#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
চোখের সামনে আহান, মীরা ও মিরাজকে দেখে চমকে যায় আয়ান। এরা একসাথে এখানে কিভাবে? ও যে এইখানে কে খবর দিয়েছে তাদের। মীরা দুহাত বুকে ভাজ করে আয়ানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আহান গম্ভীর। মিরাজ চুপচাপ। আয়ান হতভম্ব। কি করবে ভাবছে সে। বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এভাবে ধরা খাবে এটা ভাবেনি। মেকি হেসে বলল, “তোমরা সবাই এখানে!”
আহান রাগ দেখিয়ে বলে, “সবাইকে টেনশনে রাখতে ভালোই লাগে না তোর? কাউকে কিছু না বলে এখানে এসেছিস কেন?”
“আসলে ভাইয়া, মন ভালো নেই। তাই ভাবলাম কয়েকদিন বাহিরে থেকে ঘুরে আসলে মন ভালো হবে।”
“তাই তুই কাউকে না জানিয়ে চলে এলি? একবার তো জানিয়ে দিতি। কাউকে না হোক, অন্তত আমাকে বলতিস।”
আয়ান নিচু হয়ে বলে, “স্যরি ভাইয়া। আর কখনো এমন হবেনা।”
তখন মীরা বলে, “অনেক হয়েছে, এখন বাসায় চলো।”
“এখনই! আমি আরও দুটো দিন থাকতে চাই।”
“আমরা এসেছি দেখতে পাচ্ছিস না? খালি হাতে ফিরে যাব নাকি?”
আহানের ধমকে ঠোঁট উলটিয়ে আয়ান বলল, “কেন, তোমরাও থেকো যাও না। এক দফায় তোমাদের ঘোরাও হয়ে যাবে।”
মীরা কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে, “ইচ্ছে তো করছে, কিন্তু..”
আহান ভ্রু কুচকে মীরার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি ওর সাথে তাল মেলাচ্ছ? ভুলে যেও না আমরাও না বলে এসেছি। বাসায় ফিরতে হবে।”
মীরা ভেংচি কাটে আহানকে। কোথাও তো ঘুরতে নিয়ে যায়নি এখনো পর্যন্ত, আবার এসেছে শাসন করতে! মিরাজ আয়ানের সামনে এসে ওর দুটো হাত ধরে। অপরাধী কণ্ঠে বলল, “সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি আয়ান। আমি তোমায় ভুল বুঝেছি। না জেনে যা তা বলেছি। আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার মায়ের মতোই হবে। কিন্তু মীরা আর আহান যখন জোর গলায় বলল তুমি এমন নও, এরপর থেকেই আমি অনুতপ্ত। আমি তোমায় বুঝতে পারিনি। পারলে ক্ষমা করো প্লিজ।”
“আরে ভাইয়া। ইট’স ওকে। আপনি বড়ো হয়ে আমার কাছে ক্ষমা চাইবেন না প্লিজ। আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। যা হয়েছে ভুলে যান। আপনি এখানে আমাকে খুঁজতে এসেছেন দেখে খুব খুশি হয়েছি।”
আয়ান মুচকি হেসে মিরাজকে জড়িয়ে ধরে। মীরা আর আহান হাসছে। যাক! সব ভুল বোঝাবুঝির অবশান হলো শেষে। মিরাজ আয়ানকে ছেড়ে মীরাদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমায় যেতে হবে, তোরা কিন্তু যাবি না।”
“মানে কি! আমরা এখানে থেকে কি করব?”
“আয়ান কি বলল শুনলি না? দুইদিন থাকবি। এরপর বাসায় যাবি। তুই যা নিরামিষ, আমার বোনকে তো বোধয় কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাসনি। তাই যা বললাম সেটা যেন মাথায় থাকে।”
“আরে ভাই আমার ডিউটি!”
“রাখ তোর ডিউটি। আগে আমার বোন তারপর সব। এমনি এমনি কি তোর হাতে তুলে দিয়েছি নাকি!”
