#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
রোদৌজ্জ্বলের দিন। ঝলমলে রোদ্দুর শহর জুড়ে। শরতের শেষ। হেমন্তের আগমন। আর হেমন্তে মানেই নবান্ন। ঘরে ঘরে উৎসব। লোকজন পাঁকা ধান ঘরে তুলবে। সেই ধান থেকে চাল হবে। আর নতুন চালের গুড়ি দিয়ে হরেকরকম পিঠা তৈরি হবে। সে পিঠা খাওয়ার মজাই অন্যরকম। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এ সময় উৎসব হয় প্রচুর।
মীরা সাজ সকালে উঠে চমকে গেল যেন! ফোনে একটা কল এসেছে। আননোন নয়, নাম সেভ করা। আয়ানের নাম ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। হঠাৎ আয়ান তার ফোনে ফোন দিল কেন? আহান যাওয়ার আগে আয়ান আর আহান দুজনেরই নাম্বার মীরাকে দিয়ে যায়। মীরা কখনো আয়ানকে কল দেয়নি। কিন্তু আয়ান তার নাম্বার কোথায় পেল? কে দিল তাকে? আহান কি! এসব ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। মীরা আফসোস করলো। কিন্তু এরপরই আবারও ক্রিং করে মীরার ফোন বেজে উঠে। আয়ান দ্বিতীয় বার ফোন করেছে। মীরা আর চিন্তা না করে কলটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে আয়ান বলে উঠে, “আসসালামু আলাইকুম।”
মীরা কিংকর্তব্যবিমুঢ়!
আয়ান আজ প্রথমবার মীরাকে সালাম দিল। আগে তো কথাই বলতে চাইতো না। শুধু তাকে দেখলেই তেড়ে এসে ঝগড়া করতে চাইতো। কিন্তু আজ এতো পরিবর্তন দেখে মীরার সত্যিই খুব ভালো লাগলো। মীরাও সুন্দর করে সালামের জবাব দেয়। “ওয়া আলাইকুমুস সালাম দেবর জি।”
আয়ান হাসলো। এপাশ থেকে সেই হাসির শব্দ মীরার কানে আসলো। মীরা বলল, “আজ হঠাৎ কি মনে করে ভাবিকে কল দিয়েছ?”
“আই মিস ইউ ভাবি।”
মীরা দ্বিতীয় দফা চমকে উঠে। এসব কি হচ্ছে তার সাথে। এটা আয়ান না অন্য কেউ? আয়ান আবারও বলল, “পিয়াওমিও তোমাকে মিস করছে। তুমি আসবে না? তোমাকে তো আমার খুব প্রয়োজন ভাবি।”
“কেন?”
“তোমাকে তো বলেছিলাম আমার মা আর ভাইকে এক করে দিতে। তুমি তো ওখানে পড়ে আছো। কবে আসবে তুমি? তুমি চেষ্টা করবে না বলো?”
মীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “এ জন্যই আমায় মিস করছিলে?”
“তোমায় ছাড়া বাসাটা কেমন যেন হয়ে আছে। তোমার সাথে ঝগড়া করাটা খুব মিস করছি। বোনকে তো মিস করব ই বলো।”
“বোন?”
চোখ বড়ো বড়ো করে মীরা বলল। আয়ান স্মিথ হাসলো। “হ্যাঁ, বোন। তুমি আমার ভাবি কম বোন বেশী। সম্পর্কের দিক দিয়ে ভাবি হলেও তোমায় আমি বোনের চোখে দেখি। একটা বোনের অভাব সবসময় অনুভব করি আমি। যখন তুমি আমাদের বাসায় এলে প্রথমে আমার রাগ হলেও শেষে তোমাকে দেখে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। তুমি অনেক ভালো মেয়ে।”
“আমার এতো প্রশংসা! বাপরে। আপনি কি সত্যিই আয়ান বলছেন?”
“অ্যাঁই! একদম মজা নিবে না। আসছ কবে বলো।”
“আর মাত্র দুই তিনদিন।”
“আচ্ছা। মিস ইউ।”
“মিস করলে চলে আসো এখানে।”
“কেউ কিছু বললে?”
“তুমি তোমার ভায়ের শ্বশুর বাড়িতে আসবে, এখানে কে কি বলবে?”
“আমার আর আমার ভাইয়ের সম্পর্কটা বাহিরের লোক ভালো চোখে দেখে না।”
“শোণ, সবাই এক ম্যান্টালিটির মানুষ না। কেউ কিছু বলবে না। আজ বিকেলে চলে এসো।”
“সত্যি বলছ? আসব?
