#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৩৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকালবেলা দিবাদের বাড়িতে শোরগোল লেগে যায়। দিবার মা উঠে দিবাকে অনেক বার ডাকেন নাশতা খাওয়ার জন্য। দিবা সাড়াশব্দ করে না। দিবার মা ভাবেন হয়তো ঘুমুচ্ছে, পরে ডেকে নিবেন। একটু ঘুমাক। কিন্তু অনেক্ষণ পরেও যখন দিবা আসেনা নাশতা করার জন্য, দিবার মায়ের সন্দেহ হয়। এতো লেইট করে তো ঘুম থেকে উঠে না সে। আজ কি হলো যে একদম উঠছেই না। দিবার মা আবার দরজা ধাক্কা দিয়ে দিবাকে ডাকে। তবুও দিবার সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দিবার মা সাথে সাথেই নিজের স্বামীকে বলেন। দিবার বাবা এসেও অনেকবার ডাকে, কিন্তু কোনো আওয়াজ শুনতে পাননা তারা। দিবার মা কাঁদতে থাকেন। দিবার বাবা সিদ্ধান্ত নেন দরজা ভেঙে ফেলবেন।।অবশেষে অনেক ধাক্কাধাক্কি করেন উনি দরজা খোলার জন্য। জোরে জোরে ধাক্কা দেওয়ার পরে দরজা খুলে যায় একসময়। দিবার দাদি এতো চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ভেতরে ঢুকে দিবার বাবা যেন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। দিবার মা ও দাদি দুজনেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। দিবা নিজের বিছানায় উপড় হয়ে শুয়ে আছে। একটা হাত ফ্লোরে পড়ে আছে তার। দিবার বাবা এগিয়ে গেলেন দিবার কাছে। দিবার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু দিবার কোনো হেলদোল নেই। দিবার মা কাঁন্না জুড়ে দিয়েছেন। দিবার বাবা আর দেরি করলেন না। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন হসপিটালে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরে পড়ছে ওনার। শেষ পর্যন্ত কিনা মেয়ের এমন দশা দেখতে হবে তা কল্পনাও করেননি। তবে কি তাড়াহুড়ো করে মেয়ের বিয়ে দেওয়াই কি মস্ত বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তার? দিবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার বলেছেন ভর্তি করতে হবে। দিবার বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আগে নিজের মেয়ে। এদিকে কাঁন্নাকাটি করে শেষ হয়ে যাচ্ছেন দিবার মা।
–
সকালবেলায় নাশতা করে আহান বেরিয়ে গেল। আহান যাওয়ার সময় মীরা বারবার ওর হাত ধরে বলেছে, “আজ না গেলে হয়না?”
আহান তখন মীরাকে বুঝিয়েছে, “এমনিতেও এ মাসে ছুটি নিয়েছি বেশি। এখন না গেলে হয়তো চাকরি নিয়ে টানাটানি হতে পারে।”
মীরা অসহায় কণ্ঠে বলে, “আমার কেন জানি খুব ভয় করছে। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। কেন এমন হচ্ছে জানিনা। আপনাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে।”
আহান মুচকি হেসে মীরার দু’গালে হাত রেখে বলে, “আমি খুব শিগ্রই ফিরে আসব মীরা। চিন্তা করো না। চিন্তা করলে শরীর খারাপ হবে।”
“আমার মন মানছে না। মন বলছে আপনাকে আজ যেতে না দিতে।”
“আমার তো একটা দায়িত্ব আছে মীরা। বোঝার চেষ্টা করো।”
“ফিরে আসবেন তো তাড়াতাড়ি?”
“খুব তাড়াতাড়ি ফিরব।”
আহান মীরার কপালে একটা চুম্বন দিয়ে চলে যায় তার কাজে। মীরার এখনো কেমন যেন লাগছে। শূন্যতা ঘিরে ধরেছে চারদিক থেকে।
আহান চলে গেছে অনেক্ক্ষণ হলো। মীরা এখন তার শাশুড়ীর সাথে বসে আছে। তার শাশুড়ী তাকে কি যেন বলছেন। কিন্তু মীরা অন্য ভাবনায় মগ্ন। মীরার শাশুড়ী অনেকবার তাকে ডাকলো, কিন্তু মীরা ভাবনার জগৎ থেকে বের হতে পারলো না। মীরার মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে। তার শাশুড়ী আর ডিস্টার্ব করলেন না। তিনি চলে গেলেন রান্নাঘরে। একটুপর আয়ান এসে সোফায় বসলো। টিভি অন করে মীরার দিকে তাকালো সে। মীরা এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। আয়ান মীরাকে ডাক দিল। মীরা জবাব দিল না। মীরাকে আয়ানের স্বাভাবিক মনে হলো না। সে মীরার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে ডাকতে লাগলো। “মীরা, এই মীরা।”
মীরা হকচকিয়ে ভাবনা থেকে বের হয়ে “হ্যাঁ” বলে উঠলো। এরপর দেখে আয়ান তার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। আয়ান জিগ্যেস করলো। “কি হয়েছে তোমার? কোন ভাবনায় আছো?”