মীরা মনে মনে বেশ হাসছে। ভাই কিভাবে তার মনের কথা বুঝলো। এই নিরামিষ কিছুতেই বুঝে না। ভালোই একটা উপাধি দিয়েছে মিরাজ। নিরামিষ! এখন থেকে এই নামেই ডাকবে আহানকে।
মিরাজ তাদের থেকে বিদায় নিয়েই চলে যায়। আয়ান গিয়ে হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আহান ও মীরার জন্য একটা রুম বুকিং নেয়।
মীরার থেকে নাম্বার নিয়ে আহান এই হোটেলে কল দিয়েছে। হোটেল ম্যানেজারকে আয়ানের নাম বলে আরও কিছু ডিটেইলস দিতেই উনি জানান আয়ান তাদের ওখানেই আছে। মীরা এই বিষয়টা জেনে মিরাজকে বলে। এরপর আহান কক্সবাজারের টিকিট কাটে। প্রথমে দুটো কাটলেও মিরাজ এসে জোরাজোরি করে সেও তাদেত সাথে যাবে। এরপর আহান আরও একটি টিকিট কাটে। তিনজন মিলে একসাথে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়৷ রিসোর্টে এসে জানতে পারে আয়ান এখন নিজের রুমে নেই। তাই তারা অপেক্ষা করতে থাকে আয়ানের জন্য। এরপর যখন আয়ান আসে ওরা মুখোমুখি হয়।
–
হোটেল রুমটি ভালো করে দেখছে মীরা। কি সুন্দর করে সব সাজানো, গোছানো। বিছানাটা কি নরম তুলতুলে। মীরা একবার বসছে আর একবার উঠছে। আহান কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে রুমের ভেতরে ঢুকল। মীরাকে বিছানার উপর লাফালাফি করতে দেখে ফোন কেটে পকেটে রাখলো। ভ্রু উপরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? এতো লাফালাফি করছ কেন?”
মীরা বলে “দেখুন, রুমটা কত সুন্দর। বিছানাটা কত নরম। আর ওই দেখুন, বারান্দাটা! ওয়াও! ওখান থেকে সমুদ্র কত ভালোভাবে দেখা যায়। আমাদের রুমে তো একটা বারান্দাও নেই।”
“তোমার কি এখন এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে নাকি?”
“খুব। কিন্তু কি করব! এটা তো আর আমাদের বাসা না।”
“বারান্দায় গিয়ে সমুদ্র দেখো, যাও।”
“আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন?”
“স্যার এর সাথে। আসার সময় একদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। এখন আরও একদিনের কথা বললাম৷ স্যার বলল ঠিকাছে।”
“মিস্টার নিরামিষ!”
“কি বললে?”
“না কিছুনা।”
” আমি শুনেছি।”
“শুনে নিয়েছেন? তাহলে আপনি ওটাই।”
“ভাইয়ের সাথে এখন বোনও শুরু করেছ? ওকে! সময় আমারও আসবে। তখন দেখাব কে কেমন।”
মীরা আহানের হাত টেনে ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। দুজনে মিলে সমুদ্রের ঢেউ দেখছে। মীরা আহানের এক হাত জড়িয়ে আহানের কাঁধে মাথা রাখে। এই প্রথম মীরা আহানের সাথে একা ঘুরতে এসেছে। এরকম একটা মুহুর্ত সে সবসময়ই চাইতো। মীরা আহানের শার্ট আঁকড়ে ধরে। কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে বুকে রাখে। জড়সড় হয়ে থাকে আহানের বুকে। আহান মুচকি হেসে মীরাকে আগলে নেয়। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল।
–
দুপুরের খাওয়া শেষে ওরা তিনজন কিছুক্ষণ রেস্ট নেয়। এরপর মীরা বায়না করে সে এখুনি সমুদ্রে যাবে। তিনজন মিলে সমুদ্রের পাড়ে আসে। মীরা সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে রাখে। খিঁলখিঁল করে হাসতে থাকে। আহান মুগ্ধ চোখে মীরার পানে চেয়ে থাকে অনিমেষ। ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে লাফ দেয় মীরা। আহান তাকে সাবধান করে যেন দূরে না যায়৷ আয়ান তিনটা ডাব কিনে নিয়ে আসে। একটা আহানকে দেয় আর একটা নিজের কাছে রাখে। মীরার ডাবটা একটা চেয়ারের উপর রেখে দেয়। মজার ছলে আহানকে বলে, “পাগলটার পাগলামি শুরু হয়ে গেছে বল। দেখ কেমন লাফাচ্ছে।”
“ভাবি হয় তোর।”
“কে মানে ওকে ভাবি! পিচ্ছি মেয়ে একটা। সমবয়সী কখনো ভাবি হয় নাকি।”
“তাহলে কি হয়?”
