#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
দুপুর দুইটা বেজে দশ মিনিট। মীরা এখনো কলেজ থেকে ফিরলো না। বাসার সবাই চিন্তায় আছেন। মীরার মা মিরাজকে ফোন দিয়ে সবটা জানালেন। মীরাকে কল দিয়েও কোনো রেস্পন্স পাওয়া যায়নি। মিরাজ তার অফিসে ছিল। এই মুহুর্তে তুর্যও নেই যে তাকে ফোন করে বলবে মীরার কথা। তুর্য চলে গেছে তার চাকরিতে। তুর্য ফেনীতে নয় চাকরি করে ময়মনসিংহ। একটা বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়লো মিরাজ। নিজেও যেতে পারছেনা আবার কাউকে পাঠাতেও পারছেনা। হঠাৎ তার মাথায় এলো আহানের কথা। হ্যাঁ! আহান, কিন্তু ও তো এখন থানায়। কিছু না ভেবেই মিরাজ আহানকে কল দিয়ে বসে।
রিং বাজতেই আহান কল রিসিভ করে বলে, “হ্যাঁ, মিরাজ। বল। কোনো সমস্যা?”
“অনেক বড়ো সমস্যা।”
ভ্রু কুচকালো আহান। তারপর বলল, “কি হয়েছে?”
“তুই এখন কোথায় আছিস?”
“সরকারি কলেজে নাকি মারামারি হচ্ছে। ওখানে যাচ্ছি, কেন?”
“মীরা এখনো বাসায় ফিরেনি আহান।”
“কি বলছিস! তাহলে কি উনি কলেজে আছে?”
“সেটাইতো জানি না। তুই একটু দেখনা প্লিজ। তুর্য ময়মনসিংহ গেছে।”
“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ওনাকে খুঁজবো।”
“খুঁজে পেলে জানাস।”
“আচ্ছা।”
আহান কল কেটে দিল। সে অলরেডি কলেজে পৌঁছে গেছে। তার সাথে ছিল আরো কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।
.
কলেজের ভিতর আহান ঢুকে দেখে যে অনেক বড়ো রকমের একটা সংঘর্ষ হয়েছে। আহান গিয়ে কলেজের ছেলেগুলোকে থামায়, যারা মারপিট করছিল। এদিকে পুলিশ দেখে সবাই ভয় পেয়ে যায়। আহান কঠিন দৃষ্টিতে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, “স্টুডেন্ট হয়েছ, ঠিকভাবে স্টাডি করো। কিন্তু তোমরা এসব কি করছ? এসব তোমাদের শিক্ষাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।”
সবাই নিচু হয়ে আছে আহানের কথা শুনে। অনেকের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। আহান এবার কলেজের টিচারদের উদ্দেশ্যে বলে, “আপনারা আপনাদের স্টুডেন্টদের শাসন করতে পারেন না? কি কারণে ওরা এমন ঝগড়া করছে? জানতে চেয়েছেন কি? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছেন অথচ ওদের থামাতে পারেননি। অদ্ভুত।”
আহান আবারও ছেলেগুলোকে বলল, “ঝগড়া কেন করছিলে? মারামারি কেন করছিলে বলো।”
ওদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠে, “ও আমার সাথে বাজিতে হেরে গিয়েছিল। আমি ওর কাছে বাজির টাকা পাই। এখন টাকা দিতে অস্বীকার করেছে।”
“সে কারণে তোমরা এমন মারামারি করবে? নিজেদের কি অবস্থা করেছ দেখেছ? তোমাদের মা বাবা তোমাদের কলেজে পাঠান ভালো শিক্ষা গ্রহণের জন্য, মারপিট করার জন্য নয়।”
“স্যরি স্যার।”
একসাথে সব ছেলেগুলো বলে উঠলো। আহান চুপচাপ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে মীরা এককোণে দাঁড়িয়ে আহানের কথাগুলো শুনছিল। পুলিশরাও এভাবে বোঝায়? সে কি তবে পুলিশদের ভুল বুঝে আসছে এতোদিন? ভাবতেই মীরার মাথায় জট পাঁকিয়ে যায়। আহান বাকি পুলিশদের উদ্দেশ্য করে বলে, “ওদের নিয়ে কাছের কোনো হাসপাতালে যাও।” ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমাদের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। এর পরেরবার এমন বাজি ধরে বা অন্য কিছু নিয়ে মারপিট করলে সোজা থানায় নিয়ে যাব।”
