#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
হসপিটালের করিডরে দাঁড়িয়ে ঝিমাচ্ছে মীরা। সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। আহানের চিন্তায় একেবারে নাজেহাল অবস্থা তার। ডাক্তার বলেছেন জ্বরের সাথে সাথে পেসারও লো হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর নিয়ে আসলে কি যে হতো! এখন চিকিৎসা চলছে আহানের। ওদিকে বাসায় কাউকে জানানো হয়নি। আয়ান জানাতে চায়নি। ডাক্তারের পিছনেই ছুটে বেরিয়েছে সে। মীরাকে ঝিমাতে দেখে আয়ান বলল, “ঘুম পেয়েছে?”
মীরা হকচকিয়ে গেল। বলল, “নাহ্। ওই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল।”
“তুমি বেঞ্চিতে বসতে পারো। খাবে কিছু? নিয়ে আসব?”
“না, না। তার আর দরকার নেই। বলছি যে উনি এখন কেমন আছেন?”
“আরও দুদিন এখানে থাকতে বলেছেন ডক্টর। আমাকে তো বাহিরে যেতে হবে। তুমি থেকো।”
“আমি! কিন্তু তোমার মা বাবা কিছু জিগ্যেস করলে কি বলবে?”
“তুমি তোমার বরের কাছে থাকবে, এখানে ওনারা কি বলবেন?”
“তুমি অন্যভাবে নিচ্ছ আমার কথা! তুমি এখনো ওনাদের জানাওনি তোমার ভায়ের অবস্থার কথা। যদি জিগ্যেস করে আমরা কোথায় তখন তুমি কি বলবে সেটাই জিগ্যেস করছি।”
আয়ান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “অহ এই কথা! বলব নে সত্যি টা।”
“ওনার জন্য খাবার?”
“বাসা থেকে নিয়ে আসব।”
“উনি যদি না খান, তবে?”
“ওর ঘাড় খাবে। দেখে রাখবা কিন্তু।”
“আমি তো দেখেই রাখব।”
“আমি যাই তবে কেমন?”
“সেকি! তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করবে না?”
“ও এখন ঘুমুচ্ছে। আমি দুপুরের আগে আসব খাবার নিয়ে। একটু কলেজে যেতে হবে। আচ্ছা তুমি কি বাংলা নিয়ে পড়ছ না বিজ্ঞান?”
“আমি ইংরেজি নিয়ে পড়ছি।”
“সত্যি! ভেরি গুড।”
“তোমার সন্দেহ আছে?”
“অ্যাঁই না। আমি সেটা বলিনি।”
“হুম।”
“আল্লাহ হাফেজ। আমি ফল কিনে কেবিনে রেখেছি। তুমি আর ভাই মিলে খেয়ে নিও।”
আয়ান চলে গেল ওখান থেকে। মীরা আস্তে করে আহানের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উঁকি দিয়ে দেখে আহান উঠেছে কিনা। আহান ঘুমাচ্ছে এখনো। মীরা আস্তে করে আহানের কেবিনে ঢুকে। একটা চেয়ার নিয়ে আহানের সামনে নিয়ে বসে৷ আহানের মাথায় হাত দিয়ে চুকে হাত বোলাতে থাকে। সুস্থ ছেলেটার এক মুহুর্তে কি হয়ে গেল!
হঠাৎ করেই আহানের ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ মেলে প্রথমে মীরাকে দেখতে পেল। কিন্তু মীরা এক ধ্যানে আহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ও খেয়ালই করেনি যে আহান জেগে গেছে। আহানও চুপচাপ মীরাকে দেখছে। মীরা ক্রমান্বয়ে আহানের চুলে হাত বোলাতে থাকে। আহানের এটা বেশ ভালো লাগলো। প্রথমবার মীরা আহানের এমন যত্ন নিচ্ছে। মীরার যখন ধ্যান ভাঙে, চোখ পড়ে আহানের চোখে; তখন সে থমকে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় সে। চুল থেকে হাত শরীরে নিয়ে ধপ করে চেয়ের থেকে উঠে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোখ বন্ধ করে লজ্জায় মরে যাচ্ছে সে। আহান পিছন থেকে বলে উঠে। “উঠলে কেন? মাথাটা ব্যথা করছে, আর একটু হাত বুলিয়ে দিবে?”
