#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ১৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
এক সাপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। মীরা কলেজে যাওয়ার জন্য রেড়ি হচ্ছে। অনেকদিন হলো কলেজে যাওয়া হয়নি তার। পরিক্ষার নোটিশ দিয়েছে। ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে নোটসও নিতে হবে। কত কাজ বাকি! এই ভেবে সে আজ কলেজে যাচ্ছে। মিরাজ মীরার রুমে এসে দেখে মীরা রেড়ি হচ্ছে। মিরাজ জিগ্যেস করে, “কলেজ যাচ্ছিস?”
মীরা তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
“চল তোকে পৌঁছে দেই।”
“না ভাইয়া, আমি একাই যেতে পারব।”
“ঠাটিয়ে মারব এক চড়। বললাম না আমি পৌঁছে দিব।”
“উফফ, আমি কি ছোট বাচ্চা ভাইয়া?”
“তা হবি কেন!”
“তাহলে? আমি কি কলেজ চিনি না?”
“আমি যখন বলেছি আমি নিয়ে যাব, তখন তুই আমার সাথেই যাবি।”
ভাইয়ের কড়া কথায় দমে গেল মীরা। মনে মনে ভাবছে, কলেজে যাওয়ার আগে অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু তার ভাই যদি তার সাথে যায়, তাহলে তো সে যেতেই পারবে না।
মীরা কলেজ ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। মিরাজ তার বাইক দিয়ে মীরাকে পৌঁছে দিবে। মীরা বাইকে চেপে বসল। অর্ধেক রাস্তা আসতেই মীরা বলল, “ভাইয়া আমি তুর্য ভাইদের বাসায় যাব এখন।”
“ওখানে এখন কি? সোজা কলেজে যা।”
“ভাইয়া প্লিজ, আমি একবার ওখান থেকে ঘুরে আসতে চাই।”
“এখন যাওয়ার দরকার নেই।”
“ভাইয়া আমার খুব অস্থির লাগছে।”
“তুর্য যখন ছিল, তখন তো যেতেও চাইতি না। এখন কেন যেতে চাস?”
মীরা চুপ হয়ে গেল। এই এক সাপ্তাহের মধ্যে পাঁচ বার তুর্যদের বাসায় গিয়েছে মীরা। তুর্যর কববের সামনে বসে নিজের মতো করে কথা বলেছে। তুর্যর কবর ছুঁয়ে দিয়েছে বারবার। তুর্যর ঘরে গিয়ে তার জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছে। খুব কষ্ট হচ্ছিল মীরার।
মিরাজ মীরাকে কলেজে নামিয়ে দিল। মীরা কিছু না বলে কলেজে চলে গেল। মিরাজও নিজের কাজে ব্যাংকে গেল।
_
আহান তার বাবার সামনে বসে আছে। তার বাবা আজকে নিজের ব্যস্ততা রেখে ছেলের সাথে কথা বলার জন্য সময় নিয়েছেন। কিন্তু আহান তার ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। সে চাচ্ছে তার বাবার সামনে থেকে চলে যেতে। কিন্তু পারছে না। একটা বাধা কাজ করছে। আহানের বাবা মোশারফ হোসেন বললেন, “তুমি এতো ছটপট করছ কেন? আমি তোমার সামনে বসে আছি, দেখতে পারছো না?”
আহানের কোনো হেলদোল নেই। তার বাবা পূণরায় বলল, “একটা বিশেষ কথা তোমাকে বলার ছিল। তোমার জন্য আমি মেয়ে দেখেছি। আমি চাই তুমি তাকে বিয়ে কর।”
আহান উত্তেজিত হয়ে যায় মুহুর্তেই সমস্ত মুখে রাগের রক্তিম আভা। সে বলে, “আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।”
“তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?”
আহান থমথমে খেয়ে গেল। পছন্দ তো আছেই। কিন্তু সে কখনোই তার হবার নয়। তার কাছে সুযোগ আসলেও সে সুযোগ ফিরিয়ে দিয়েছে। একমাত্র বন্ধুর কথা ভেবে। বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে। মোশারফ হোসেন বললেন, “কি হলো? কোথায় হারালে? পছন্দ আছে?”