“বোন হয়।”
“তোদের মধ্যে এখন ঝগড়া হয়?”
“উঁহু! জানিস আমি ওর প্রতি খুব খুশি।”
“কেন?”
“ওকে বলেছিলাম আমার মা আর তোকে যেন মিলিয়ে দেয়। ও আমাকে কথা দিয়েছিল। আজ দেখ, মা তোকে এখন চোখে হারায়। কাছে টেনে নিতে চায়।”
“এসবে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। যখন দরকার ছিল তখন অবহেলিত হয়েছি, এখন আমার বিরক্ত লাগে।”
“প্লিজ ভাইয়া। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বল। তুই মা’কে আর দূরে সরিয়ে রাখিস না প্লিজ।”
“আমি চেষ্টা করব।”
ওদের কথার মাঝেই মীরা এসে উপস্থিত হয়। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। আয়ান মীরার জন্য রাখা ডাবটা তাকে দেয়। মীরা খুশিমনে সেটা খেতে থাকে। এরপর আয়ান বলে দুজনের ছবি তুলবে পাশাপাশি দাঁড়াতে। মীরা আয়ানের কথায় আর দেরি করল না। আহানের হাত টেনে সমুদ্রে নিয়ে গেল। আহানের হাত জড়িয়ে বিভিন্ন পোজ দিয়ে যাচ্ছে সে। আয়ান মুচকি হেসে তাদের ছবি তুলছে। একসময় সূর্য ঢলে পড়ে সমুদ্রের কোলে৷ সূর্যের রক্তিম আভা মিশে গেছে সমুদ্রে। নীল রঙ-এর পানি মুহূর্তেই লাল রঙ ধারণ করেছে। মীরা যেন এই সুযোগটার অপেক্ষা করছিল। আয়ানকে বলে তাদের একটা ভিডিও করতে। মীরা আহানের থেকে অনেকটাই দূরে চলে যায়। আয়ান রেড়ি বললে সে দৌড়ে আসে আহানের দিকে৷ আহান হতবিহ্বল চাহনিতে মীরার দিকে তাকিয়ে আছে। মীরা কি করতে চাইছে আহানের তা বোধগম্য হচ্ছে না। মীরা দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে আহানের গলা জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমুঢ় আহান। মীরার কোমর জড়িয়ে ধরে থাকে শক্ত করে। তারচেয়েও শক্ত করে আহানকে ধরে মীরা। দুই পা হাটু ভাজ করে উপরের দিকে তুলে রেখেছে। ঠিক যেমন সিনেমায় নায়িকারা নায়কদের গলা জড়িয়ে ধরে উপরে উঠে যায়, মীরাও ঠিক তেমনই কাজ করেছে। আয়ান ভিডিও করে ওদের ডাক দেয়। আয়ানের ডাকে আহানের হুশ ফিরে। সে মীরাকে নামিয়ে মীরার হাত ধরে আয়ানের কাছে আসে।
“ওয়াও! ভিডিও টা কিন্তু জোস হইছে।”
মীরা উৎফুল্ল কণ্ঠে জিগ্যেস করে। “দেখি দেখি।”
আয়ানের ফোন থেকে ভিডিও দেখে চমকে যায় মীরা। এতো সুন্দর সুর্যস্তের সাথে তাদের এমন রোমান্টিক দৃশ্য বেশ মানিয়েছে। দারুণ কম্বিনেশন! মীরা খুশি হয়ে আয়ানকে অনেকগুলো থ্যাংকস জানায়। আহান বলে, “এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল? আর একটু হলেই তোমায় নিয়ে পড়ে যেতাম।”
“আমি দেখতে চেয়েছিলেন আপনি আমায় কতক্ষণ ধরে রাখতে পারেন। হুট করে আসায় আপনি ঘাবড়ে গিয়েছেন কিনা।”
“পরিক্ষা করলে আমায়?”