বাকি পুলিশরা ছেলেগুলোকে ধরে কলেজ ত্যাগ করে। এদিকে কলেজে হাজারো ছাত্রছাত্রীর ভিড় জমে গেছে। আহান চারদিকে দৃষ্টি আরোপ করে মীরাকে খুঁজছে। আহানের দৃষ্টি গিয়ে এক কোণে স্থির হয়। একজনকে দেখতে পায় সে। গায়ে কালো বোরকা আর কালো হিজাবে মস্তক আবদ্ধ তার। আহানের মুখে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। সে তার দৃষ্টি যেখানে স্থির হয়েছে সেখানে যেতে থাকে। মীরা তার বান্ধবীর সাথে কথা বলছিল। হুট করে তার হাত কেউ ধরে ফেলে খপ করে। মীরা চমকে উঠে। পাশ ফিরে তাকিয়ে আহানকে দেখতে পায় সে। মীরা আহানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, আহান হঠাৎ ওর হাত ধরেছে কেন? আহান কিছু না বলেই মীরার হাত ধরে কলেজ গেইটের দিকে রওনা হয়। কলেজ গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে তারা। মীরা কঠোর গলায় আহানকে বলে, “এভাবে হাত ধরে নিয়ে এলেন কেন?” আহান মীরার দিকে তাকায়। রেগে আছে বোধয় মেয়েটা৷ একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে সে বলে, “কয়টা বাজে ম্যাম আপনার সে খেয়াল আছে? আপনি জানেন আপনাকে নিয়ে আপনার বাড়ির লোক কতটা টেনশন করছে? আপনার ভাই আমাকে কল দিয়ে আপনাকে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে।” মীরা চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলে। ইশ! এতোটা দেরি হয়ে গেল? ঝগড়া দেখতে দেখতে সময়ের কথা মনেই ছিলনা তার। আহান বলল, “আপনি এখানে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখছিলেন?” মীরা বলে, “আসলে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন আমার ফ্রেন্ড এর বয়ফ্রেন্ড। আর সে বলল থাকতে তাই আর কিছু না ভেবেই..।” আহান এদিক ওদিক তাকিয়ে গাড়ি দেখে, তারপর মীরার উদ্দেশ্যে বলে, “চলুন, রাস্তা পার হবেন। আমাদের যেতে হবে।”
“রাস্তা পার হবো কিন্তু দিঘির ওখানে উঠবো।”
“কেন?”
“খাওয়া হয়নি আমার। আগে ফুসকা খেয়ে নেই, তারপর বাসার যাবো।”
“ম্যাম, আমাকে থানায় যেতে হবে।”
মীরা কৌতুকের ছলে বলে, “দায়িত্ব নিয়েছেন তা পালন করবেন না? কেমন পুলিশ মানুষ আপনি?”
“আচ্ছা চলুন। তবে বেশি সময় নিবেন না।”
আহান মীরাকে রাস্তা পার করিয়ে ওপাশে দিঘির ওখানে গেল।
বলে রাখা ভালো, ফেনী কলেজের সামনেই রয়েছে এক বিশাল দিঘি। রাজাঝির দিঘি নামে বেশ পরিচিত এই দিঘি। পূর্ব দিকে কলেজ, পশ্চিম দিকে দিঘি আর মাঝখানে রাস্তা। রাস্তা পার হয়ে দিঘির ওখানে যেতে হয়।
–
দিঘির সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলো ফুসকার স্টল। এবং পাশেই অনেকগুলো ফুটপাতের দোকান। মীরারা ফুসকার স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। মীরা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে আহান এখনো তার হাত ধরে আছে। মীরা বলে, “আর কতক্ষণ আমার হাত ধরে থাকবেন শুনি?”
