#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব ২০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকাল সকাল কারো চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় মীরার। লাফ দিয়ে উঠে বসে বিছানায়। নিচ থেকে ঝগড়ার আওয়াজ কানে আসছে তার। শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিল মীরা। গুটিগুটি পায়ে হেটে নিচে চলে গেল।
নিচে এসে দেখে বিরাট হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। আহান ও তার সৎ মায়ের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আহানের সৎ মা আহানকে কিছু বলেছে, যার উত্তরে আহান বলে, “একদম আমার কাজ নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। আমি সৎ ভাবে কাজ করি। আপনার চেয়ে আমার পোশাকটার দাম অনেক।”
“ঘুষ নিয়ে টাকার পাহাড় বানাচ্ছ। বাবার সম্মান চোবাচ্ছ।”
আহান এবার বেজায় রেগে গেল। “মুখ সামলে কথা বলুন। আমি ঘুষ নেইনা। যেচে কথা বলতে আসেন কেন আপনি?”
মীরা হতবাক হয়ে আছে। আয়ানকে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আয়ানের কাছে গেল। জিগ্যেস করল, “কি হলো হঠাৎ?”
“মায়ের ঝগড়া করতে ইচ্ছে করেছে। ভাইকে শুধুই রাগায়।”
“তুমি কিছু বলছ না কেন?”
“আমি বললে কিছু হবে না। বাবা বাসায় নেই, সে বললে হয়তো দমে যেত দুজন।”
মীরা আর কিছু ভাবল না। ওদের ঝগড়ার মাঝেই আহানের হাত ধরে তাকে নিয়ে সোজা উপরে চলে এলো। আহান বিছানায় বসে রাগে ফুসছে। মীরা বলল, “আপনি ওনার সাথে এভাবে কথা বলেন কেন?”
“তো কি করব? আমি ওনাকে ঘৃণা করি। চরম ঘৃণা।”
“কি আশ্চর্য! তাই বলে এভাবে চিৎকার
চ্যাঁচামেচি করে ঝগড়া করবেন?”
“উনি আমার কাজ নিয়ে কটুকথা বলবেন কেন? পুলিশের কাজ করি বলে কি এই আমি ঘুষ খাই? আমাকে কি আপনার এমন মনে হয়?”
“আমি কখন বললাম এই কথা?”
“কিন্তু উনি বলেছেন। আর যাই হোক, আমার সততার দিকে যে আঙুল তুলবে; আমি তাকে ছেড়ে কথা বলব না।”
“আচ্ছা শান্ত হোন। আপনি ডিউটিতে যাবেন না?”
আহান শান্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“আমায় একটু কলেজে নামিয়ে দিবেন?”
“ব্রেকফাস্ট করে রেড়ি হয়ে নিন।”
মীরা সৌজন্যে হাসি দিল। আহান উঠে মীরার জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলো। মীরা হাতমুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট সেড়ে নিল। এরপর কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। আহান ও মীরা নিচে নামতেই আয়ানের সাথে দেখা হয়। আয়ান মীরাকে দেখে বলল, “কলেজ যাচ্ছ?”
আয়ানের কথার জবাবে আহান বলল, “সাথে ভাবি যোগ করবি। কলেজ যাচ্ছ ভাবি?”
আয়ান বিড়বিড় করে বলল, “এখন নাকি এই ঝগড়ুটে মেয়েটাকে আমায় ভাবি ডাকতে হবে।”
আহান ভ্রু কুচকালো। জিগ্যেস করল, “কিছু বলছিস?”
আয়ান হকচকিয়ে উঠে বলল, “নাহ্ কই। কিছুনা।”
আয়ান বেরিয়ে গেল বাহিরে৷ মীরা বলল, “ও এমন কেন?”
“জানা নেই।”
আহান মীরাকে তার বাইকের পিছনে বসিয়ে রওনা দিল। কলেজের সামনে এসেই মীরাকে নামিয়ে দিল আহান। “আমি আসছি মিস। আপনার ক্লাস শেষ হলে চলে যবেন। টাকা আছে?”
