#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
আষাঢ়ের পঞ্চম দিন। টাপুরটুপুর বৃষ্টি পড়ছে। পিচঢালা রাস্তা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মুছে ছাপ হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ করছে রাস্তার এক কোণ। কদম আর কেয়ার গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ।
সবে ক্লাস শেষ করে ছাতা নিয়ে কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়েছে মীরা। মাথার উপর ছাতা মেলে ধরেছে। স্টুডেন্ট সবাই একে একে রাস্তা পার হচ্ছে। মীরাও সবার সাথে রাস্তা পার হলো। তারপর রাস্তার একপাশ দিয়ে ছাতা মাথায় নিয়ে চলল সিএনজি স্টেশনের দিকে। কলেজ থেকে কিছুদূর পরেই সিএনজি স্টেশন। দিঘি শুরুর গেইটের পাশেই। মীরা ওখানে এসে সিএনজি বা রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একটা পেলেই সে উঠে যাবে। রাস্তার মানুষজন সব রাস্তার ধারে দোকানপাট গুলোতে ভীড় করেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে যানবাহন থামার নামগন্ধই নেই। মীরা নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিশ মিনিট লেট। কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে হাত নাড়িয়ে চলন্ত একটা রিক্সাকে থামতে বলে সে। কিন্তু রিক্সাটা থামেনি। মীরার ভিষণ মন খারাপ হয়ে যায়। আর কতক্ষণ ছাতা নিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে?
উল্টোদিক থেকে একটা বাইক এসে থামলো মীরার পাশ ঘেঁষে। মীরা একটু চমকে চার কদম পিছিয়ে গেলো। বাইক থেকে নেমে মাথার হ্যালমেটটা খুলতেই মীরা দেখে এ তার তুর্য ভাই। মীরার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে। তুর্য তার বাইকের পিছনে রাখা একগুচ্ছ কদমফুল হাতে তুলে পিছনে লুকিয়ে নেয়, যাতে মীরার চোখে না পড়ে। তারপর মুচকি হেসে মীরার দিকে এগুতে থাকে।
বৃষ্টিতে ভিজে ছুপছুপে অবস্থা তুর্যর। পিছনে থাকা একগুচ্ছ কদমফুল সামনে এনে বাড়িয়ে দিল নিজের প্রিয়তমার দিকে। হাটু গেড়ে বসে পড়লো এক মুহুর্তেই। প্রিয়তমার চোখে চোখ রেখে বলল, “তোর মনটা আমায় দিবি মীরু? আমি তোর মনের সাথে আমার মন মিলিয়ে মেঘ সাইকেলের ডানায় চড়বো। ভেসে ভেসে সারা ভুবন পাড়ি দিব। রাজি আছিস?”
তার প্রিয়তমা স্থির চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। তুর্যর নিজের উপর কনফিডেন্স আছে। তাও কোথাও একটা ভয় কাজ করছে। তুর্যর সেই ভয় কেটে যায় তার প্রিয়তমার ভুবন ভোলানো হাসিতে৷ সেই হাসির মায়ায় পড়ে চোখ বুঝলো তুর্য। তার প্রিয়তমা তার হাত থেকে কদমফুল গুলো নিলো। তুর্য চোখ খুলে দেখলো তার প্রিয়তমার মুখখানি। প্রিয়তমা বলল, “তোমায় নিয়ে আমার তেমন অনুভূতি নেই তুর্য ভাই। কিন্তু আমি তোমার ভালোবাসাকে সম্মান করি। আমি তোমার গাছ হবো তুর্য ভাই। তুমি আমার ছায়া হবে?”