“আমি থানায় যাচ্ছি। আমি কাউকে বিয়ে করব না। আমার কোনো ইচ্ছে নেই।”
গটগট করে বেরিয়ে পড়ল আহান। যেন পালালেই বাঁচে। তার বাবা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লেন। মা মারা যাওয়ার পর ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। লুকিয়ে থেকে সব শুনলেন আহানের সৎ মা। আহান চলে যাওয়ার পর উনি এসে মোশারফ হোসেন এর পাশে বসলেন।
ভনিতা করে বললেন, “কি বলছিলে ছেলেকে?”
মোশারফ হোসেন জবাব দিলেন, “বিয়ের কথা।”
“তা কি বলল তোমার ছেলে?”
মোশারফ হোসেন মুহুর্তেই রেগে গেলেন। উনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,”বারবার আমার ছেলে আমার ছেলে বলো কেন? ও কি তোমার কেউ না? তোমার অবহেলার কারণে আজ আমার ছেলেটার এই দশা হয়েছে। ছেলেটা ঠিক মতো আমার সাথে কথা বলে না। আমাকে বাবা ডাকে না। সব তোমার জন্য হয়েছে। ভুল করেছি তোমায় বিয়ে করে। ভেবেছিলাম ছেলেকে মায়ের অভাব দূর করাতে পারব, কিন্তু না। আমি ব্যর্থ।”
মোশারফ হোসেন উঠে চলে গেলেন। আহানের সৎ মা রাগে ফোসফাস করছেন ওখানেই।
_
ঘড়ির কাটায় এখন একটা বাজছে। মীরা ক্লাস শেষ করেই পরিক্ষার রুটিন নিল। ফ্রেন্ডস এর কাছ থেকে নোটস নেওয়াও শেষ তার। বাসায় ফিরবে এখন। কলেজ গেইটে আসতেই একটা ছেলের মুখোমুখি হয় মীরা। সেই ছেলেটা যে তাকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আহানকে দেখিয়ে বয়ফ্রেন্ড বলে দাবী করায় সে আর মীরার পিছু নেয়নি। তবে আজ হঠাৎ এতদিন পর এলো কেন? মীরার একটু ভয় হয়। কিন্তু যখন ছেলেটা অনুতপ্ত হয়ে কথা বলল তখন মীরার ভয় কেটে যায়।
“মীরা স্যরি। আমি জানতাম না তোমার ভালোবাসার মানুষ আছে। জানলে হয়তো কখনোই তোমার পিছু নিতাম না। আমার ব্যবহারে যদি তুমি বিরক্ত হও তাহলে আমায় ক্ষমা করো।”
“ইটস ওকে ভাইয়া। আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো একজন মানুষকে ডিজার্ভ করেন। আমার কোনো রাগ নেই আপনার উপর। ভালো থাকবেন।”
মীরা আর এক মুহুর্তও দেরি না করে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় একটা সিনএনজি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
এক মাস পরেই তার সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষা। ওকে এখন পড়ালেখায় ফোকাস করতে হবে। হাসপাতাল মোড়ে এসে থামে সিএনজি। ভাড়া মিটিয়ে একটা রিক্সা নেয় মীরা। এই রোদে হেটে বাসায় যাওয়া সম্ভব নয় তার। রিক্সা নিয়ে বাসার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ চোখ যায় রাস্তার ধারে একটা বাইকের দিকে। আসলে বাইক বললে ভুল হবে, বাইকের সাথে থাকা মানুষটার দিকে। মীরা রিক্সা থামাল। রিক্সা ভাড়া দিয়ে সেই বাইকটার কাছে গেল।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
মেয়েলি কন্ঠস্বরে চমকে উঠে আহান। উপরে চোখ তুলে তাকাতে মীরাকে চোখে পড়ে তার। মীরা দেখে ঘেমে একেবারে ছুপছুপে অবস্থা আহানের। গায়ে পুলিশের পোশাকটা লেপ্টে আছে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ছে। মীরার প্রশ্নে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “বাসায় যাচ্ছিলাম, হঠাৎ বাইকটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক করার চেষ্টায় আছি।”
এই বলে আবারও বাইকের কাজ করতে লাগল আহান। মীরা বলল, “উঠুন, আপনি মেকানিক নন। বাইকটা আপতত বাসার সামনে রাখুন। আমাদের বাসায় খেয়ে তারপর আপনার বাসায় যাবেন।
আহান তাৎক্ষনাত উত্তর দেয়, ” না না। আমি আমার বাসায় যাচ্ছি। পরে একসময় যাব।”
মীরা রেগে গিয়ে বলে, “আপনাদের সবার সমস্যাটা কি? কেন আমাদের বাসায় যেতে চাননা আপনারা? আমার দাদির জন্য? ওই মহিলা সেকেলের মানুষ। কি বলতে কি বলে তার ঠিক নেই। তাই বলে আপনি বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিবেন? জানেন ভাইয়া কতটা আপসেড এ বিষয়ে? আপনি চলুন আমার সাথে। ভাইয়া খুশি হবে।”
“কিন্তু এখন তো আপনার ভাইয়া নেই।”
“আমার মা আছেন। উনি খুশি হবেন। আর কিছু? যাবেন এবার?”