মীরা কিছু বলল না। পিছন ফিরে চেয়ারে বসে পড়ল। আহানের দিকে না তাকিয়েই আহানের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আহান বলে, “আমি তুর্যর মতো উন্মাদ প্রেমিক নই মীরা। ওনার মতো করে হয়তো আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। ওনার মতো পাগলামি আমি করতে জানি না। কিন্তু আমি তোমাকে আগলে রাখব, যত্ন নিব; আমার মতো করে তোমাকে ভালোবাসব।”
মীরা চুপ হয়ে যায়। তুর্যর কথা তার মনে পড়ে যায়। কত পাগলামি করত সে মীরাকে নিয়ে। কিন্তু মীরার যে তার প্রতি মন যায়নি, গিয়েছে এক শান্ত সৃষ্ট ছেলের উপর। তুর্য বেঁচে থাকলে হয়তো মীরাকে বিয়ে করতো না। যেহেতু সে আহানের বিষয়টা জেনে গেছে। কিন্তু মীরা তো চায়নি তুর্য এভাবে চলে যাক তার জীবন থেকে। মীরার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তুর্য৷ তাকে হারিয়ে মীরা ভালো নেই।
_
দুপুরের দিকে আহানের বাবা এলেন আয়ানের সাথে। আয়ান খাবার নিয়ে এসেছে। বাবাকে দেখে আহান চমকে উঠে। আয়ান কি তবে সব বলে দিয়েছে? আহানের বাবা তার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আহান চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। আয়ান টিফিনবাক্স টা মীরার হাতে দিল। মীরা একটা প্লেট নিয়ে আহানের জন্য খাবার সার্ভ করে দিল। আহানের বাবা বললেন, “কেন নিজের অসুস্থতার কথা লুকিয়ে রাখতে চাও বাবার কাছে? বাবার কি খারাপ লাগে না? বাবার কি কষ্ট হয়না?”
আহান ছোট করে জবাব দিল। “আমার কিছু হয়নি।”
“আয়ান সব বলেছে আমাকে। কিছু না হলে তো আর তুমি এখানে থাকতে না। বাবা কি এতোই পর হয়ে গেলাম?”
“আমি বললাম তো আমার কিছু হয়নি।”
আহানের বাবা কষ্ট পেলেন। তিনি মন খারাপ করে উঠে গেলেন ওখান থেকে। ঝাপসা চোখ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা যাওয়ার পর আয়ান ভাইকে বলে, “এটা ঠিক করলি না ভাই। বাবা কষ্ট পেয়েছে। তোর সব রাগ তো আমার মায়ের উপর। তাহলে বাবাকে কষ্ট দিস কেন?”
আহান চুপ করে রইল। মীরা আয়ানের পাশে এসে দাড়াল। আয়ানকে আস্তে আস্তে বলল, “তুমি যাও, আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলব।”
আয়ান মেজাজ দেখিয়ে চলে গেল ওখান থেকে। মীরা আহানের সামনে খাবার ধরে বলে, “হা করুন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
“খিদে নেই।”
“এতো জেদ কিসের আপনার? আপনি কি ভাবেন, আপনি যা করেন সব ঠিক? আর বাকিরা ভুল?”
“আমার এখন খিদে নেই মীরা।”
“আমাকে এতো কিছু বোঝাতে আসবেন না। হা করুন, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। এরপর আর একটা কথাও যদি আপনার মুখ থেকে বের হয়, তাহলে কিন্তু আমি আপনার মুখ সেলাই করে দিব। আপনি এখনো মীরাকে চিনেন না। মীরার রাগ উঠলে সে অনেক কিছুই করতে পারে। মানুষ খুনও করতে পারে। পরে না আপনাকে নিজের বউয়ের হাজতবাস দেখতে হয়।”
“মীরা!!”
“আমি এমনই। খেয়ে নিন, নয়তো অন্য কিছু দেখবেন।”
আহান বাধ্য হলো। ভালো ছেলের মতো মীরার হাতে খেতে লাগলো। মীরার চণ্ডী রুপ আজ সে প্রথম দেখল। আহানকে খাওয়ানোর সময় মীরা এর ফাঁকে জিগ্যেস করল। “আপনাকে দেখে আমার রাগ হয়। বাবার সাথে মানুষ এভাবে কথা বলে? বাবা আমাদের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করে, কত কঠোর পরিশ্রম করে। আপনি যদি ছেলে হয়ে বাবার কষ্ট না বুঝেন, তাহলে কিভাবে হবে? শুধু মাত্র দ্বিতীয় বিয়ে করায় আপনি তাকে এখন সহ্য করতে পারেন না। উনি কি নিজের জন্য এ কাজ করেছেন? উনি আপনাকে নতুন মা এনে দিতে চেয়েছেন, যাতে সে আপনাকে ছেলের মতো আদর করে। কিন্তু আপনার ভাগ্য খারাপ, তাই আপনি নতুন মায়ের আদর স্নেহ পাননি। এতে আপনার বাবার কি দোষ? উনি কি জানতেন এমন হবে? জানলে তো আর উনি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেন না। আপনি আপনার বাবাকে কষ্ট দিবেন না। তাকে ভালোবাসবেন, যত্ন নিবেন। ভালো করে কথা বলবেন, তাহলে দেখবেন আপনারও ভালো লাগছে আর ওনারও ভালো লাগছে।”
“আর আয়ানের মা? তার কি হবে? ওই মহিলাকে আমি সহ্য করতে পারিনা।”
“আপনি না একটু ত্যাড়া আছেন। আপনার মা’কে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। এরপরও যদি উনি না বুঝেন, তাহলে কিছু করার নেই। তবে চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।”
“ওনার স্পর্শও আমার চাইনা।”
“ছোটবেলায় তো চাইতেন। কি! চাইতেন না?”
