#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
মীরা হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে এলো হসপিটালে। ভাইয়ের কাছে সব শুনেছে সে। তীব্র গতিতে রেগে গেছে সে তুর্যর উপর। কেবিনের ভিতরে ঢুকে প্রথমে চোখ গেল ঘুমন্ত তুর্যর দিকে৷ সারা শরীরে চোখ বুলিয়ে দেখে কি নিষ্ঠুর অবস্থা তার। মীরা আস্তে করে এসে তুর্যর পাশে বসল৷ তুর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তুর্যর কথা ভাবতেই কাঁঁন্না পাচ্ছে মীরার। তুর্য হঠাৎ জেগে গেলো। মীরা তাড়াতাড়ি মাথা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল। তুর্য মীরাকে দেখে মুচকি হাসে। বলে, “হাত সরিয়ে নিলি যে? আমার তো ভালোই লাগছিল। দে না আর একটু হাত বুলিয়ে।”
মীরা অন্যদিকে মুখ করে বলে, “তোমার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি। কি বলেছ তুমি ভাইয়ার বন্ধুকে? আমাকে নিয়ে এসব ভাবতে কে বলেছে তোমায়? তোমার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, তোমাকেই বিয়ে করব। আর কাউকে না৷”
“মরা মানুষকে বিয়ে করবি তুই?”
মীরা তুর্যর মুখ চেপে ধরে। করুন কন্ঠে বলে, “তুর্য ভাই!”
তুর্য অপলকভাবে তাকিয়ে আছে মীরার দিকে। মীরা চোখ বন্ধ করে অপরদিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর মীরা নিজেই হাত সরিয়ে নেয় তুর্যর মুখ থেকে। তখন তুর্য বলে,
“তোর ভালোর জন্যই বলেছি মীরু। প্লিজ আমার কথাটা রাখ।”
“আমার ভালো চাইতে হবে না তোমায়। এসব বন্ধ করো।”
“তাহলে তুই আমার কথাটা রাখবি না তাইতো?”
“সম্ভব না, কেন বুঝতে চাইছ না।”
“তাহলে আমি মরেও শান্তি পাব না।”
“আবার? চুপ করো প্লিজ।”
“আহানকে বিয়ে করলে তুই খুব সুখে থাকবি দেখিস।”
“তোমার এই অবস্থায় আমি বিয়ের কথা ভাবব তুর্য ভাই? আমি সুখে থাকতে চাইনা।”
“আমি তোকে সুখী দেখতে চাই। মীরু, নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে নে না।”
“কোনো ভালোবাসা নেই তুর্য ভাই। ওটা একটা মোহ ছিল। সময়ের সাথে ওটা চলে গেছে।”
“মিথ্যা।”
মীরা কোনো কথা বলে না। চুপ করে আছে সে।
“আসব?”
দরজা থেকে কারো গলার আওয়াজ ভেসে আসতেই মীরার চোখ গেলো দরজায়। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে মীরা চমকে যায়। আহান! অপ্রত্যাশিত ছিল মীরার কাছে। কেন এসেছে সে এখানে? তুর্যকে দেখতে? মীরা তুর্যর কাছ থেকে উঠে একপাশে সরে দাঁড়ায়। তুর্য তখন আহানকে বলে, “আসো। তোমার কথাই বলছিলাম।”
আহান ভেতরে আসে। তুর্য বলে, “কি অবস্থা তোমার?”
“মোটামুটি। আপনার?”
“দেখতেই পাচ্ছো। তা কি মনে করে? আমার কথায় কি রাজি তুমি?”
আহান অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, “আমি সে বিষয়ে কথা বলতে আসিনি।”
“তাহলে কেন এসেছ?”
“আপনাকে দেখতে।”
তুর্য হাসলো খানিকটা। তারপর বলল, “যে আর থাকবেই না, তাকে দেখে কি হবে?”
হুট করেই তুর্যর কাশি উঠে যায়। টেবিলের উপর পানির গ্লাস দেখে মীরা যায় সেটা হাতে নিতে। কিন্তু মীরা ধরার সাথে সাথে আহানও ওই গ্লাসে হাত রাখে। দুজনের চোখাচোখি হয়। আহান হাত সরিয়ে নেয়। মীরা তুর্যকে পানি খাইয়ে দেয়। তুর্য কিছুটা স্বস্তি পায়। এরপর মীরা ওখান থেকে চলে যায়। আহান আরও কিছুক্ষণ ওখানে থাকে, তুর্যর পাশে বসে সময় কাটায়।
_
মাঝরাতে চিৎকার করা কান্নার শব্দ কানে বাজতেই ঘুম ভেঙে যায় মীরার। শোয়া থেকে উঠে বসেছে সে। মাথাটাও ব্যথা করছে। কে কাঁদছে? বাসায় কি কিছু হয়েছে? বিছানা থেকে উঠে রুমের লাইট অন করল মীরা৷ টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে খেতে লাগল। কান্নার শব্দ যেন আরও বেশি ভেসে আসছে তার কানে। মীরা নিজের ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে রুমের দরজা খুলে বাহিরে চলে গেল।
নিচে এসে মীরা দেখে বাসার সবাই জড় হয়ে একসাথে বসে আছে। আর মীরার মা কেঁদে কেঁদে অস্থির! বাবা ভাইয়ার মনমরা মুখ। ভাইয়ার চোখে পানি। ভাবি একপাশে বসে তার মা’কে স্বান্তনা দিচ্ছে। মীরা চিন্তিত হয়ে ওদের কাছে গেল। বাবা ভাইয়ার সামনে বসে জিগ্যেস করল, “কি হয়েছে ভাইয়া? মা এভাবে কাঁদছে কেন?”
