#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৪০
” গুডবাই সুইজারল্যান্ড! ”
ক্ষুদ্রাকৃতির জানালা গলিয়ে জুরিখ শহরের দেখা মিলছে। তাকেই বিদায় জানালো দুয়া। মলিন বদনে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সেথা হতে। আটদিন ব্যাপী সুইজারল্যান্ড ট্রিপ আজ সমাপ্ত হলো। জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশ ভ্রমণ। তা-ও একান্ত মানুষটির সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা রূপী। অসাধারণ, অনবদ্য, অপূর্ব ছিল! কখনো ভোলার মতো নয়। এই সফরটি চিরকাল তার স্মৃতির পাতায় গেঁথে রইবে। কোনো এক শ্রান্ত অপরাহ্নে এ ভ্রমণ কালীন মুহূর্তগুলো ভেবে স্মৃতি রোমন্থন করবে। তৃপ্তিময় হাসলো দুয়া। তাকালো বাঁ পাশে। মানুষটির হাতে ম্যাগাজিন। দৃষ্টি নিবদ্ধ তাতেই। দুয়া কিচ্ছুটি বললো না। নিঃশব্দে মাথা এলিয়ে দিলো তার কাঁধে। তূর্ণ মিষ্টি করে হাসলো। ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো দুয়া’র পানে। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো,
” খারাপ লাগছে? ”
” একটু একটু। কয়েকদিন এখানে স্বপ্নের মতো কাটিয়েছি। এবার ঘরে ফেরার পালা। স্বাভাবিকভাবেই কেমন যেন লাগছে। ”
” মন খারাপ করো না। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রয়োজনে নাহয় আবার আসবো। তবে দুই নয়। তিন হয়ে। ”
” তিন! ” কিঞ্চিৎ চমকালো দুয়া!
” হাঁ তিন। তুমি, আমি এবং সে। ”
কাঁধ হতে মুখ তুলে তাকালো দুয়া। শুধালো,
” কে সে? ”
কর্ণে উষ্ণ শ্বাস ফেলে জবাব দিলো মানুষটি,
” আমাদের অনাগত বাবুসোনা। ”
সহসা আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মুখশ্রীতে। লাজে নত হলো দৃষ্টি। বাহুতে মৃদু আঘাত করে তারই কাঁধে মুখ লুকালো মাইরা। সশব্দে হেসে উঠলো তূর্ণ। তাতে আরো গুটিয়ে গেল মেয়েটি। ওকে নিজের সনে আগলে নিলো তূর্ণ।
•
সপ্তাহব্যাপী মধুচন্দ্রিমা সেরে দেশে ফিরেছে তূর্ণ, দুয়া যুগল। খুশির আভা ছড়িয়ে পড়লো দুই পরিবারে। কখনো ‘ ছায়াবিথী ‘ কখনোবা নিজের বাসায়। গেট টুগেদার এর আয়োজন করা হলো। আনন্দে কাটলো দিন। আজও তেমনই এক আনন্দমেলা। তাহমিদা’র নিমন্ত্রণে হাজির হয়েছে দুয়া’র শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। নিজ রুমে বসে দুয়া, তানজিনা, নিশি, তৃষা এবং তানু। ওদের মধ্যমণি ল্যাপটপ। সেথায় প্রদর্শিত হচ্ছে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণের অসংখ্য মুহূর্ত। লেক জেনেভা’র ফটো দেখতে দেখতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো তৃষা।
” আরে বাহ্! ইন্টারনেটে লেক জেনেভা যতটা সুন্দর। বাস্তবে তো তার থেকেও কয়েক গুণ বেশি সুন্দর লাগছে! ”
দুয়া সহমত পোষণ করলো।
” একদম ঠিক বলেছিস। ওখানে এত সুন্দর সুন্দর ভিউ যে কোথা থেকে কোথায় যাবো, কি ফটো তুলবো.. আমি তো পুরো কনফিউজড হয়ে পড়েছিলাম। ”
তানজিনা ওর দিকে তাকালো। দুষ্টু হেসে বললো,
” এত কনফিউশন! বর সাহেবকে বলতেই হতো। সে সমস্ত কনফিউশন দূর করে দিতো। ”
” অ্যাহ! সবকিছু তাকে বলতে হবে কেন? ”
” কারণ সে তোর বর সাহেব। ”
” উফ্ আপু। ” দুয়া’র মুখে মধুরতম বিরক্তির ছাপ।