“মিথ্যা বলব কেন? পাগল নাকি তুমি?”
“আচ্ছা ঠিকাছে আসব।”
“ওকে। বায়।”
“অহ, আর একটা কথা তোমাকে বলার ছিল।”
“হ্যাঁ, কি কথা?”
“তোমার কাজিন একটা আছে না, ওই যে গোল চিকন ফ্রেমের চশমা পড়ে যে।”
“কে দিবা? হ্যাঁ কি হয়েছে এখন?”
“সে কোথায় থাকে?”
“কি ব্যাপার! হঠাৎ আমার কাজিনের খোঁজ নিচ্ছ…”
কথা বলার মাঝে হুট করেই মীরাকে কেউ পিছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় মীরার ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। ফোন পড়ে যাওয়ার শব্দে আয়ান চমকে উঠে। কি হলো হঠাৎ মীরার! আয়ান হ্যালো হ্যালো বলতে থাকে। এদিকে মীরা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে এটা দিবা। মীরা ধমক দিয়ে বলে, “এভাবে কেউ আসে? আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানিস?”
দিবা মীরাকে ছেড়ে দুই কান ধরে বলে, “স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি রে।”
মীরা ভ্রু কুচকে বলল, “তুই হঠাৎ? গ্রাম থেকে কবে এলি? আর কে এসেছে?”
“বাবা এসেছে। এখন তো কলেজ নেই, তাই আমি ভাবলাম কিছুদিন এখানে এসে থাকা যাক। এসে জানতে পারলাম তুইও এসেছিস। তাই তোকে সারপ্রাইজড দিতে এলাম।”
“অনেক বড়ো সারপ্রাইজ দিয়েছিস। বায় দ্য ওয়ে। এখন না বাড়িতে ধান আসবে। তুই কাজ রেখে এলি কেন?”
দিবা মুচকি হেসে বনিতা করে বলল, “আমার ওসব ধানের কাজ করতে মোটেও ভালো লাগে না। ইরা পারে। তাই ওকে রেখে আমি চলে এসেছি।”
“কি ধান্দা বাজ রে তুই। কাজ করার ভয়ে বেড়াতে চলে এলি। আর ওদিকে ইরার যে এতো কষ্ট হবে তাও ভাবলি না।”
“আমার কাজ করতে ভালো লাগে না আমি কি করব।”
“দেখবি, তোর কপালে এমন এক শাশুড়ী জুটবে, যে লোকে তিনবেলা শুধু খাটিয়েই যাবে।”
“কি নিষ্ঠুর রে তুই। বোনকে কেউ এমন অভিশাপ দেয়?”
“বেশ করেছি। ইরাও আমার বোন। তুই ওকে একা ফেলে চলে এসেছিস। এটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি। ওকে সাথে করে নিয়ে আসলে কি হতো?”
“স্যরি। নেক্সট টাইম আর ভুল হবে না।”
এতক্ষণ দু’বোনের কথপোকথন শুনে নিয়েছে আয়ান। মীরার আর ফোনের কথা খেয়াল ছিল না। সে দিবাকে নিয়ে নিচে চলে যায়। আর আয়ান তাদের সাড়াশব্দ না পেয়ে কল কেটে দেয়।
–
গোধুলি লগ্ন। সূর্যটা হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। আকাশে রক্তিম আভা ছড়িয়েছে। মেঘগুলো রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। দিবা আর মীরা ছাদে বসে চা খাচ্ছিল। সাথে গল্প করতে করতে হাসছে। মীরার ভাবি আস্তে করে ছাদে উঠে তাদের ডাক দিল। আহান ও আয়ান দুজনেই এসেছে। মীরার খুব খুশি লাগলো। সে দিবাকে রেখেই এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে গেল। দিবা হতবিহ্বল চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। মীরার ভাবি তখন মজা করে বলল, “দেখলে, বর এসেছে শুনেই কেমন খুশি হয়ে গেল। এটাই ভালোবাসা বুঝলে।”
দিবা ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়।
“গভীর ভালোবাসা।”
“তোমার কেউ আছে নাকি?”
“না না। আমার কেউ নেই।”
“থাকলে বলে ফেল। বিয়ে দিয়ে দেই। তুমিও বরকে নিয়ে সুখের সংসার করো।”
“আরে ভাবি! কি বলেন এসব। কেউ নেই আমার।”
“লজ্জা পাচ্ছ কেন? ভাবির সামনে কিসের লজ্জা।”
“সত্যিই বলছি ভাবি। আমার কেউ নেই।”
“পছন্দও নেই?”