“চাইতাম, কিন্তু উনি আমায় বারবার ফিরিয়ে দিয়েছেন, অবহেলা করেছেন, অপমান করেছেন।”
“একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন। একদিন উনি নিজেই আপনাকে কাছে টেনে নিবেন।”
“আমি জানি না।”
“জানতে হবে না। এখন খেয়ে নিন তো। আমারও খুব খিদে পেয়েছে। আপনার মা কিন্তু রান্না ভালো করেন।”
“আয়ানের মা।”
“আপনার কেউ হয় না?”
“না।”
“আচ্ছা! আমিও দেখি কতদিন এভাবে চলে আপনাদের।”
মীরা আহামের খাওয়া শেষ করিয়ে ওর ঔষধগুলো চেক করে খাওয়ায়। এরপর সে নিজেই একটা প্লেটে খাবার সার্ভ করে খেতে বসে যায়। আহান চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
–
রাতেরবেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আহানের। চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে মীরাকে দেখতে পায়না সে। আহান শোয়া থেকে উঠে বসে। কোথায় গেল মীরা? কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও মীরা এলো না। কবিনের আশে পাশেও তাকে দেখা যাচ্ছে না। আহানের এবার দুশ্চিন্তা বাড়ল। কি হলো মীরার! তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা কেন। আহান নিজের বেড থেকে উঠে যায়। কেবিন থেকে বেরিয়ে চারপাশে পরখ করে নেয়। কিন্তু মীরাকে কোথাও পায়না। আহান ঘামড়ে যায়। এই রাতে কোথায় গেল মেয়েটা। কেবিনের বা’দিকের রাস্তা দিয়ে দৌড় দিল একপ্রকার সে। চোখ বুলিয়ে মীরাকে খুঁজে চলেছে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পড়ে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে মীরাকে। তাকে না পেয়ে আহান যেন আরও ছটপট করতে থাকে। জলজ্যান্ত একটা মেয়ে, রাত-বিরেতে কোথায় যাবে? আহানের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে। মুখে হাত দিয়ে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল। পা চালিয়ে আরও খুঁজতে লাগলো মীরাকে। হঠাৎ একটা কেবিনের সামনে এসে আহান থমকে দাড়াল। মীরাকে চোখে পড়ল তার। একটা ছোট মেয়ের সাথে বসে কি যেন বলছে। আর সাথে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আহান কৌতুহল নিয়ে ওখানে গেল৷ মীরা আহানকে দেখেই চমকে উঠল। মুচকি হেসে বলল, “আপনি এখানে! উঠে গেলেন কেন?”
“এখানে কি করছিলে?”
গম্ভীর হয়ে বলল আহান। মীরা স্মিথ হেসে বলল, “কিছুনা এমনি।”
“তুমি জানো, আমি তোমাকে কখন থেকে খুঁজে চলেছি? সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজছি। তোমাকে না দেখতে পেরে আমার কতটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তুমি জানো? না বলে রাতে এখানে সেখানে কেন ঘুরছ তুমি?”
আহানের চোখে মুখে রাগের আভা। কথাগুলো সে রাগ থেকেই বলেছে। মীরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আহান এবার ধমকের সুরে বলল, “জবাব দিচ্ছ না কেন?”
মীরা এবার কেঁপে উঠে। আহান এতটা রাগ করবে সে ভাবেনি। মীরা বলল, “আমি আসলে…”
“চলো আমার সাথে।”
মীরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আহান মীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওখান থেকে। ছোট মেয়েটি ও তার মা হা করে তাকিয়ে রইলো। আহান মীরাকে নিয়ে তার কেবিনে এলো। মীরাকে চেয়ারে বসিয়ে বলল, “এখান থেকে তুমি এক পাও নড়বে না। আর সকাল হলেই হসপিটাল থেকে চলে যাব আমরা।”
“কিন্তু আপনি তো এখনো উইক!”
“আ’ম ফাইন। দেখছ না আমি কত ভালোভাবে হাটতে পারছি। তাও কেন শুধু শুধু এখানে পড়ে থাকব?”
“আপনার যা ভালো মন চায় করুন।”
মীরাও অভিমান করল। চুপ করে বেডের কাছে মাথে রেখে শুয়ে পড়ল। মীরাকে আর ডিস্টার্ব করল না আহান। সে নিজেও গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ল। ক্ষানিক পর পর মীরাকে উঁকি মেরে দেখছিল সে। কিন্তু মীরা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। আহান ভাবল, কষ্ট দিয়ে ফেলল না তো আবার। এর যা রাগ, না জানে কি করতে কি করবে। সকাল হোক, সব রাগ অভিমান মিটিয়ে নিবে সে। এই ভেবে আহান চোখ বুজে।
চলবে…