হেসে উঠলো বাকিরা। তানু হাসিমুখে বললো,
” দুয়াপু লজ্জা পাচ্ছে। হি হি হি। ”
” ওরে পুঁচকে মেয়ে! বেশ পেকে গেছিস তাই না? বিয়ে দিতে হবে। হুম। ”
তানু আপত্তি জানালো।
” ইশ্ বললেই হলো? আর আমি কি সিজনাল ফল? যে পেকে গেছি? ”
হেসে উঠলো সবাই। ওর পিঠ চাপড়ে বাহবা জানালো তৃষা।
” একদম কারেক্ট আছে বস। ফাটাফাটি বলেছিস। ”
গর্বিত হলো তানু। তা দেখে দুয়া মিটিমিটি হাসছে। সকলের উদ্দেশ্যে বললো,
” বোন আমাদের বড় হয়ে গেছে। বুঝদার হয়ে গেছে। এর জন্য পাত্র খোঁজা দরকার। এখনই সুসময়। ”
নিশি সুরে সুরে বললো,
” এখন তো সময় কাছে আসার। ”
” এ দুটি হৃদয় ভালোবাসার। ” লাইন সমাপ্ত করলো তৃষা।
সকলের হাসিতে লজ্জা পেল তানু।
” আপু! ”
নিশি বললো,
” হাঁ আপু। বলো। কেমন জামাই চাই? কবির সিং টাইপ প্যাশনেট? নাকি রোমান্টিক পিস? ”
” এটা কিন্তু ঠিক না। তোমরা দুয়াপু’কে নিয়ে দুষ্টুমি করছিলে। এখন আমাকে নিয়ে পড়লে কেন? ”
দুয়া হেসে সুরে সুরে বললো,
” কেননা এখন তো সময় কাছে আসার। ”
তানু ব্যতিত সকলে সমস্বরে,
” এ দুটি হৃদয় ভালোবাসার। ”
এবার সকলেই একত্রে সশব্দে হেসে উঠলো। হঠাৎ দুয়া লক্ষ্য করলো তৃষার নজর ওর দিকেই নিবদ্ধ। কেমন বাজপাখির নজরে তাকিয়ে।
” কি হয়েছে? এমন শকুন চোখে তাকিয়ে আছিস কেন?”
” দেখছি। বোঝার চেষ্টা করছি। ”
” আচ্ছা? কি দেখা বোঝা হচ্ছে? ” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দুয়া।
” এটাই যে ভিনদেশে আপনেগো কাছে আসা, ভালো পাশাপাশি হয়েছে? ”
বিষয়টি অনুধাবন করতেই লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো দুয়া’র মুখশ্রীতে। নিশি হৈহৈ করে উঠলো।
” হয়ে গেছে। হয়ে গেছে। ভাবিজি’র চেহারাই বলে দিচ্ছে কুচ তো জারুর হুয়া। ”
দুয়া ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো।
” নিশিপু। পঁচা বকবে না। ভাবি হই কিন্তু। ”
তৃষা ফটাফট দুয়া’র বাঁ কপোলে চুমু এঁকে দিলো।
” আমি জানতাম। ভাইয়া আমার রোমান্টিক পিস। অন্য মাস্টারদের মতো নিরামিষ না। ঠিক মধুচন্দ্রিমা মানিয়েই আসবে। ”
দুয়া ফটাফট ওর পিঠে কয়েকটা আঘাত করলো।
” বে দ্দ প মাইয়া! বড় ভাই ভাবিকে নিয়ে পাকামো হচ্ছে? ”
” নো বেপ্পি। ননদ ভাবী স্পেশাল দুষ্টুমি হচ্ছে। ”
” তবে রে। ”
দুয়া তাড়া করতেই বিছানা ত্যাগ করে ছুটলো তৃষা। ওর পিছু নিলো দুয়া। দু’জনে দৌড়ে যেই না কক্ষ হতে বের হলো ওমনি আকস্মিক ব্রেক কষলো তৃষা। ফলস্বরূপ দুয়া পড়তে গিয়েও পড়লো না। বাঁ হাতে ওকে আগলে নিয়েছে মানুষটি। ডান হাতে তার মোবাইল।
” আস্তে। বি কেয়ারফুল দুয়া। ”
ভাইকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসলো তৃষা।
” হায়! টুরু লাভ দেখে আমার তো প্রেম প্রেম পাচ্ছে। আজ একান্ত একজন নেই বলে। ”
দুয়াকে সোজা দাঁড় করিয়ে তৃষার মাথায় গাট্টা মে রে দিলো তূর্ণ।
” খালি পাকনামি! ”
তৃষা নাকমুখ কুঁচকে ফেলল।
” জামাই বউ একই কোম্পানির প্রোডাক্ট। খালি মা রে। হুহ্। ”
সেথা হতে প্রস্থান করলো তৃষা। তূর্ণ, দুয়া মৃদু হেসে উঠলো। তাকালো একে অপরের দিকে। দুয়া জিজ্ঞেস করলো,
” খাবার খেয়েছো? ”