মীরাকে এই মুহুর্তে সব বলা ঠিক হবে না বলে তারা মনে করেন। তাই তারা মীরাকে কিছুই বলল না। কিন্তু সত্যি তো আর চাপা থাকে না। মীরা বারবার তাদের জিগ্যেস করল কি হয়েছে, কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। তারপর মীরা তার মায়ের কাছে এসে তার হাত ধরে জিগ্যেস করল কি হয়েছে, তার মাও কিছু না বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করতে লাগল। মীরার চিন্তা আরও বেড়ে গেল। একেই তো সে জানে না তার মা কাঁদছে কেন, তার উপর কেউ তাকে কিছু বলছেও না। মীরা তার মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। চ্যাঁচিয়ে বলল, “তোমরা বলবে আমায় কি হয়েছে?”
তখন তার দাদি বলল, “কি আর হবে, তুর্য ছেলেটা মারা গেছে।”
দাদির কথায় মীরার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। দু পা পিছিয়ে গেল সে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল তার। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। এই ধাক্কা সে নিতে পারছেনা। কি শুনলো সে? তুর্য? তুর্য নেই? ওর তুর্য ভাই আর বেঁচে নেই? মিরাজ আর তার বাবা চোখ গরম করে তাকালেন মীরার দাদির দিকে। মীরার বাবা বললেন, “তোমাকে এই কথাটা এখন বলতে কে বলেছে?”
মীরার দাদি কাচুমাচু হয়ে বললেন, “মেয়েটা এতো করে জিগ্যেস করছে তাই আমি বলেছি। রাগ করছিস কেন তোরা? ও তো জানবেই কোনো একসময়।”
ধপ করে কিছু পরার আওয়াজে মিরাজ, বাবা, দাদি, মা আর ভাবি সবাই চমকে উঠে। আওয়াজ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখে মীরা অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পরে আছে। মীরার মা ‘মীরা’ বলে জোরে একটা চিৎকার দিলেন। মিরাজ আর তার বাবা দ্রুত মীরার কাছে গেল। মিরাজ মীরার গালে হাত রেখে আস্তে করে দুটি থাপ্পড় দিয়ে মীরাকে ডাকতে থাকে। মীরার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। মীরার ভাবি গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে ওখানে। মিরাজ পানি হাতে নিয়ে মীরার চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়না। মীরার বাবা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “বারবার নিষেধ করেছিলাম তোমাকে মীরাকে এসব না বলতে। এখন দেখো আমার মেয়ের অবস্থা।”
মীরার দাদি ভয় পেয়ে চুপ করে আছে। মিরাজ তার বাবাকে বলল, “হসপিটালে যেতে হবে আমাদের এক্ষুনি। মীরার পালস কাজ করছে না।”
মিরাজের কথায় ভয় পেয়ে যায় সবাই। মীরাকে কোলে তুলে নেয় মিরাজ। হসপিটালে উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে মিরাজ ও তার বাবা। মীরার মা’কে আসতে নিষেধ করে দেন মীরার বাবা। মীরার মা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে ওখানে।
আহানের কাছে খবর এলো, তুর্য আর নেই৷ আহানও ধাক্কা খেলো। তারচেয়েও খারাপ লেগেছে মীরার কথা শুনে। তুর্যর মৃত্যুর খবর পেয়ে মীরা নাকি হার্ট অ্যাটাক করেছে! মাঝরাতে দুটো শোক সংবাদ পেয়ে আহান আর বসে থাকল না। ছুটে চলল হসপিটালের দিকে। ড্রয়িংরুমে আসতেই তার সৎ মার সম্মুখীন হয় সে। উনি গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করলেন, “এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ?”
আহান ভাবলেশহীনভাবে জবাব দেয়, “তার কৈফিয়ত আপনাকে দিব না। পথ ছাড়ুন।”
“তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হই। আমার বাসায় থেকে আমার মুখের উপরই কথা?”