“হ্যাঁ, আছে। একটা কথা বলব?”
“বলুন।”
“আমি কি আপনার থেকে অনেক বছরের বড়ো?”
“নাতো। কেন?”
“তাহলে আপনি কথায় কথায় আমাকে আপনি বলেন কেন? নিজেকে বুড়ী বুড়ী লাগে।”
ঠোঁট উলটিয়ে বলল মীরা। আহান খানিক হাসলো। বলল, “অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে।”
“এখন থেকে এই অভ্যাস পরিবর্তন করুন। তুমি বলে ডাকবেন।”
“চেষ্টা করব।”
“চেষ্টা না। বলতেই হবে।”
“আচ্ছা। তুমি”
“সাবধানে যাবেন।”
“আচ্ছা।”
_
দুপুরের দিকে মীরা কলেজ থেকে ফিরে আগে ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। আহান এখন আসবে না মনে হচ্ছে। তাই সে নিজেই কিচেনে গেল। দেখল শুধু ভাত রান্না করা আছে। মীরা কখনো রান্নাবান্নার ধারে কাছে যায়নি। যায়নি বলতে ভুল হবে, কখনো তাকে যেতে হয়নি। তার মা সবমসময় একা হাতে রান্না করেছেন। মেয়েকে তিনি চুলোর কাছেই আসতে দিতেন না। কিন্তু এখন মীরার মনে হচ্ছে রান্নাটা শেখা উচিৎ ছিল। মীরা ভাবে সে ডিম ভাজি করে খেয়ে নিবে। ফ্রীজ থেকে একটা ডিম বের করে সে। চুলোয় তেল গরম করতে দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে৷ যখন পেঁয়াজসহ ডিমটা কড়াইয়ে ছাড়ল, ওমনি আগুন উপরে উঠে গেল। মীরা ভয়ে এক চিৎকার দিল। তেল বেশি গরম হয়ে যাওয়ায় আগুন উপরে উঠে গেছে। চুলোর সুইচেও আগুন চলে আসে৷ মীরার হাত পা কাঁপতে থাকে। হতভম্ব হয়ে যায় সে। ভয় পেয়ে কানে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়ে। এদিকে মীরার চিৎকার শুনে আয়ান দৌড়ে আসে রুমে। কিচেনরুমে চোখ পড়তে দেখে কড়াইয়ে আগুন জ্বলছে, মীরা নিচে বসে কাঁপছে। আয়ান আগে একটা টাওয়াল নিয়ে সুইচটি বন্ধ করে দিল। এরপর কড়াইটা কাপড় দিয়ে ধরে বেসিনে রেখে তাতে পানি ঢেলে দিল। আগুন বন্ধ হওয়ার পর মীরাকে ধরে উঠাল।
“তুমি ঠিকাছ ভাবি?”
মীরা উপর নিচ মাথায় নাড়িয়ে জানায় সে ঠিকাছে। আয়ান মীরাকে ধরে রুমে নিয়ে আসে। বিছানায় বসিয়ে এসি চালু করে দেয়। আহানকে কল করে সবটা জানায়। মীরার কাঁপাকাপি এখনো যায়নি। আয়ান আশ্বাস দিয়ে বলে, “ভয় পেও না। ভাই আসছে।”
পিয়াওমি দৌড়ে এলো মীরার কাছে। মীরা পিয়াওমিকে জড়িয়ে ধরে থম মেরে বসে আছে। আয়ান নিচ থেকে মীরার জন্য এক প্লেট খাবার নিয়ে আসে। সৌজন্য হাসি দিয়ে বলে, “খিঁদে পেয়েছে তোমার? নাও, খেয়ে নাও।”
মীরা কাঁপাকাঁপা গলায় বলে, “তোমার ভাই যদি রাগ করে?”