বলতে না বলতেই বাঁ হাতে বন্দিনী করে নিজের সনে মিশিয়ে নিলো তূর্ণ। দুয়া ঘাবড়ে গিয়ে ডান হাতে অর্ধাঙ্গের কাঁধ এবং বাঁ হাতে শার্টের বুকের অংশ আঁকড়ে ধরলো। চোখে চোখ পড়তেই দুষ্টু হাসলো তূর্ণ।
” কি করছো? ছাড়ো। কেউ এসে পড়বে তো। ”
” এখন ছাড়াছাড়ির মুডে নেই বিবিজান। ”
দুয়া আকুল হয়ে বললো,
” ছাড়ো না। ”
” না। প্রেম প্রেম পাচ্ছে। একটা চু মু দাও তো ফটাফট। ”
” কিহ্! ” চোখ বড় বড় করে তাকালো দুয়া।
তূর্ণ বিরক্ত হয়ে বললো,
” রোমান্টিক মোমেন্টে এমন ভুলভাল এক্সপ্রেশন দিচ্ছো কেন? মুডের টাইটাই ফিস হয়ে যাচ্ছে তো। মনে হচ্ছে পাশের বাড়ির ভাবির কাছে চু মু চাইছি। ”
পাশের বাড়ির ভাবি! ক্ষে পে গেল বধূ সাহেবা। ডান হাতে শার্টের কলার মুঠোবন্দী করে তেজস্বীনি রূপ ধারণ করলো,
” কি বললে তুমি? পাশের বাড়ির ভাবি? ”
টুপ করে কোমল ওষ্ঠে আলতো পরশ এঁকে দিলো তূর্ণ। হতবিহ্বল রমণীর পানে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললো,
” নাহ্! তৃষা, নিশি’র ভাবি। আমার বউ। বাই বাই বিবিজান। দেখা হচ্ছে রাতে। খেলার ময়দানে। ”
চোখ টিপে সেথা হতে প্রস্থান করলো তূর্ণ। অবাক রমণীর মুখনিঃসৃত হলো,
” বেশরম পুরুষ। ইশ্! ”
লালিমায় মাখা চেহারা লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো দুয়া। কি লজ্জাজনক অবস্থা!
•
সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ শেষে কপোত-কপোতী ফিরেছে এক মাস পূর্ণ হলো। ব্যস্ত কাটছে দিনকাল। দুয়া ব্যস্ত পড়াশোনায়। ভার্সিটি, বন্ধুমহল, শ্বশুরবাড়ি সব মিলিয়ে দারুণ সময় কাটছে। তেমনিভাবে তূর্ণ’ও ব্যস্ত নিজস্ব কর্মে। তবে বলে না, সুসময় সর্বদা থাকে না। দুঃসময় ঠিক হানা দেয়। তছনছ করে দেয় সবটুকু। তেমনিভাবে ঝড় উঠলো তূর্ণয়া’র জীবনেও।
নিশুতি এক রজনী। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তাসলিমা। তার দুই কাঁধে মাথা রেখে বসে দুয়া এবং তৃষা। তাসলিমা পড়ে শোনাচ্ছেন মহানবী তনয়া ফাতেমা’র জীবন কাহিনী। ননদ ভাবী মন দিয়ে শুনছে। সমস্ত মনোযোগ তাসলিমার কণ্ঠে। হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটলো। বিপ বিপ শব্দে আলোড়ন সৃষ্টি করলো ক্ষুদ্র যন্ত্রটি। বিরক্ত হয়ে সোজা হয়ে উঠে বসল দুয়া। মোবাইল হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই সমস্ত বিরক্তি উবে গেল। চেহারায় ফুটে উঠলো লালিমা। তাসলিমা ও তৃষা মুচকি মুচকি হাসছে। দুয়া খুশিমনে ফোন রিসিভ করলো।
” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম। ”
ওপাশ হতে শোনা গেল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ। থমকে গেল দুয়া। হাত খসে পড়ে গেল ক্ষুদ্র যন্ত্রটি। লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। স্তব্ধ রমণীর অক্ষিকোল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনাজল। ক্রমহ্রাসমান হারে স্পন্দিত হচ্ছে হৃদযন্ত্র। খরার ন্যায় ফাটল সৃষ্টি হলো মানসলোকে। তৃষা অবাক স্বরে শুধালো,
” ভাবি! কি হয়েছে? ”
চলবে.
[ ছোট হয়েছে পর্বটি। আগামী পর্বে ইনশাআল্লাহ্ পুষিয়ে দেবো। কেমন লাগলো পর্বটি? মন্তব্য আশা করছি। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]