#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (১৮)
উষশীকে দেখলেই বৃষ্টির ছোট ছোট বিন্দুর কথা স্মরণ হয়। তাকে কখনো বা ভোরের প্রথম আলোর মতো লাগে। তার বাদামী রঙের চুল গুলো কখনো কখনো পিনাট বাটার হয়ে ধরা দেয়। যার মসৃণতায় চোখ জুড়িয়ে যায়। মেয়েটি নানান রূপে অভিরাজের চোখে ধরা দেয়। সে কিছুতেই এই ভাবনা গুলো সরাতে পারে না। অথচ শুরুর দিকে দুজনের মাঝে কতই না দূরত্ব ছিল! একে অপরের প্রতি ছিল বিতৃষ্ণা। সেই দুজনেই কি না, আজ একে অপরের অনুভূতি মাখতে চায়। অভিরাজের হৃদয়ের ভেতরে থাকা সব নিশ্বাস গুলো কেমন ভারী হয়ে উঠেছে। তীব্র বেদনা হচ্ছে বুকে। যে বেদনার নাম উষশী। রাতের আঁধারে মেয়েটিকে একটিবার দেখার প্রবল বাসনা থেকেই লাবণ্য’র নিকট এল সে। মেয়েটি সেই কবে, ঘুমিয়ে জল। ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু কথা বলে চলে গেল অভিরাজ। তার ভেতরে জ্বলতে থাকা দাবানল নিভে গেছে। বুকে এখন চন্দন কাঠের সুবাস ঠেকছে। রাতের ঘুমটা বেশ ভালো হলো। সকাল সকাল ঈশান আর সে জিম করছিল।
“সরি।”
“ব্রো তুমি সরি বলছ কেন? সরি তো আমি।”
“আমার বোঝা উচিৎ ছিল। একান্তেও বোঝাতে পারতাম তোকে।”
“এটা কোনো বিষয় না।”
“উষশী তোর সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে।”
“হ্যাঁ। মেয়েটাকে দেখলেই আপন আপন মনে হয়। অথচ কিছু দিন পরেই চলে যাবে।”
এই যন্ত্রণাটা অভিরাজকে প্রতি মুহূর্তেই পীড়া দেয়। ঈশান ভাব বুঝে বলল,”উষশী হয়ত চলে যাওয়ার পর আমাদের সবাইকে ভুলেই যাবে।”
এবার যেন আঘাতটা আরো বেশি লাগল। অভিরাজ পর পর পাঞ্চিং ব্যাগে পাঞ্চ করতে লাগল। ঈশান লক্ষ্য করে ফের বলল,”নিয়তি একেই বলে। কি আর করার। আমরা চাইলেও উষশীকে ধরে রাখতে পারব না।”
কথাটা খুব বেশি মিথ্যে নয়। সামনে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। অভি কথা গুলো গিলে নিল। ঈশান বুঝল এখন অভিরাজের একা থাকা প্রয়োজন। সে চলে যেতেই ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়ল। সত্যিই কি চলে যাবে উষশী? এক বৃষ্টির মাঝে এসে আবার বৃষ্টিতেই বুঝি হারিয়ে যাবে।
বর্ষার মৌসুম। নিয়মিত বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। ছোঁয়া’র বিয়েটা কাছিয়ে এসেছে। কেনাকাটা হয়েছে বেশ। অভিরাজ উষশীকে নিয়ে বের হলো। লাবণ্য এক সপ্তাহ ধরে বাড়ি নেই। ছোঁয়া’র হলুদেও থাকতে পারবে না। উষশী বাঙালি বিয়ে দেখে নি। রিচুয়াল গুলো একদমই জানা নেই। অভিরাজ নিজ থেকেই তার জন্য জামা পছন্দ করছে। সে শুধু হা হয়ে তাকিয়ে আছে। জিনিস পত্র কেনা হলে রেস্টুরেন্টে এল ওরা। সেখান থেকে ডিনার সেড়ে বাড়ি ফিরল। উষশী’র জন্য আনা জামা কাপড় গুলো যেন একটু বেশিই সুন্দর। সকলে অভি’র চয়েজের প্রশংসা করে চলেছে। পরদিনই বাড়ি সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গেল। ফুল আর লাইটিং কে মেইন থিম ধরে কাজ চলছে। এক মাত্র মেয়ের বিয়েতে দু হাত খুলে খরচা করে চলেছেন আমান। সিনহা বাড়ির রিচুয়াল অনুযায়ী বাড়ি’র ছোট বড়ো সব সদস্যরাই কণেকে উপহার দিবে। সেই অনুযায়ী সবাই উপহার ও কিনেছে। বিষয়টা জানতে পেরে উষশী’র মন খারাপ হলো। তার কাছে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। সে এটা নিয়ে কারো সাথে আলোচনা ও করতে পারছে না। পুরো বিকাল এভাবেই পার হলো। সন্ধ্যায় মেহেদির অনুষ্ঠান। অথচ মেয়েটির মাঝে আনন্দ নেই। সারাদিনের ধকল শেষে উষশী’র গোমড়া মুখ অভিকে বেশ ব্যথিত করল। সে অগোচরে মেয়েটিকে ডেকে নিল।
“মন খারাপ করে আছ কেন?”