তুর্য বাঁকা হাসে। উঠে দাঁড়ায় নিচ থেকে। প্রিয়তমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়তমার হাত ধরে বাইকে উঠায়। প্রিয়তমা তার হাতে থাকা ছাতাটা বন্ধ করে দেয়। বৃষ্টি ফোঁটায় ভিজতে থাকে শরীর। পাশ থেকে কারো হৃদয় পোঁড়ার গন্ধ ভেসে আসছে। কোনো একজনের হৃদয় ভিষণভাবে পুঁড়ছে। আড়াল থেকে কেউ একজন বলছে, “আপনি একজন উন্মাদ ও সফল প্রেমিক তুর্য। নিজের প্রিয়তমার হাত কখনো ছাড়বেন না। আগলে রাখবেন তাকে। আপনি নির্দ্বিধায় আপনার ভালোবাসার কথা বলতে পারেন তুর্য। কিন্তু আফসোস, আমি পারি না। আমার মাঝে অনেক দ্বিধা। এই দ্বিধার কারণেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটিকে হারালাম। ভালো থাকুন আপনারা।”
–
ঘরভর্তি লোকের সামনে তুর্য মীরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই ওদের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তুর্য কি বলতে চায় সেটা কারোই বোধগম্য হচ্ছে না। শুধু মিরাজই তা বলতে পারবে। তুর্য নিচের দিকে তাকিয়ে মীরার বাবার উদ্দেশ্যে বলল, “আমি মীরাকে ভালোবাসি ফুপা। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”
নিরবতা বিদ্যমান মীরাদের ড্রয়িংরুমে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই তুর্যর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মুহুর্তেই রেগে উঠলেন মীরার দাদি। উনি গর্জে উঠে তুর্যকে বললেন, “আমি আগেই জানতাম এই ছেলের মতিগতি ভালো না। অ্যাঁই ছেলে! আমার নাতনীর হাত ছেড়ে দাও।”
উনি মীরার দিকে একবার তাকালেন। তারপর মীরাকেও বললেন, “তুই পড়ালেখার নাম করে বাহিরে এই ছেলের সাথে ঢলাঢলি করিস? আজমীর, তোর মেয়ে তোর মান সম্মান ডোবাল।”
দাদির এ কথা মীরা মেনে নিতে পারেনি। সে তেড়ে এসে বলল, “একদম ভুলভাল কথা বলবে না দাদি। আমি তুর্য ভাইয়ের সাথে আড়ালে দেখা সাক্ষাৎ করিনি কখনো। তুর্য ভাই আমাকে ভালোবাসে। এবং আমি তার ভালোবাসাকে সম্মান করি। কিন্তু ওর আর আমার মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। ও যদি আমায় বিয়ে করতে চায় তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।”
মীরার দাদি রাগে গজগজ করতে করতে মীরার বাবাকে বললেন, “আজমীর? তোর মেয়ে আমার মুখে মুখে তর্ক করছে। তুই দেখছিস না? কিছু বলছিস না কেন?”
মীরার বাবা আজমীর সাহেব ওনার মা’কে বললেন, “মা তুমি থামো। আমরা বসে কথা বলি একটু?”
আজমীর সাহেবসহ মীরার দাদি সোফায় বসলেন। তুর্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মীরাও চুপচাপ হয়ে আছে। মীরার বাবা বললেন, “তুমি মীরাকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও এটা তো ভালো কথা। তাছাড়া পরিচিতদের মধ্যে আত্মীয়তা হলে খুব বেশি ভালো হবে। তুমি বরং আজ বাড়ি যাও। কাল পরশু তোমার মা বাবাকে এখানে আসতে বলো। প্রস্তাব তো তাদের নিয়ে আসা উচিৎ নাকি?”
এই কথা বলেই আজমীর সাহেব হেসে উঠলেন। তুর্য ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে হাসলো। মিরাজ খুব খুশী হয়েছে। মীরার দাদির ভালো লাগেনি। উনি কখনো মীরার মায়ের পরিবারের কাউকেই দেখতে পারেন না। তাই আজও তুর্যকে উনি নিজের নাতনীর জীনবসঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। বেশি খুশি হয়েছে মীরার মা। তুর্য সালাম দিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো।
তুর্য যাওয়ার পরপরই মীরা তার রুমে চলে আসে। নিজের রুমে এসে দরজাটা ভালোভাবে লাগিয়ে দিল সে। ধীর পায়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। মুখটা মলিন হয়ে আছে তার। কিন্তু তার এখন খুশি হওয়ার কথা। ফোনটা হাতে সে কিছু একটা দেখলো। দেখা শেষ হলেই চেহারায় অন্ধকার নেমে এলো। মীরা নিজে নিজেই বলল, “আজও আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না ইনিস্পেক্টর সাহেব। আপনার উপর জেদ নিয়েই আমি জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে রাজি হলাম। আর কখনো আপনার মুখোমুখি আমি হবো না মিস্টার।”
মীরা এসব বলছে আর তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ভেতরটা হাহাকার করছে তার। এক রাশ অভিমান জমেছে মনের কোণে। সেই অভিমান থেকেই বর্ষণ হচ্ছে চোখে।
ঠকঠক করে দরজায় আওয়াজ পেতেই দ্রুত চোখ মুছে নেয় মীরা। স্বাভাবিক হয়ে বিছানা থেকে উঠে দরজার সামনে গিয়ে পৌঁছায় সে। দরজা খুলে দেখে তার ভাই মিরাজ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। মিরাজ সুরসুর করে মীরার রুমে ঢুকে গেলো। মীরা দরজাটা ভিজিয়ে রাখলো। মিরাজ মীরার বিছানায় বসতে বসতে বলল, “তো কি সিদ্ধান্ত নিলি?”
মীরা ভ্রু কুচকে বলল, “কিসের সিদ্ধান্ত?”
মিরাজ বলল, “বিয়ের ব্যপারে।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মীরা৷ মিরাজ উত্তরের অপেক্ষায় মীরার মুখপানে তাকিয়ে আছে। মীরা বলল, “যা হচ্ছে সেটাই হতে দে ভাইয়া। আমার মনে হয় আমি খুব ভালো থাকব।”
মিরাজ ভ্রু কুচকালো। মীরাকে ইশারা দিয়ে তার পাশে বসতে বলল মিরাজ। মীরা মিরাজের পাশে গিয়ে বসলো। বোনের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মিরাজ। মীরা কি এই বিয়েতে খুশি নয়? মিরাজ বলল, “তুই তুর্যকে ভালোবাসিস?”