“না।”
“বাহ্। তাহলে আমাদের পছন্দের কাউকে বিয়ে করে নিও।”
“ভাবি!!”
মীরার ভাবি হাসে। দিবা লজ্জা পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।
.
মীরা নিচে এসে দেখে আয়ান ও আহান দুজনেই একসাথে সোফায় বসে আছে। মীরা খুশি মনে ওদের সামনে যেয়ে আয়ানকে বলল, “তুমি এসেছ তাহলে। থ্যাঙ্কিউ।”
আয়ান মুচকি হাসে। পাশ থেকে পিয়াওমিকে বের করে। মীরা পিয়াওমিকে দেখে আরও খুশি হয়ে যায়। আয়ান পিয়াওমিকে মীরার কাছে দিয়ে বলে, “পিয়াওমিকে নিয়ে এলাম। ও তোমায় মিস করছিল।”
মীরা পিয়াওমিকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, “খুব ভালো করেছ। আমিও ওক খুব মিস করছিলাম।”
মীরার মা এসে আহান ও আয়ানকে নাশতা দিলেন। মীরা পিয়াওমিকে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল।
সন্ধ্যার দিকে সবাই মিলে দই খাচ্ছিল। আহান ছাড়া বাকি সবার খাওয়া শেষ হলে হাত ধুঁয়ে নেয়। আহান বেচারা বসে খেতে পারছেনা। তাই এক কোণে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিল। মীরা অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে। এদিকে আয়ন একটা তেলাপোকা দেখতে পেল। সাথে সাথেই আয়ানের দুষ্ট মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির আগমন ঘটে। সে তেলাপোকাটাকে নিয়ে সোজা মীরার সামনে ধরে। চোখের সামনে একটা তেলাপোকা দেখে এক জোরে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে মীরা। দৌড়ে এক ছুটে আহানের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে। আহানের হাতে থাকা দই এর বাটিটা মীরার ধাক্কায় উপরে উঠে যায়। সব দই আহানের মাথার উপর গিয়ে পড়ে। কাঁচের বাটিটা নিচে পড়ে ভেঙে যায়। মীরা আহানকে জড়িয়ে ধরেই তেলাপোকা বলে লাফালাফি করতে থাকে। আহান স্তব্ধ! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তার হাত দুটো দু’দিকে স্থির রয়েছে। মীরার থেকে আলগা হয়ে আছে হাত দুটো। এদিকে দিবা হা করে মীরা আর আহানের কাণ্ড দেখছে। আহানের মাথায় দই দেখে সে হাসতে হাসতে বলে, “দুলাভাই এর মাথায় তো কাক পায়খানা করে দিয়েছে। হিহিহি।”
দিবার কথায় আয়ানও হেসে উঠে। ও শুধু মীরাকে ভয়ই দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু এমন সিন সে দেখবে কল্পনায় ভাবেনি। আহান ওদের হাসি দেখে একটু রুদ্ধ হয়। সে মীরাকে বলে, “মীরা, ছাড়ো আমাকে। সবাই দেখছে। তুমি আমার কি হাল করেছ দেখো একবার।”
মীরা আহানের ধমকে আহানকে ছেড়ে দেয়। ভীত মুখশ্রী নিয়ে আহানের দিকে তাকায় সে। আহানের মাথা দই দিয়ে ভরে গেছে। টুপটুপ করে মাথা থেকে দই পড়তে থাকে। মীরা আহানের এমন হাস্যকর চেহারা দেখে হাসতে থাকে। “আপনাকে যা লাগছে না!”
বলে আবারও দম ফাটা হাসি দেয়। এদিকে আহানের চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে রাগে ফোসফাস করতে থাকে। মীরার দিকে তেড়ে আসে। মীরা তা দেখেই এক দৌড় দিল। আহান পিছু নিল। মীরা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। আহানও কম যায়না। পিছন থেকে বলল, “তুমি দৌড় আমার থেকে ভালো পারবে না।”
মীরা থেমে যায়। সে তো ভুলেই গিয়েছিল, আহান কে। তাই আর দৌড়ায় না। আহান এসে নিজের মাথার উপর থেকে কিছুটা দই নিয়ে মীরার গালে লাগিয়ে দেয়। মীরা আকস্মিক চোখে আহানের পানে চায়। আহান গুড বায় বলে ওয়াশরুমে চলে যায়।।মীরা বোকার মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
চলবে…