খাইতে ভাল্লাগে না, ঘুমাইতে ভাল্লাগে না। চারিপাশ জুইরা খালি তারে আর তারেই দেখি। বলেন এইটা কি কোন রোগ না?”

উপমার এমন উদ্ভট সব কথাবার্তা শুনে হকচকিয়ে যায় আবেগ। কি সব বলছে মেয়েটা?
– “মনের রোগ মানে? কি সব বলছো উপমা? এসব মনের রোগ না বরং তোমায় অরুচিতে ধরেছে। তাই বলছি নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দাও আর যাওয়ার সময় ওপাশের ক্যাম্প থেকে কয়েকটা ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়ে যেও।”
আবেগের কাটকাট গলায় জবাব।

– “যে মনের রোগই চিনবার‌ পারে না; সে আবার কিসের ডাক্তার?”
সামনে থাকা কিশোরীর কথা কর্ণপাত হতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য বোকা বনে গেল আবেগ।
মনের রোগ? সেটা আবার কি? হার্ট বিষয়ক কোনো রোগ? ডাক্তারি পড়াশোনায় তো এটা সম্পর্কেই শুনেছে সে। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে তো মোটেও তা মনে হচ্ছে না। নিষ্পলক চাহনিতে মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবেগ। মায়াবি ডাগর ডাগর চোখে কাজল লেপ্টে রয়েছে, বৈশিষ্ট্যেও যেন তার চঞ্চলতা!
আবেগকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উপমা হাসি থামিয়ে দেয় পলকেই। অতঃপর বেশ ঠাট্টার ছলেই বিড়বিড় করে বলে উঠে,
– “কি ভ্যাবলা কান্ত মশাই? ভাবনার জগতে পইরা গিয়েছেন মনে হয়! তা সেই ভাবনার জগত কি আমারে কেন্দ্র কইরাই?”

পিলে চমকায় আবেগ। মেয়েটা তো বেশ ভয়ংকর কথা বলতে জানে। আর তার মনের কথাই বা জানল কি করে? মেয়েটা কি তবে কোনোভাবে তার মাইন্ড পড়ে নিতে পারে? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গলা খাঁকারি দেয় আবেগ। তারপর অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠে,
– “এসব কিছুই না; সবকিছুই তোমার কিশোরী মনের ভ্রান্তি!”……………..

#চলবে 🍂
( ব্যস্ততার কারণে মাঝেমধ্যে একদিন পরপর পর্ব আপলোড করা হবে।
কেমন হয়েছে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here