আহান আর কিছু বলল না। মীরার এখন খুব রাগ। কিছু বলা ঠিক হবে না। তাই আহান বাইক নিয়ে ঠেলে ঠুলে আস্তে আস্তে মীরার সাথে তাদের বাসায় যেতে লাগল।
বাসায় এসেই মীরা তার মা’কে ডাক দিল। মীরার মা দৌড়ে এলেন। মীরার পিছনে আহানকে দেখে উনি খুব খুশি হলেন। ছেলেটা সেই কবে তাদের বাসায় এসেছে। এতদিন পর তাকে দেখে সত্যিই মীরার মায়ের ভালো লাগছে। মীরা ফ্রেশ হতে চলে গেল তার রুমে। যাওয়ার আগে স্নিগ্ধাকে বলল আহানকে যেন তার ভাইয়ের শার্ট পেন্ট দেয়। ফ্রেশ হয়ে ওগুলো পড়বে।
ফ্রেশ হয়ে এসে দুজনেই খাবার টেবিলে বসলো। মীরার মা ও ভাবি তাদের খাবার সার্ভ করে দিচ্ছেন। মীরার মা আহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি আজ এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি জানো। আজ কোনো কিছুতেই ঝাল নেই। খাও বাবা।”
আহান বলে, “আপনারা না ঝাল খান?”
“হ্যাঁ খেতাম। এখন কমিয়ে দিয়েছি। আসলে মীরার বাবা একটু অসুস্থ, এতো ঝাল খেলে ওনার ক্ষতি হবে। তাই সবাই এক রকমেই খায়।”
“অহ্।”
মীরার মা আহানের পাতে বড়ো বড়ো মাছের পিস তুলে দিচ্ছেন। সাথে মাংসও কয়েক পিস দিলেন। আহান এসব দেখে করুন সূরে বলল, “আন্টি এসব কি করছেন? আমি কি রাক্ষস নাকি? আমি এতো খেতে পারব না। এক পিস করে দিন।”
মীরার মা ধমক দিয়ে বললেন, “চুপচাপ খাও তো। আমার সামনেই সব খাবে তুমি। না খেয়েই তো শরীরের এই অবস্থা করেছ, খেয়ে নাও।”
মীরার মায়ের ধমক খেলেও এক পিস মাছ আর এক পিস মাংস আহান উঠিয়ে রেখেছে।
“মাপ করবেন আন্টি। এতো খেতে পারব না। এগুলোই অনেক।”
মীরা প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করতে করতে সব দেখছিল। আহানের চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিল। মীরার ভাবি ও মা সরে যেতেই আহান মীরাকে প্রশ্ন করল, “পড়াশোনা কেমন চলছে আপনার?”
মীরা একটু চুপ থেকে বলল, “ভালো।”
আহান আর কিছু জিগ্যেস করল না। কিন্তু মীরা চুপ থাকল না। সে আহানকে জিগ্যেস করে, “আপনি বাইক চালান কবে থেকে?”
“এইতো কিছুদিন হলো বাইকটা নিলাম। থানায় যেতে কষ্ট হয়।”
“বাইক চালাতে পারেন?”
“তেমন পাকাপোক্ত না। অল্প অল্প পারি।”
“সাবধানে চালাবেন। কখন কি হয় বলা যায়না।”
“ধন্যবাদ।”
এরপর দুজনেই চুপ। খাবার খেয়ে উঠে যায় দুজনেই। একটুপর মিরাজ আসলে তার সাথে দেখা করে আহান চলে যায়৷ মীরা তার বারান্দা থেকে আহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চলবে…