“ধরে নিন তাই।”
“তো কি মনে হলো?”
“আপনি আমার পরিক্ষায় পাশ করেছেন মিস্টার নিরামিষ।”
“আবার এই অখাদ্য নাম!”
“থামবি তোরা? চল আমরা পাশের ছোটখাটো মার্কেটগুলোতে ঘুরে আসি।”
“তোরা যা। আমি যাব না।”
“মীরা ঠিকই বলেছে, নিরামিষ একটা।”
“অ্যাঁই! তুইও? ছোট হয়ে বড়ো ভাইকে এসব বলতে লজ্জা লাগছে না?”
মীরা মিটমিট করে হেসে বলল, “বেশ করেছে।”
আহান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, “ঠিকাছে। চলো।”
ওরা তিনজন মিলে আসেপাশের ফুতপাত ধরে বেড়ে উঠা ছোটখাটো মার্কেটগুলোতে ঘুরতে যায়। মীরা কত রকমের জিনিস দেখে। কি সুন্দর সাজানো সব ঝিনুক, শামুক ও পাথরের জিনিসপত্র। ঝিনুকের মালা, ব্রেসলেট, দুল, ঝাড়বাতি। শামুক দিয়ে তৈরি করা নানান রকম জিনিস। আরও কত কি। পাথরের মাঝে খোদাই করা বিভিন্ন নামলিপি। মীরা একটা ঝিনুকের মালা নিল। এরপর চুড়ির দোকান নজরে এলো। বাহারী সব চুড়ির সমাহার সেখানে। মীরার দেখেই লোভ লাগলো। মীরা আহানকে দেখিয়ে দেয় চুড়ি কিনে দেওয়ার জন্য। আহান দুই ডজন চুড়ি কিনে দেয় মীরাকে। মীরার খুশি দেখে কে! আহান যত্ন নিয়ে মীরার হাতে চুড়ি পড়িয়ে দেয়। যা মীরার কাছে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। আহান মীরার চুড়ি ভর্তি হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। পলকহীন দৃষ্টি মীরারও। দুজনের মুগ্ধতায় দুজন ডুবে আছে। হুট করে তাদের মাঝখানে ঢুকে পড়ে আয়ান। মীরা ও আহান দুজনেই বিশ্মিত। আয়ানের আগমনে দুজন দুইদিকে ছিটকে পড়ে৷ আয়ান বলে, “তোমাদের রোমান্স এখানে করার জায়গা নয় বুঝলে। চলো, খিঁদে পেয়েছে আমার। খাব।”
মীরা লজ্জা পায় আয়ানের কথায়। এ কেমন দেবর তার। অতঃপর তারা খাবের স্টলগুলোতে যায়। নানা রকমের ফিশফ্রাই দেখে জ্বীভে জল চলে আসে। মীরার পছন্দ চিংড়ি মাছ। সে চিংড়ি মাছ নিয়ে খেতে শুরু করে। আয়ান আর আহানও মীরাকে দেখে চিংড়ি মাছ নিয়ে খায়। ফুসকার স্টল দেখে মীরা যেন আরও লাফিয়ে উঠে। সে আহানের কোনো কথাই শুনে না। দৌড়ে গিয়ে ফুসকা অর্ডার দেয়। এরপর দুই প্লেট ফুসকা খেয়ে তারপর শান্ত হয়। তারা অনেক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। মীরা কিছু ড্রেস কিনে মার্কেট থেকে। আহানেও জন্যও টি-শার্ট, পেন্ট নিয়ে নেয়। আহান টি-শার্ট খুব কমই পড়ে। বেশিরভাগই শার্ট পড়ে। তবুও মীরা নেয়। মীরা আয়ানকে একটা শো-পিস কিনে দেয়। শো-পিসটা দেখতে অনেক সুন্দর। একটা মেয়ে ও একটা ছেলে পুতুল পাশাপাশি দাঁড়ানো। ছেলেটির হাতে গিটার ও মেয়েটি তার কাঁধে মাথা রেখে গান শুনছে। আয়ানের এটা খুব ভালো লেগে যায়। ঘোরাঘুরি শেষ হলে ওরা চলে যায় হোটেল রুমে।
চলবে…