“সবাই ছোঁয়াপুর জন্য উপহার কিনেছে।”
“হ্যাঁ। এটা আমাদের বাড়ির রিচুয়াল।”
“আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই।”
“কে বলেছে নেই? তুমিও উপহার দিচ্ছ।”
“আমি?”
“হুম। আব্বু আর মা মিলে একটাই উপহার এনেছে। আমি আর তুমিও একটাই উপহার দিব।”
“ওরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ।”
এ কথায় দমে গেল অভিরাজ। তার মুখের আদল বদল করে শুধাল,”তুমি আমাকে বন্ধু মনে করো উষশী?”
বন্ধু শব্দটি অভিরাজের সাথে যাচ্ছে না। উষশী দু দিকে মাথা কাত করে ‘না’ বোঝাল। পর পর দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। উষশী’র খেয়াল হলো হাতে থাকা রিং এর কথা। সে রিংটা হাতে তুলে নিয়ে বলল,”ছোঁয়াপুকে এটা দিব আমি।”
“একদম ই না। এটা তোমার মায়ের দেওয়া উপহার। আমি তোমাকে নতুন কিছু এনে দিব। কেমন?”
উষশী হ্যাঁ না কিছুই বলল না। শুধু ছেলেটার বাহু খামচে ধরল।
“আমাকে নিয়ে ছাদে যাবেন একটু?”
ওরা ছাদে এল। পুরো ছাদ ফুলে ভরে উঠেছে। মিষ্টি একটা সুবাস নাকে লাগছে। উষশী এগিয়ে এসে পুলে পা ডুবিয়ে দিল। পানিতে তার কোমল ফর্সা পা যুগল দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে দেখতে। অভি কিছু সময় তাকিয়ে থেকে পাশে বসল।
“তোমার খুব মুড সুইং হয় তাই না?”
“খুব। বিশেষ করে মেন্সট্রুয়েশনের সময়।”
খোলা বইয়ের মত উষশী। সে খুব সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করে। তবে সবার সাথে তার বনিবনা হয় না। অভি কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই বলল,”শারীরিক বিষয় গুলো নিয়ে এত অবহেলা করলে তো চলবে না উষশী। তোমার ডেট চলছে বলবে না?”
“লাবণ্যপু তো নেই।”
“বাকিরা ছিল।”
“সবাই কে বিরক্ত করতে চাই নি।”
“ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নেই। তোমার পেইন হচ্ছে?”
“উহু।”
“হলে জানাবে। আর একদমই মন খারাপ করবে না।”
অভিরাজ নিজের হাতের মুঠোতে উষশী’র নরম তুলতুলে হাতটা গলিয়ে নিল।
“চালাক মেয়েটাও বুঝি মাঝে মাঝে বোকামি করে?”