“ভালো লাগছে না আয়ান। তোমার ভাইয়াকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে।”
“ভাইয়া তো ডিউটিতে। এতো টেনশন করার কি আছে বুঝতে পারছিনা।”
কথার মাঝেই মীরার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে ভাসতে থাকে মিরাজের নাম। মীরা ফোন রিসিভ করে। আর ওপাশ থেকে যা শুনে, মীরার চোখমুখ অন্যরকম হয়ে যায়। তা দেখে আয়ানের খটকা লাগল। ফোন কেটে মীরা বসে রইলো চুপ করে। আয়ান জিগ্যেস করল. “কি হয়েছে? তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মীরা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, “দিবা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে আয়ান। আমাদের প্ল্যান কাজে দিবে না আর। দিবা হসপিটালে ভর্তি।”
কথাটা শুনেই আয়ান দূরে ছিটকে গেল। ছ্যাৎ করে উঠে বক্ষঃস্থল। নিদারুণ যন্ত্রণা হতে লাগল অন্তর্দেশে। পুরো পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে তার। মীরা বলল, “আয়ান যাবে আমার সাথে?”
আয়ান মাথা নাড়ালো। তার প্রিয়তমার এই করুণ সময়ে সে থাকবে না তা কি করে হয়! মীরা উপর থেকে নিজের পাসট নিয়ে এলো। কাউকে কিছু না বলেই দুজনে বেরিয়ে পড়লো।
–
হসপিটালে দিবার কেবিনের বাহিরে পায়চারি করছেন দিবার বাবা। দিবার মা বেঞ্চিতে বসে কাঁদছেন। দিবার চিকিৎসা চলছে। মেয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠছেন বাবা। খবর পেয়ে ছুটে আসে ইরা ও তার বর। দিবার মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে তারা। প্রায় ঘন্টা খানিক পর ডাক্তার বের হলো কেবিন থেকে। ডাক্তারকে দেখেই ছুটে গেলেন দিবার বাবা। করুণ কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, “আমার মেয়ে কেমন আছে ডাক্তার?”
ডাক্তার সৌজন্য হাসি দিয়ে বললেন, “পেসেন্ট এখন বিপদমুক্ত। তবে আর একটু দেরি হলে হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। অনেকগুলো ঘুমের পিল খেয়েছেন উনি। একটু পর জ্ঞান আসবে। চিন্তা নেই আর।”
দিবার বাবার বুকের উপর থেকে যেন ভারি পাথর নেমে গেল। দিবার মা এতক্ষণে শান্ত হলেন। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিবার বাবাকে জিগ্যেস করলেন, “আমার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে তো?”
দিবার বাবা নিজের স্ত্রীর মাথার উপর হাত রেখে মাথা নাড়লেন। দিবার মা ইরাকে জড়িয়ে ধরে আছে।
ডাক্তারের কথামতো দিবার জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা খানেক পর। প্রথমে দিবার বাবা দিবাকে দেখতে গেলেন। দিবার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো আছে। চোখ দিয়ে চারপাশটা পরখ করে নিল সে। চোখের পাতা ঘনঘন কাঁপছে। ও কি তবে বেঁচে গেল! দিবার বাবা মেয়ের পাশে বসলেন। বাবাকে দেখে অপরাধবোধ করলো দিবা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে উনি বললেন, “কেন এমন করলি মা। কম স্বাধীনতা তো দেইনি তোদের। তবুও কেন…”
দিবার বাবা থেমে গেলেন। এই সময় এসব কথা বলে দিবার উপর চাপ ফেলতে চাননা উনি। দিবার মা ও ইরা এসে দিবাকে দেখে গেল। কাঁন্না করতে লাগলে দিবার বাবা ধমক দিয়ে কেবিনের বাহিরে পাঠিয়ে দেন ওদের। সাইমুনও এক পলক দেখে গেল দিবাকে।
কিছুক্ষণ পর মীরা ও আয়ান এসে উপস্থিত হয় হসপিটালে৷ দিবার বাবা মীরাকে দেখে খুশি হলেও আয়ানকে দেখে মোটেও ভালো লাগেনি তার। মীরা এক দৌড়ে দিবার কেবিনের ভেতর চলে গেল। এদিকে আয়ান একা হয়ে পড়েছে। দিবার কাছে যাবে বলে কেবিনের দিকে পা বাড়ায় সে। কিন্তু দিবার বাবা তাকে নিষেধ করেন। বলেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?”
আয়ান শান্ত গলায় জবাব দেয়। “দিবাকে দেখতে।”
“তোমার জন্যই আমার মেয়ের এই অবস্থা। তুমি ভেতরে যেতে পারবে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।”
আয়ান অসহায় কণ্ঠে দিবার বাবাকে রিকুয়েষ্ট করে বলে, “প্লিজ আংকেল। আমায় একবার দিবাকে দেখতে দিন। আমি শুধু ওকে দেখেই চলে আসব। প্লিজ আংকেল আমায় আটকাবেন না।”
“এতো কিছুর পরেও কি করে ভাবছ তোমায় আমার মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দিব? তোমার জন্যই তো দিবা সুইসাইড করতে চেয়েছিল তাইনা?”
“আংকেল আপনি ভুল ভাবছেন। দিবা কেন আমার জন্য সুইসাইড করতে যাবে? ও তো আমায় পছন্দই করে না। আমি শুধু ওকে পছন্দ করি। আমার পছন্দ শুধুই এক তরফা। যাকে ও পছন্দই করে না, তার জন্য কেন সুইসাইড করবে? প্লিজ আংকেল, আমায় একবার ওকে দেখতে দিন। আমি বেশি সময় নিব না।”
“তোমার জন্য সুইসাইড করেনি? তাহলে কেন এটা করলো ও? আমিতো ভেবিছি তোমার জন্য।”
“আমার জন্য নয় আংকেল।”
“ঠিকাছে, আমি তোমায় যেতে দিচ্ছি। তবে বেশিক্ষণ থাকবে না।”
“আচ্ছা আংকেল।”
আয়ান অনুমতি পেয়ে কেবিনের ভিতরে ঢুকল। দিবাকে দেখে থমকে যায় সে। হাসিখুশি মেয়েটার কি দশা হয়েছে। বিবর্ণ, ফ্যাকাশে চেহারা। চোখ ফুলে গেছে। কথাবার্তা নেই তার। মীরা কত কথাই জিগ্যেস করছে তাকে। কিন্তু কোনো উত্তর সে দিচ্ছে না। আয়ান এগিয়ে গেল। দিবাকে ডাকলো। আয়ানের ডাকে দিবা তার দিকে চাইলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি নত করল সে। “তোমায় মানাচ্ছেনা দিবা। তোমায় এই সাজে একদম মানাচ্ছেনা।”
দিবার চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোঁটা। হুট করেই আয়ানের ফোনটা বেজে উঠে। সে একটু দূরে গিয়ে কল রিসিভ করে। তারপর ওপাশ থেকে যা শুনলো, তা শুনে আয়ানের ফোনটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। মীরা তা লক্ষ্য করে জিগ্যেস করে “কি হলো আয়ান?”
আয়ান চুপ। সে মীরাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। মীরা কিছু বুঝলো না।
আয়ান কেবিন থেকে বের হয়ে এক প্রকার দৌড় দিল। দিবার বাবা দেখে ভ্রু কুচকে তাকালেন। হঠাৎ এই ছেলেটার আবার হলো কি। মীরা এসে দিবার বাবাকে বললেন, “আপনারা এতো তাড়াতাড়ি দিবার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কেন? কাল দিবা আমায় ফোন দিয়ে জানিয়েছে সে বিয়ে করতে চায়না এখন। সে পড়তে চায়। আপনারা মেয়ের মতামত না নিয়ে বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিভাবে নেন? দেখলেন তো অবস্থা। ভবিষ্যৎ এ দিবার অমতে তাকে কোথাও বিয়ে দিবেন না। এবং ও যা চায়, ওকে তা-ই করতে দিন।”
দিবার বাবা বললেন, “অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি রে মা। ভেবেছিলাম মেয়েটা বিপথে চলে যাচ্ছে, তাইতো বিয়ে দিচ্ছিলাম। এখন দেখি আমার মেয়ের কোনো দোষই নেই।”
“ভুল সুধরে নিন। আপনার সাথে পরে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করব মামা। এখন সময় আসেনি।”
–
দুপুরের দিকে মীরার ফোনে একটা কল আসে। কলটা আয়ান তাকে দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করেই আয়ানকে কোনো কথা না বলতে দিয়ে মীরা একাই বলতে থাকে। “তুমি এমন কেন? কোথায় গিয়েছ? যাওয়ার আগে আমাকে বলে যাবে না কোথায় যাচ্ছ, আমি টেনশন করছি। তোমরা সবাই আমাকে এতো টেনশনে রাখো কেন?”
আয়ান চুপ করে আছে। কোনো কথার জবাব দিচ্ছে না। মীরা আবার বলল, “আমি কিছু বলছি আয়ান। জবাব দিচ্ছ না কেন।”
“মীরা, ভাইয়া!”
“ভাইয়া! তোমার ভাইয়া কোথায়?”
“মীরা একবার হায়দার ক্লিনিক এ আসবে?”
মীরা ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “ওখানে কেন?”
“ভাইয়া হাসপাতালে মীরা। একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
কথাটা শুনেই মীরার যেন পায়ের মাটি সরে গেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “মজা করছ আয়ান তুমি?”
“মীরা আমি সত্যি বলছি। আমি খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছি। মা বাবাও এখানে আছেন। শুধু তোমাকে জানাইনি।”
“তুমি এটা কি করে করতে পারলে আয়ান। আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি।”
“স্যরি মীরা। তুমি এখন চলে আসো।”
মীরা আয়ানের ফোনটা কেটে দেয়। হন্তদন্ত হয়ে সে এই হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়। এই ভয়টাই যেন পাচ্ছিল সে সকাল থেকে। কোনো কথাই শুনে না আহান। জানে না এখন কি অবস্থা ওর। যেতে যেতে কাঁন্না করতে থাকে মীরা। ওর জীবনে সুখটা ক্ষণিকের জন্য আসে।
চলবে…