আয়ান হাসতে হাসতে বলল, “ওই ব্যাটা রাগ করবে! তাও আমার সাথে? আমি দিয়েছি শুনলে কিচ্ছু বলবে না।”
আয়ানের হাত থেকে খাবার নিয়ে মীরা খাওয়া শুরু করে।
–
ঘন্টা খানিক এর মধ্যে আহান বাসায় এসে উপস্থিত হয়। আর এসেই সোজা রুমে চলে আসে। মীরা তখন পিয়াওমির সাথে বসে খেলছিল। আহান ধপ করে মীরার পাশে বসে ওর হাত পা দেখতে থাকে। মীরা হকচকিয়ে উঠে বলে, “আরে, আরে। কি করছেন!।”
“কোথাও পুঁড়ে যায়নি তো?”
“আমি ঠিকাছি।”
“কেন গেলেন ওখানে?”
“রান্না তো কিছুই হয়নি, খিদে পেয়েছিল তাই…”
“আমায় বলতেন, আমি খাবার নিয়ে আসতাম।”
“আপনার নাম্বার তো নেই আমার কাছে।”
“আর কখনো এমন করবেন না। জানেন আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম? ছুটতে ছুটতে এসেছি। আজ মেজাজ গরম ছিল তাই রান্না করে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি রান্না জানেন না, না?”
“নাহ্। কখনো বাসায় রান্না করিনি। আম্মু আমাকে যেতেই দেয়নি। শুধু বলেছে নিজের পড়ায় ফোকাস করতে। এসব পরেও শেখা যাবে। কিন্তু আজ মনে হলো ভুল করে ফেলেছি। শেখা উচিৎ ছিল আমার।”
“আপনাকে রান্না করতে হবে না। আপনার ভাইকে আমি কথা দিয়েছি। আপনাকে বিপদমুক্ত রাখব, কিন্তু এমন হলে তো রিস্ক।”
“আপনি আমাকে আবার আপনি বলছেন।”
“অভ্যাস এতো সহজে যায়না। খেয়েছেন?”
“আপনার ভাই এনে দিয়েছে খাবার।”
“বারবার বারণ করার পরেও ও কেন নিচ থেকে খাবার আনে!”
“আপনি ওদের সাথে সব মিটমাট করলেই তো পারেন।”
“বাদ দাও। রেস্ট নাও।”
মীরা খুশি তে গদগদ হয়ে বলে, “এই! আপনি আমাকে তুমি বললেন?”
“মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।”
“যখন বের হয়েই গেছে তখন কন্টিনিউ করবেন।”
“আপনার সাথে আমি পারব না। রেস্ট নিন।”
এই বলে আহান ফ্রেশ হতে চলে গেল। মীরা শুয়ে শুয়ে পিয়াওমির সাথে খেলতে লাগল।
ক্রিংক্রিং করে মীরার ফোনটা বেজে উঠল। মীরা ফোনের স্ক্রীণে তাকিয়ে দেখে যে তার ভাই ফোন করেছে। মীরা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মিরাজ জিগ্যেস করে, “কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তোরা সবাই?”
“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ। শোন তোকে একটা খুশির সংবাদ দেওয়ার আছে।”
“কি? কাল আমরা সবাই আসছি তোদের বাসায়।”
মীরা লাফ দিয়ে উঠে বলল, “সত্যি ভাইয়া? কে কে আসবে?”
“আমি, তোর ভাবি, দিবা আর ইরা।”
মীরা মন খারাপ করে বলে, “মা বাবা আসবে না?”
“ওনারা অন্য একদিন আসবেন। আহানকে বলিস।”
“আমি কেন বলব? তোর বন্ধুকে তুই বলবি!”
“তোদের মধ্যে সব ঠিকঠাক তো?”
“হ্যাঁ।”
“বকাঝকা করছিস নাতো আমার বন্ধুকে।”
“কি স্বার্থপর ভাইরে তুই! শুধু নিজের বন্ধুর কথাই ভাবছিস। নিজের বোনের কথা ভাবছিস না?”
“এখন ভাবার সময় নেই। আমার বন্ধু আছে না, সে-ই ভাববে।”
“ফোন রাখ।”
মীরা টুস করে ফোন কেটে দিল।
চলবে…