“সত্যি বলতে ভাইয়া, আমার তুর্য ভাইয়ার প্রতি তেমন কোনো অনুভূতি নেই যা আমাকে বাধ্য করবে তাকে ভালোবাসতে।”
আশ্চর্য হলো মিরাজ। তাহলে কি মীরা অন্য কাউকে ভালোবাসে? যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে, তাহলে তুর্যকে কেন বিয়ে করতে রাজি হলো? মিরাজ বলল, “তাহলে তুই তুর্যর প্রপোজে রাজি হলি কেন? ওকে বিয়ে করতে চাইলি কেন?”
মীরা কিছুক্ষণ নিরব থাকে। তারপর বলে, “তুর্য ভাই আমার খুব ভালো বন্ধু। আমাদের বয়সের মধ্যে ৫ বছরের ডিফারেন্ট। বাট আমাদের বন্ডিং খুব স্ট্রং। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা। আমার পছন্দ অপছন্দ সবই তুর্য ভাইয়ের জানা। আমি মনে করি আমার লাইফে তুর্য ভাইয়ের মতো একজন থাকা আবশ্যক। আর সে যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে তো কথাই নেই। আমি তুর্য ভাইয়ের ভালোবাসাকে সম্মান করি। আর একজন ভালো বন্ধুই উপযুক্ত জীবনসঙ্গী হয়। তাই রাজি হয়েছি।”
“মীরা তোর মন যা বলবে তা-ই করবি। তোকে কেউ জোর করে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না। তোর ভালো না লাগলে তুই বিয়েতে মত দিস না।”
বোনকে অনেকভাবে বুঝিয়ে তার মনের মধ্যে থাকা গোপন কথাটা বের করার চেষ্টা চালিয়েছিল মিরাজ। কিন্তু তার বোন চাপা স্বভাবের। সে কিছুতেই বলল না তার জীবনে অন্য কারো অস্তিত্ব আছে কিনা। মিরাজ হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মীরা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। এ বিষয়ে সে আর কিছু ভাবতে চায়না।
–
বসে বসে পান চিবুচ্ছেন মীরার দাদি। রাতের খাবারও খাননি উনি। নিজের ছেলের উপর রাগ করে রুমে বসে আছেন। মীরার মা খাবার প্লেটে করে নিয়ে মীরার দাদির রুমে এলেন। তারপর মীরার দাদিকে বললেন, “খাবার টা খেয়ে নিন মা। না খেলে শরীর খারাপ করবে।”
মীরার মায়ের কথায় গর্জে উঠলেন মীরার দাদি। একটা বাটির মধ্যে পানের পিক ফেলে মীরার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর মীরার মা’কে ঝারি মেরে বললেন, “খাবো না আমি। তোমাদের কাছে আমার কথার কোনো দাম আছে? তুমি তো এটাই চেয়েছিলে তাই না? আমার ছেলেকে তো খেয়েছ, এখন আবার আমার নাতনিকে তোমার ভাইয়ের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছো?”
মীরার মা বললেন, “এসব আপনি কি বলছেন মা? তুর্য মীরাকে ভালোবাসে। ও খুব ভালো ছেলে।”
মীরার দাদি বললেন, “হ্যাঁ, তুমি তো বলবেই। তোমার রক্ত যে। আমার সংসার একেবারে শেষ করে দিয়েছ। কত বিষমন্ত্র ঢেলেছ আমার ছেলের কানে।”
মীরার মা চোখ বন্ধ করে নিলেন। চোখ থেকে গরম পানি বের হতে লাগলো ওনার। মীরার ভাবি স্নিগ্ধা এসে সব শুনে নিল। সে দৌড়ে গিয়ে মীরার বাবাকে এসে সব কথা বলে দিল। মীরার বাবা এক মুহুর্ত দেরি না করে মীরার দাদির রুমে এলেন। মীরার দাদিকে কিছু না বলে উল্টো নিজের স্ত্রীকে বললেন, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব উল্টোপালটা কথা শুনছ কেন তুমি? যে বুঝে না তাকে হাজারবার বুঝিয়েও লাভ নেই। চলো, ঘরে চলো।”
মীরার বাবা মীরার মায়ের হাত ধরে মীরার দাদির রুম থেকে মীরার মা’কে নিয়ে চলে গেলেন। মীরার দাদি এটা দেখে রাগে কটমট করতে লাগলেন। মীরার ভাবি স্নিগ্ধা বেশ খুশি হলো নিজের শ্বশুরের আচরণ দেখে৷ সব সময় মায়ের দিকে টানা যায় না, যদি সে ভুল কাজ করে।
চলবে…