আহান একটু ভ্রু কুচকে বলে, “আপনার বাসা! কোথায় পেলেন? একেই তো আমার বাবার ঘাড়ে চেপে আমার বাসায় এসেছেন, উপর থেকে আবার আমাকেই শাসাচ্ছেন? আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি৷ এই বাড়িটা আমার নামেই। কে কাকে বের করবে সেটা আমি বুঝব, আপনি নন। পথ ছাড়ুন।”
আহান আর তার সৎ মা’কে কথা বলতে না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আহানের যাওয়ার পর তার সৎ মা বিড়বিড় করে বলল, “কোত্থেকে এতো কথা শিখেছে ছেলেটা? আমি এতো দিন ওকে সরল ভেবে আসছিলাম৷ এখন দেখি আমিই ভুল।”
হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে মীরা। ডাক্তার তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রেখেছে। শ্বাস চলছে, তবে জ্ঞান ফেরেনি। মিরাজ আর তার বাবা কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা খবর পেয়েছে তুর্যকে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স করে। এদিকে মীরার চিন্তায় সবাই অস্থির। তুর্যর বাবা মা মীরার কথা শুনে আরও দূর্বল হয়ে পড়লেন। মাঝরাতে কেউ আসা সম্ভব নয়, তাই যারা কাছাকাছি আছে শুধু তারাই তুর্যর বাসার সামনে এসে ভিড় করেছে। বাকি সবাই কাল সকালে আসবে। গ্রামের বাড়িতে খবর পাঠানো হয়েছে। তারাও ভেঙে পড়েছে। মাঝরাত হওয়ায় তারা কেউই আসতে পারছেননা। কাল ভোঁরেই রওনা হবে সবাই।
আহান সবে এলো হসপিটালে। আহানকে খবর মিরাজই দিয়েছে। আহান আসতেও মিরাজ আহানকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আহান বাকরুদ্ধ হয়ে পরে। এতদিন সে মিরাজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে এসেছে। আর আজ! মিরাজ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এই যন্ত্রণা শুধু মিরাজের নয়, এ যন্ত্রণা আহানেরও।
_
ভোঁরে আজানের ধ্বনি বাজছে চারিদিকে। ঘুমন্ত মানুষরা জেগে উঠছে নামাজ পড়ার জন্য। রবকে ডাকতে হবে, তিনি ছাড়া আর কোনো স্বত্তা নেই। আজানের শব্দে আরও একজন জেগে উঠে, আর সে হলো মীরা। হ্যাঁ, সদ্য তার জ্ঞান ফিরেছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় সে। চারদিক ভালো করে পরখ করে। নিজের অবস্থান দেখে মনে কৌতুহল জাগে! কি হয়েছে তার? হঠাৎ মনে পড়ে যায় রাতের কথা। মুহুর্তেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে মীরার৷ শোয়া থেকে জোর করে উঠে বসে যায়। মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে এলোমেলো শব্দ। মুখের অক্সিজেন মাস্কটা এক ঝটকায় খুলে নিল সে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগল। চিৎকার দিয়ে বলল, “তুর্য ভাই!”
মীরার চিৎকারের আওয়াজ বাহিরে মিরাজ আর আহানের কানে গিয়ে পৌঁছায়। আহান কাল আর বাসায় যায়নি। মিরাজের সাথেই ছিল। মীরার চিৎকার শুনে আহান মিরাজ দুজনেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে। মীরার কাছে গিয়ে দেখে সে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে ফেলেছে। হাতের স্যালাইন নলটাও। মিরাজ দৌড়ে এসে মীরার পাশে বসে। বলে, “এগুলো খুললি কেন?”
“আমি তুর্য ভাইয়ের কাছে যাব ভাইয়া। আমায় নিয়ে চল। তুর্য ভাই আমাকে এভাবে ফাঁকি দিতে পারেনা। সে এভাবে চলে যেতে পারেনা। আমি তার কাছে কৈফিয়ত চাইব। ভাইয়া আমাকে নিয়ে চল।”
আহান মীরাকে শান্ত করার জন্য বলল, “মিস! শান্ত হোন। আমরা সবাই যাব। এভাবে ভেঙে পড়বেন না।”
মীরা ছটপট করতে লাগল। আহান মিরাজকে বলল, “তুই থাক তাহলে, আমি এখন যাচ্ছি। থানা থেকে তুর্যদের বাসায় যাব। তুই ঠিকানা পাঠিয়ে দিস।”
আহান চলে গেল। মীরা বারবার বলতে লাগলো তার ভাইকে, সে তুর্যর কাছে যাবে। মিরাজ চুপ করে রইলো। এই অবস্থায় কি করে মীরাকে নিয়ে যাবে সে? যাওয়া কি ঠিক হবে? চিন্তায় পড়ে যায় মিরাজ।
চলবে…