আহান চটজলদি মীরার হাত ছেড়ে দেয়। মীরা ঠোঁট চেপে ধরে হাসে।
“স্যরি মিস।” মীরা বলে, “চলুন বসবেন।” আহান বলল, “আপনি খান আমি খাইনা এসব।”
“আমি কখন আপনাকে খাওয়ার কথা বললাম? আমিতো আপনাকে বসতে বলেছি।”
আহান পড়লো ভিষণ লজ্জায়। এদিকে মীরা মিটমিট করে হাসছে। মীরা ভাবছে, আহানের জায়গায় যদি তুর্য থাকতো তাহলে এতক্ষণ কথায় মার প্যাঁচে মীরাকে আটকিয়ে দিত। কিন্তু এই ছেলে তো কথাই বলতে জানে না ঠিক করে। মজাই বুঝে না। কি লাজুক! মীরা বলে, “চলুন চলুন। আমি খাবো আর আপনি বসে বসে দেখবেন। এমনিতেও তো আপনি ঝাল খাননা। আর আমি না ঝাল ছাড়া কিছুই খেতে পারিনা।”
আহান গিয়ে ওখানে একটা একটা ভালো টেবিল চেয়ারে মীরাকে নিয়ে বসায়। যেখানে লোকজন নেই এমন একটা টেবিলে নিয়ে যায় সে। টেবিলে কিছু পানি জমে ছিল। আহান একটা লোককে ডেকে বলল টেবিলটা পরিষ্কার করে দিতে। তারপর ফুসকাওয়ালাকে বলে মীরাকে ফুসকা দিতে। মীরা বলে, “ঝাল ঝাল এবং বেশি টক দিয়ে ফুসকা দিও মামা।”
আহান মীরার দিকে তাকায়। মেয়েরাই পারে এতো ঝাল খেতে। বাপরে! আহান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখছিল। এদিকে মীরার ভালো লাগলো আহানের এমন দায়িত্ববোধ দেখে।
কিছুক্ষণ পর ফুসকা নিয়ে আসা হলো। মীরা ঝাল ঝাল ফুসকা খেতে থাকে। আহান এসব দেখতে পারছেনা। চোখ দিয়ে পানি পড়বে তার এমন মনে হচ্ছে, তাই সে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে মীরা আহানের কথা ভেবে মনে মনে হাসছে আর ফুসকা খাচ্ছে। হুট করে ফুসকার টক মীরার মুখসহ নাক দিয়ে ঢুকলো। মীরা কাশতে শুরু করলো। টেবিলে থাকা জগে হাত দিয়ে দেখে পানি নেই। মীরার অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগলো। আহান একটা দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে তার মুখ খুলে তাড়াতাড়ি করে মীরার সামনে ধরলো। মীরা আহানের কাছ থেকে পানির বোতলটা নিয়ে পানি খেতে লাগলো। পানি খাওয়ার পর কাশি বন্ধ হয়ে গেলো মীরার। এখন একটু ভালো লাগছে তার। তখনই আহান বলল, “খাওয়ার সময় শুধু খাওয়াতেই মনোযোগ দিবেন। অন্য কোথাও নয়। নাহলে এমন অবস্থা হবে।”
মীরা করুণ চোখে আহানের দিকে তাকালো৷ আহান তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল মীরার কাছ থেকে। বাকি ফুসকাগুলো আস্তে আস্তে খেতে লাগলো সে। খাওয়া শেষে যখন মীরা ফুসকার বিল দিতে যাবে, তখন আহান ওকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই ফুসকার বিল দিয়ে দিল। মীরা অবাক হয়ে বলল, “এই, আপনি কেন দিলেন?”
আহান বলল, “আমি এতো অকৃতজ্ঞ নই মিস যে, বন্ধুর বোনের সাথে থেকে তাকে খাওয়ানোর পয়সা আমার থাকবে না। আমি সাথে থাকা সত্ত্বেও তাকে টাকা দিতে হবে। আপনি এখন আমার দায়িত্বে আছেন। কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলুন।”
“একটু দিঘি থেকে ঘুরে আসি?”
“ম্যাম বাসায় অপেক্ষা করছে সবাই আপনার জন্য।”
“অহ, হ্যাঁ। ইশ! মোবাইলটা সাইলেন্ট ছিল তাই তাদের কলগুলো দেখতে পাইনি। চলুন।”
মীরা চলে যাওয়ার জন্য দু কদম পা ফেললো। কিন্তু এরপরই একজনকে দেখে ও থেমে যায়। একটা ছেলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মীরা কাচুমাচু হয়ে আহানের পাশে ঘেঁষে দাঁড়ায়। আহান কিছুই বুঝলো না। ছেলেটা মীরার কাছে এসে বলে, “আরে মীরা? কি খবর?”
মীরা বিরক্তি নিয়ে বলে, “হুম ভালো।”
ছেলেটা মীরার পাশে পুলিশের পোশাক পড়া আহানকে দেখে ভ্রু কুচকালো। তারপর সোজা মীরাকে প্রশ্ন ছুড়ে বলে, “ইনি কে?”
মীরা একবার ঢোক গিলে। কি বলবে এবার? হুট করেই ও বলে বসে। “আমার বয়ফ্রেন্ড!”
আহান চমকালো! থমকালো। শীতল চোখে মীরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ছেলেটা বলল, “অহ, অভিনন্দন।”
পুলিশ দেখে ছেলেটা কিছু না বলেই একটু ভয় পেয়ে চলে গেলো। আহান জিগ্যেস করলো, “আমি কবে আপনার বয়ফ্রেন্ড হলাম?”
মীরা চোখ বন্ধ করে দাঁত মুখ খিঁচে বলে, “ছেলেটা কলেজের সিনিয়র। প্রপোজ করেছিল। রাজি হইনি। কিন্তু পিছু ছাড়ছেনা। তাই এ মিথ্যে। স্যরি।”
আহান বুঝলো। ও আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না। দুজন ফুটপাত ধরে হাটতে লাগলো। মীরা হঠাৎ আহানকে জিগ্যেস করলো, “আচ্ছা আপনি তো নতুন এসেছেন এখানকার থানায় তাইনা? আগে কোথায় ছিলেন?”
আহান জবাবে বলে, “চট্রগ্রামে। এখানে বদলি হয়ে এসেছি দু সাপ্তাহ হলো।”
হাটতে হাটতে তারা রাস্তায় এসে পড়লো। আহান একটা রিক্সা ডেকে দিল। মীরা রিক্সায় উঠে বসলো। আহান বলল, “কিছু মনে করবেন না, আসলে থানায় জরুরি কাজ আছে। তা নাহলে আপনাকে পৌঁছে দিতাম।”
“ইটস ওকে। আমি যেতে পারবো।”
আহান রিক্সাওয়ালাকে ৫০ টাকা দিল। মীরা ভ্রু কুচকে বলল, “ত্রিশ টাকার ভাড়া আপনি পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছেন কেন? কলেজ রোড থেকে একাডেমি রোড পর্যন্ত রিক্সা ভাড়া কিন্তু ত্রিশ টাকা। অটোতে গেলে দশ টাকা।”
“যাতে আপনাকে ভালোভাবে বাসায় পৌঁছে দেয়। সাবধানে যাবেন।”
মীরা মুচকি হাসে। “আসছি।”
মীরা সামনের দিকে তাকিয়ে থমাকালো। আবারও আহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইনিস্পেক্টর সাহেব! আপনার ঘড়ি কিন্তু খুলে যাচ্ছে।”
আহান পাশ ফিরে তাকিয়ে মীরার কথা শুনে নিজের হাতের দিকে তাকায়। পড়ে যাওয়ার আগেই নিজের ঘড়িটি ধরে ভালোভাবে হাতে লাগিয়ে নেয় সে। “থ্যাঙ্কিউ মিস।”
মীরা আবারও হাসে। রিক্সা সামনের দিকে এগুতে লাগলো। আহানও চললো থানায়।
চলবে…
(ইদ মোবারক)