“করে তো।”
“নেক্সট আর করবে না। হাইজিং এর একটা বিষয় থাকে। তোমার স্বাস্থ্যের সুরক্ষা তোমাকেই করতে হবে।”
উষশী হু না কিছুই বলল না। আলগোছে অভির বাহুতে মাথা এলিয়ে দিল।
“মম আমার খুব খেয়াল রাখত। সত্যি বলতে আমি আদুরের থেকেও আদুরে। ছোট ছোট বিষয় গুলোও মম দেখেছে। সবার সাথে মেশার সুযোগ হয় নি। খুব কম মিশতে পারি আমি। তবে যাকে ভালো লেগে যায় তাকে ছাড়তে খুব কষ্ট লাগে।”
“আমাকে তোমার কেমন লাগে উষশী? শুরুর দিকে কিন্তু আমাদের ঝগড়া হয়েছিল।”
“এটার উত্তর নেই আমার কাছে। আপনার বিষয়টা আমি বিগত আচরণের সাথে মেলাতে পারি না মিস্টার রাগি। সত্যি বলতে নিজের মাঝে পরিবর্তন দেখছি।”
“কিছু পরিবর্তন ভালো হয় রেইন।”
“রেইন?”
“হুম। তোমার আমার প্রথম আলাপ তো বৃষ্টিতেই। তাই তোমার নাম দিলাম রেইন।”
উষশী আর কথা বলতে পারল না। একটা শীতল হাওয়া তাকে ভীষণ আকর্ষণ করছে। সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলল অভিরাজের সাথে। ছেলেটার শরীর থেকে মন ভালো করার সুবাস আসছে। এত রকমারি অনুভূতি হয় কেন তার?
সকলেই লেহেঙ্গা পরেছে। আর উষশী পরেছে ফ্রক। তাকে এতেই সুন্দর লাগছে। বিদেশিনীকে দেখে অনেকেই বেশ আলাপ করছে। এদিকে উষশী একটি মানুষকে খুঁজে চলেছে। সে কখনোই সাজে না। আজ একটু সেজেছে। তাই প্রিয় মানুষটার নজরে আসতে চাইছে। কিন্তু ঈশান কে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে আর সামনে আগায় না।
“ফ্রেন্ড! তুমি মনমড়া হয়ে আছ?”
“মনমড়া নয় উষশী। আম সো মাচ হ্যাপি। লুক এট মাই ফেইস।”
“মাইন্ড রিড করতে পারি না বলে এমন নয় মেকি খুশি বুঝব না।”
বেশ শক্ত বাংলা উচ্চারণ করছে উষশী। ঈশান একটু নড়েচড়ে উঠল।
“তুমি কি বলতে চাও উষশী?”
“ছোঁয়াপু’র বিয়েতে তুমি খুশি নও।”
“সবাই তো খুশি।”
“কেন সত্যিটা তাকে জানাও নি ঈশান?”
“সব কিছু জানাতে নেই উষশী।”
“কেন জানাতে নেই?”
“অনেক কারণ রয়েছে। তুমি এখন বুঝবে না। একটু বসো পাশে।”
উষশী ঈশানের পাশে বসল। মেয়েটা ওর থেকে সাত বছরে ছোট হবে। অথচ কথা বলে বন্ধুর মতো। আসলে বন্ধুত্বের জন্য বয়স কোনো বিষয় থাকে না। কিছু সময় পার হয়ে গেলে উষশী বলল,”ভালো লাগছে না।”
“কেন? সব তো সুন্দর ই হচ্ছে।”
“তুমি মন খারাপ করে আছ।”
“আমি অলোয়েজ এমনি থাকি। আচ্ছা এখন এসব ছাড়ো। আসল কথা বলো। ব্রো কে বলেছ?”
“বলেছি।”
“কি জানিয়েছে?”
“বুঝতে পারছি না। আমার মাথার উপর দিয়ে কথা গুলো চলে গিয়েছে।”
মুচকি হাসল ঈশান। মেয়েটার বাদামি রঙা চুল গুলোর দিকে নজর রেখে বলল,”ব্রো তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে উষশী। আমি চোখের ভাষা বুঝতে পারি।”
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি